স্ব-উদ্যোক্তা হওয়া রাজশাহীর নারীদের স্বপ্ন পূরণে বিডা’র মাধ্যমে সহায়তা করছে সরকার

স্ব-উদ্যোক্তা হওয়া রাজশাহীর নারীদের স্বপ্ন পূরণে বিডা’র মাধ্যমে সহায়তা করছে সরকার
স্ব-উদ্যোক্তা হওয়া রাজশাহীর নারীদের স্বপ্ন পূরণে বিডা’র মাধ্যমে সহায়তা করছে সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী ।।

বর্তমান সময়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তন এসেছে নারীদের মাঝেও। আর এই পরিবর্তনকে লক্ষ্য করে বর্তমান সরকার বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হাতে নিয়েছে এক নতুন প্রকল্প, যার নাম ‘উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প’।

বিডা’র (বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) এমন পদক্ষেপের কারণে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে বাংলাদেশের বেকার যুব সমাজ। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী সাড়া ফেলেছে নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে ছুটে আসছেন তারা বিডা’র উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে নিজেদের সাবলম্বী হওয়ার লক্ষ্যে।

স্বেচ্ছায় স্ব-উদ্যোগী হতে আসা তেমনি এক নারী উদ্যোক্তা হলেন ইএসডিপি থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া ২য় ব্যাচের প্রশিক্ষনার্থী হচ্ছেন শাকিলা বাশার শিমুল। বাবা রাজশাহী নগরীর প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। স্বামীও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন ব্যবসাতে। পড়াশোনা করেছেন ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট থেকে একটি বেসরকারী বিশ^বিদ্যালয়ে। ৫ বছর শিক্ষকতাও করেছেন একটি বেসকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

তার লক্ষ্য ছিলো সরকারী চাকরি। কিন্তু ধরা দেয়নি সোনার হরিণ। শেষে সিদ্ধান্ত নেন, চাকরির পেছনে আর ছুটবেন না। উদ্যোক্তা হয়ে নিজেই অন্যদের চাকরি দেবেন। শিমুল কাজ করতে চান রাজশাহীর ঐতিহ্য রেশম শিল্প নিয়ে। কিন্তু তারও মূলধন সংকট।
তিনি জানান, প্রতিষ্ঠিত বাবার মেয়ে হওয়ার পরও আমার নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য মূলধন পায়নি। মুলধন যোগাতে বিদেশ থেকে প্রসাধণী আমদানি এবং অনলাইনে বিক্রি শুরু করেছেন। তারও লক্ষ্য নিজের পরিচয় তৈরী।

রাজশাহী কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তণুশ্রী ঘোষ। তার বান্ধবি কামরুন নাহার মিতু পড়েন এই কলেজে প্রাণীবিদ্যায়। তারা জেলার পবা উপজেলার নওহাটা এলাকার বাসিন্দা। ঘনিষ্ট এই দুই বান্ধবি পড়াশোনা শেষ না হতেই স্বপ্ন দেখছেন সফল উদ্যোক্তা হবার।

এরই মধ্যে তারা প্রসাধনী পণ্য আমদানির পর অনলাইনে বিক্রি শুরু করেছেন। কিন্তু মূলধন সংকটে এগুতে পারেননি বেশী দূর। ইএসডিপির প্রশিক্ষণ নেয়ার পর আত্মবিশ্বাস বেড়েছে তাদেরও। তারা চান, এলাকায় উৎকৃষ্টমানের বেকারী শিল্প গড়তে। প্রতিষ্ঠা করতে চান বোতাম শিল্প। নিজেদের ভাগ্য বদলে দিতে চান, ভাগ্য গড়ে দিতে চান তাদের মত আরো অনেকেরই।

প্রায় এক যুগ ধরে আইসিটি খাতে কাজ করছেন মাহবুব আরা নীলা। দীর্ঘদিন ধরেই ভাবছিলেন নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাবেন। মূলধনও যোগাড় করে ফেলেছিলেন। কিন্তু বিনিয়োগের সাহস পাচ্ছিলেন না।

তার ভাষ্য, ইএসডিপির প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি আত্মবিশ্বাস পেয়েছেন। এরপর সময় নষ্ট না করে নেমে পড়েছেন ব্যবসায়। চালু করতে যাচ্ছেন নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘মেট্রয়েল আইটি’।

প্রাণীবিদ্যায় স্নাতকোত্তর নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার নিমদীঘি গ্রামের গৃহবধূ সাঈদা রায়হানা। ভালো ফলাফল করেও চাকরির পেছনে ছুটেননি তিনি। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও নেমে পড়েছেন ব্যবসায়।

সল্প পুঁজিতে গ্রামীণ নারীদের হাতের কাজের রকমারী পণ্য নিয়ে শুরু করেছেন স্বপ্নযাত্রা। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ‘অপরাজিতা’। এটি ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান তিনি। একই সাথে পিছিয়ে পড়া গ্রামীণ নারীদের আর্থিক ভিত গড়ে দিতে চান।

সাঈদা জানান, হাতের কাজের দক্ষতা বাড়াতে তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তার দলের নারীরাও বেশ দক্ষ। তারপরও তিনি বিনিয়োগে ঝুঁকি নিতে সাহস পাচ্ছিলেন না। কিন্তু বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প – ইএসডিপির আওতায় রাজশাহীতে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর সেই ভীতি কেটেছে।

সাঈদা হস্তশিল্প নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বাণিজ্যিক ভেড়ার খামার এবং ভেড়ার পশম থেকে বস্ত্রবুনন শিল্প গড়ে তুলতে চান। তবে তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মুলধন।

ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষ করে ঘরেই বসেছিলেন গৃহবধূ সিফাতুন নাহার মীম। রান্নাবান্নায় প্রচন্ড শখ ছিলো তার। সেই শখ থেকে নেমে পড়েছেন শৌখিন রান্নায়। ইএসডিপির প্রশিক্ষণ নেয়ার পর স্বামীর সহায়তায় গড়ে তুলেছেন হোম কিচেন ‘ব্যঞ্জন’। এরই মধ্যে বেশ নামও করেছে প্রতিষ্ঠাটি।

মীম জানিয়েছেন, রান্নায় আগ্রহ আছে এমন শিক্ষিত ও বেকার শহুরে নারীদের নিয়ে তিনি প্লাটফরম হিসেবে গড়ে তুলতে চান ‘ব্যঞ্জন’কে। নিজস্ব আউটলেট প্রতিষ্ঠা করতে চান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে রাজশাহীতে শুরু হয়েছে ইএসডিপির প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। এখানে ১৫টি ব্যাচে ২৫ জন করে মোট ৩৭৫ জন প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবেন। এরই মধ্যে ৫টি ব্যাচে এই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ১২৫ জন তরুণ উদ্যোক্তা। পুরুষদের পাশাপাশি এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে সফল উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন বুনছেন নারীরাও।

ইএসডিপির জেলা প্রশিক্ষক জামিলা আফসারী আলম জানান, দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠিকে উৎপাদনমুখী অর্থনৈতিক কর্মকাÐে সম্পৃক্ত করে বিনিয়োগ প্রসার ঘটানো তাদের মূল লক্ষ্য। এরই অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী ও প্রায়গিত জ্ঞানসম্পন্ন রিসোর্স পারসনের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ চলছে।

ব্যবসায়ী সংগঠন এবং সফল ব্যবসায়ীরা নতুন উদ্যোক্তাদের মেন্টর হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন। তাছাড়া প্রায়োগিক জ্ঞান অর্জন ও বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনে শিল্প প্রতিষ্ঠানও পরিদর্শন করানো হচ্ছে।

সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারীর পরিসংখ্যান বলছে, রাজশাহীর অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এর মধ্যে গ্রামীণ নারীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। কৃষি উৎপাদনে সরাসরি জড়িত রাজশাহীর বিপুল সংখ্যক গ্রামীণ নারী। এছাড়াও ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, ব্যবসা, চাকরি এমনকি শিল্প কারখানায় পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করছেন এ অঞ্চলের নারীরা।

শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাড়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাÐে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এখনো নারীদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় সমস্যা রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ উইমেন্স চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিডবিøউসিসিআই) রাজশাহী বিভাগের সভাপতি মনিরা মতিন জোনাকী।

তিনি বলেন, রাজশাহীর নারীদের একটি বড় অংশ কুটিরশিল্প নিয়ে কাজ করছেন। একই ধরণের কাজ করছেন অনেকেই। অনেকেই সমবায়ী হিসেবে কাজ করছেন। এতে স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে উৎপাদিত পণ্য। ফলে দেশীয় বাজার নষ্ট হচ্ছে, হারিয়ে ফেলছে রপ্তানী সুযোগ।

বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উচিত- যে সকল নারী উদ্যোগী, তাদের নিয়ে গ্রæপ ভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা। তাছাড়া বড় বিনিয়োগে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে চাপ প্রয়োগ করতে পারে বিডা। এসব সুবিধা পেলে রাজশাহীর নারীরা আরো এগিয়ে যাবে।

এদিকে, ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০১ ও ২০০৩ সালে ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ হারে রাজশাহীর অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ ১৭ হাজার ৬৭জন। ২০১৩ সালে ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ হারে তা গিয়ে দাঁড়ায় ৪৯ হাজার ৯৬৯ জনে। এক দশকে ৩২ হাজার ৯০২ জন নারী জড়িয়েছেন অর্থনৈতিক কর্মকাÐে।

রাজশাহীর অর্থনীতি এখন গ্রামীণ। ২০১৩ সালে রাজশাহীতে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিলো এক লাখ ৫৩ হাজার ৮৬৫টি। যার ৯১ হাজার ৯৭৮টি গড়ে উঠেছে গ্রামীণ এলাকায়। বাকি ৬১ হাজার ৮৮৬টি শহর এলাকায়। মূলত: খুচরা ও পাইকারী ব্যবসা সবেচেয় বেশি ছড়িয়েছে এখানে। যা মোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ৪২ দশমিক ৩১ শতাংশ। অন্যদিকে উৎপাদন ব্যবসা রয়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

এখানকার ব্যবসা এখনো রয়েছে পুরুষের নিয়ন্ত্রণে। জেলায় মোট পুরুষের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৫৮৯টি প্রতিষ্ঠান। আর নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাত্র ৮ হাজার ২৭৬টির।

রাজশাহীতে সব চেয় বেশী ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে ২০০০ থেকে ২০০৯ সালে। এই সময় গড়ে উঠেছে ৮০ হাজার ৩৫০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এরপর ২০১০ থেকে ২০১৩ সালে ৩৮ হাজার ২৬৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

১৯৭১ সালের আগে রাজশাহীতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিলো ২ হাজার ৭০২টি। এরপর ১৯৭১ থেকে ১৯৮৯ সালের ৮ হাজার ৯৬১টি এবং ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ সালে ২৩ হাজার ৬৮৭টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এই জেলায়।

নানান কারণে এই অঞ্চলে বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। এখানকার ৮৮ দশমিক ৯৭ শতাংশের বর্তমান স্থায়ি সম্পদ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া ৫ থেকে ৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা স্থায়ি সম্পদ রয়েছে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের। ৩০০ কোটি পর্যন্ত স্থায়ি সম্পদ রয়েছে এখানকার মাত্র ৮টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের।

বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের রাজশাহীর পরিচালক একেএম বেনজামিন রিয়াজী জানান, রাজশাহী মূলত: শিক্ষা নগরী। ফলে এখানে সেইভাবে বাণিজ্য প্রসার লাভ করেনি। আমরা তরুণদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলছি। ফলে এখন দৃশ্যপট পাল্টাচ্ছে।

তিনি যোগ করেন, এই অঞ্চল কৃষি প্রধান। ফলে এখানে এখন মূলত: কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠছে। দেশে এই খাত বিকাশ লাভ করলে সেই ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে রাজশাহী।

তরুণদের বিনিয়োগে এগিয়ে আসা ইতিবাচকে উল্লেখ করে তিনি জানান, সরকারের পক্ষে প্রতি বছর এতো লোককে চাকরির সুযোগ করে দেয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া বেসরকারী খাতেও এতো লোকের চাকরির সুযোগ দেয়া সম্ভব না। এই প্রেক্ষিতে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন তরুণরা। এটা স্বাভাবিক, একশ জন উদ্যোক্তা দৌড় শুরু করলে পঞ্চাশ জন সফল হবেনই।