শীতের শিশিরের মতো এক কবির জীবনকাব্য - এমরান চৌধুরী

শীতের শিশিরের মতো এক কবির জীবনকাব্য - এমরান চৌধুরী
শীতের শিশিরের মতো এক কবির জীবনকাব্য - এমরান চৌধুরী

একজন মানুষের আয়ু কতদিন ক'কদম তা একমাত্র আল্লাহ গফুরুর রহিম ছাড়া কেউ জানে না - জানার কথা নয়। তবে মুরব্বিদের বলতে শুনেছি "ভালো মানুষ বেশিদিন হায়াত পায় না"। হয়তো তাই, বাংলাদেশের অন্যতম প্রিয় শিশুসাহিত্যিক, কবি ও কথাশিল্পী রমজান আলী মামুনের অকাল মৃত্যু আমাদের কাছে সেই আপ্ত বাক্যটি নতুন করে নাড়া দিয়েছে। মাত্র পঞ্চাশটি বসন্ত পেরোনো এই চিরসবুজ কবি নিজে কাঁদলেন না। কাউকে কাঁদালেন অঝোরে। কেউ কাঁদলেন না কিন্তু হয়ে গেলেন "দ্য ওমেন উইথ আউট টিয়াস"র মতো বোবা, পাথর।

গত দু'বছর ধরে তিনি প্রায় বলতেন, 'এমরান দা' আজ মরলে কাল দু'দিন। এ কথার মাধ্যমে তিনি আমাদের তাঁর প্রস্হানের বার্তা দিয়েছিলেন কি না জানি না। আজ মনে হচ্ছে তিনি হয়তো তাই দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর বিভিন্ন লেখায় শীতের শিশিরের মতো জীবনকাব্যের কথা আকারে ইঙ্গিতে বার বার এসেছে। বছর দুয়েক আগে চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর "সুখে দুখে ফেসবুকে" কলাম লিখেছিলেন, " আমরা সবাই ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি"। একটা সময় মানুষকে মৃত্যুভীতি পেয়ে বসে। মামুন মৃত্যুের চিন্তা করতেন, যা একজন মুসলমান হিসেবে সবারই করা উচিত। তিনিও তাই করেছেন কিন্তু এত তাড়াতাড়ি! ভাবতেই বুক ফেটে যায়।
তাঁর প্রথম প্রকাশিত বইয়ের নাম-- আমার অনেক কষ্ট আছে। এ বইটা প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ এর অাগে। বইটার বেশ কাটতি হয়েছিল। টগবটে এক তরুণ, তার ওপর রাজপুত্রের মতো চেহারার একটি বুকের ভেতরে কোনো কষ্ট থাকতে পারে কখনো সিরিয়াসলি ভাবিনি। কী কষ্ট ছিল তাঁর বুকে? হয়তো না পাওয়ার বেদনা, পেয়েও হারানোর বেদনা! তাঁর সেই কষ্ট কার জন্য তার জবাব এসেছিল ত্রিশ বছর পর তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্হে " তোর জন্য কষ্ট আমার"। আবির প্রকাশনে ছিল তাঁর নিয়মিত আড্ডা। আবির প্রকাশনের কর্ণধারের সঙ্গে ছিল তাঁর গলায় গলায় ভাব। সেই প্রকাশনে বসে এক আড্ডায় মামুন বলেছিলেন, "আমার জন্য চিকিৎসা সহায়তা তহবিল" গঠনের কোনো প্রয়োজন নেই। আমাকে যাঁরা ভালোবাসে তাঁরা আমার পরিবারের প্রতি পারলে খেয়াল রাখলেই হলো। মামুন সব কথাই যেন রাখলেন। কাউকে এতটুকু কষ্ট দিলেন না, না পরিবারকে, না বন্ধু মহলকে।

রমজান আলী মামুন ছিলেন আমার অনুজের মতো। তাঁদের বাড়িতে আমার অবাধ যাতায়াত ছিল বিশেষ করে তাঁর লেখালেখি জীবনের প্রথম দশ বছর। তাঁর মায়ের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি জড়িত। মামুনের ধূমপানের অভ্যাস ছিল। তবে কখনো আমার সামনে তা করতে দেখিনি। তিনি আমাকে এতটাই সম্মান করতেন যে হঠাৎ একদিন ধূমপানরত অবস্হায় তাঁর সামনে পড়লে সিগারেটের জ্বলন্ত শলাকা হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছিলেন।

রমজান আলী মামুন বড় অভিমানী ছিলেন। তবে সেই অভিমান কখনো প্রকাশ করতেন না। তাঁর পরম ধৈর্য্য শক্তি ছিল। যে শক্তির বলে শত টানাপোড়নের মধ্যেও চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন সুকুমার শিল্পের চর্চা। চট্টগ্রাম শহরে যেখানটায় তাঁর জন্ম সেখান থেকে উঠে আসার কথা ছিল একজন কোটিপতি ব্যবসায়ী। কিন্তু মামুন টাকার পেছনে না ছুটে, ছুটেছেন সত্যের পেছনে, সুন্দরের পেছনে। ফলে তাঁর কোনো ব্যাংক হিসাব ছিল না। তিনি গৃহী হয়েও সন্নাসীর মতো জীবন যাপন করে গেছেন। তাঁর জীবনটা এত সাধারণ ছিল যে খুব অল্পে তিনি তুষ্ট থাকতেন। চায়ের দোকানে ঢুকলে এক কাপ চা দু'জনে ভাগ করে খেতেন। কখনো দামি খাবারের প্রতি তাঁর এতটুকু লোভ ছিল না। যেমনটা এসেছিলেন পৃথিবীতে ঠিক তেমন করেই বিদায় নিলেন বিজয়ীর বেশে।


মামুন যে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তা আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল তাঁর লেখালেখির সাড়ে তিন দশক পূর্তি অনুষ্ঠান করার ইচ্ছে নিয়ে। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল, বাধ সাধল ম্যাগাজিন। স্বল্প সময়ে ম্যাগাজিনের কাজ শেষ করা মোটের ওপর অসম্ভব ছিল। ফলে প্রোগ্রামটা পিছিয়ে দেওয়া হয়। জানি না তাঁর এ অপূর্ণ সাধ আমরা পূরণ করতে পারব কি না? পরম করুণাময় আল্লাহ একমাত্র সহায়।

একটি মানুষ হারিয়ে গেলে কার কি ক্ষতি হয়?
তোমার না হয়
আমার না হয়
হয়তো কারো হয়!
সত্যিই বলেছেন মামুন। কারো না কারো ক্ষতি হয়। এই যেমন ক্ষতি হলো আমাদের, শিল্প ও সুন্দরের। ভাই ক্ষমা করো আমাদের। আমরা আপনার কোনো কাজেই আসলাম না। তবে আমারা নিশ্চিত আল্লাহ আপনাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্হানে আসীন করবেন।