সর্বাধিক জনপ্রিয় ও বহুল আলোচিত কোহিনূর কাহিনী

সর্বাধিক জনপ্রিয় ও বহুল আলোচিত কোহিনূর কাহিনী
সর্বাধিক জনপ্রিয় ও বহুল আলোচিত কোহিনূর কাহিনী

পোস্টকার্ড প্রতিবেদক ।।

সর্বাধিক জনপ্রিয় ও বহুল আলোচিত যেমন তেমন আবার বিশ্বের সবচেয়ে বিতর্কিত হীরাগুলোর মধ্যে একটি কোহিনূর হীরা । কয়েকশো বছরের একটি লম্বা ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে এই হীরার নামের সাথে।

কখনো এটি শোভা পেয়েছে মুঘল দরবারে, কখনো ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছে ইরানি যোদ্ধাদের হাতে, কখনো আবার সমৃদ্ধ করেছে আফগান শাসক কিংবা পাঞ্জাবি মহারাজাদের। বলা হয়ে থাকে, প্রাচীনকালে সুন্দরী কুমারীরা যেমন বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ ও শাসকদের হাতে হাতে ঘুরে বেড়াত, ঠিক এমনই একটি পথচলা ছিলো কোহিনূরেরও।

উইলিয়াম ডালরিম্পল ও অনীতা আনন্দ রচিত “ কোহিনূর: দ্য স্টোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ইনফেমাস ডায়মন্ড” নামক বইটি রচিত হয়েছে এই কোহিনূর কে ঘিরে আর এই বইটিকে কোহিনূরের নির্ভরযোগ্য তথ্য হিসাবে দেখে সবাই। এবার সেই কোহিনূর এর কাহিনী নিয়ে লিখেছেন – জিয়া উল ইসলাম

কোহিনূরের দাম ১২০০ কোটি টাকা
কোহিনূর হীরা ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চুরি ঘটনা। অতিকায় এই হীরার দিকে নজর ছিল শাসকদের। তাই যুদ্ধজয় বা সিংহাসন পরিবর্তনের সঙ্গে কোহিনূরের মালিকানা পরিবর্তন ছিল উল্লেখযোগ্য। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে চুরি হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে দামি কোহিনূর হীরা এখন ব্রিটিশ রাজপরিবারের অলঙ্কার ভান্ডারের অংশ। এই কোহিনূরের দাম প্রায় ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড। অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১,২০০ কোটি টাকা।

সম্রাট শাহজাহানের আমলে এটি ছিল তার ময়ূর সিংহাসনে। ময়ূর সিংহাসনে খচিত থাকা কোহিনূর হীরাটি ব্রিটিশরা চুরি করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষ দখল করে নেওয়ার পর সরিয়ে ফেলে কোহিনূর। ময়ূর সিংহাসন থেকে এটি চুরি করে ব্রিটিশরা। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ থেকে কোহিনূর চুরি করেছে এ নিয়ে বহু বছর ধরেই অভিযোগ রয়েছে। এই হীরার আসল মালিকানা শুধু ভারত নয়, আফগানিস্তান, ইরানও দাবি করেছে। ব্রিটিশদের চুরি করে নিয়ে যাওয়া সেই কোহিনূর ভারতে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বারবার।

তবে সববারেই তা ব্যর্থ হয়েছে। কোহিনূর শোভিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ‘হীরার মুকুট’ ফিরিয়ে আনতে ‘মাউন্টেন অব লাইট’ নামক একটি দল ইতিমধ্যেই লন্ডন হাই কোর্টে মামলা দায়েরের জন্য আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছিল।

মাউন্টেন অব লাইটের পক্ষের আইনজীবী দলটির দাবি, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ১০৫ ক্যারেট হীরার ওই কোহিনূরটি চুরি করে নিয়ে যায় ব্রিটিশ শাসকরা। এ কারণে তারা যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে ওই কোহিনূরটি ফেরত দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। তবে সেই দাবি ধোপে টেকেনি। যুক্তরাজ্য কোহিনূর হীরা ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়নি।

ব্রিটিশরা কি কোহিনূরকে চুরি করেছিল!
ব্রিটিশরা কি কোহিনূরকে আসলে চুরি করেছিল! এর উত্তরে ভারত সরকার ২০১৬ সালের এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্টকে বলেছিল, যুক্তরাজ্য কোহিনূর হীরা চুরি করেনি অথবা জোর করে নেয়নি। তৎকালীন পাঞ্জাবে ক্ষমতায় থাকা মহারাজা রঞ্জিত সিংহের উত্তরাধিকারীরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে এটি উপহার দিয়েছিলেন। তবে সরকারের এই বক্তব্যের সঙ্গে সমপ্রতি দ্বিমত পোষণ করছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (এএসআই)।

তারা বলছে, আসলে ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়াকে কোহিনূর দিতে বাধ্য হয়েছিলেন লাহোরের মহারাজা। জনস্বার্থে করা এক মামলায় এর আগে সরকার বলেছিল, মহারাজা রঞ্জিত সিংহের উত্তরাধিকারীরা ‘অ্যাংলো-শিখ’ যুদ্ধের ‘ক্ষতিপূরণ হিসেবে’ যুক্তরাজ্যকে স্বেচ্ছায় এই কোহিনূর দিয়েছিলেন। কোন কারণে কোহিনূর ভারত থেকে যুক্তরাজ্যে গেল, সেই বিষয়টি জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে (আরটিআই) দেশটির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সমপ্রতি আবেদন করেন ভারতের অধিকারকর্মী রোহিত সাভারওয়াল। সেই আবেদনের জবাব থেকেই বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য।

রোহিত বলেন, ‘কার কাছে আরটিআই আবেদন করব, সেই ব্যাপারে আমার ধারণা ছিল না। আমি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দপ্তর বরাবর পাঠিয়েছিলাম আবেদনটি। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর আবেদনটি পাঠিয়ে দেয় এএসআই দপ্তরে। সঠিক জবাব পেতে সরকারি এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তরে আবেদন পাঠানোর অনূমতি দেওয়া আছে আরটিআই আইনে।’ রোহিতের প্রশ্ন ছিল, ভারতের কর্তৃপক্ষ কোহিনূর হীরা যুক্তরাজ্যকে উপহার দিয়েছিল, না এর পেছনে অন্য কারণ ছিল।

জবাবে এএসআই বলেছে, লর্ড ডালহৌসি ও মহারাজা দুলিপ সিংহের মধ্যে ১৮৪৯ সালে লাহোর চুক্তি হয়। ওই চুক্তি অনূযায়ী লাহোরের মহারাজা ওই কোহিনূর হীরা ইংল্যান্ডের রানিকে দিতে বাধ্য হন। এই চুক্তির সারমর্মও এএসআইয়ের জবাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ওই চুক্তি অনূযায়ী কোহিনূর হীরা শাহ-সুজা-উল-মুলকের কাছ থেকে নেবেন মহারাজা রঞ্জিত সিংহ। তারপর সেটি ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে দিতে বাধ্য থাকবেন লাহোরের মহারাজা।

এএসআই আরও জানিয়েছে, ওই চুক্তি থেকে দেখা যাচ্ছে, দুলিপ সিংহ ইচ্ছাকৃতভাবে কোহিনূর হীরা যুক্তরাজ্যকে দেননি। এএসআইয়ের এই বক্তব্যকে সমর্থন দিয়েছেন মহারাজা দুলিপ সিংহ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ও কবি গুরুভজন সিংহ গিল। গুরুভজন বলেছেন, তিনি এ কথাটাই দীর্ঘদিন ধরে বলার চেষ্টা করছেন।

রোহিত বলেন, ‘ আমি যুক্তরাজ্যের একজন নাগরিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম, যিনি আমাকে বলেছিলেন, কোহিনূর রানিকে উপহার দেওয়া হয়েছে। তখন থেকে আমি এই বিষয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করতে শুরু করি।’

রানীর মুকুটে যেভাবে কোহিনূর
কোহিনূর নামে খ্যাত হীরক খন্ডের ইতিহাস অতি দীর্ঘ এবং বর্ণাঢ্য। কোহিনূর শব্দটি মূলত ফারসি শব্দ কোহ-ই-নূর থেকে এসেছে। যার অর্থ পর্বতের আলো। এর ইতিহাসের সূচনা ১৩০৪ খ্রিস্টাব্দে। প্রাচীনকালের সুন্দরী কুমারীর মতো এটিও বিভিন্ন রাজা বাদশাহ ও শাসকের হাত ঘুরে এখন স্থান পেয়েছে টাওয়ার অফ লন্ডনে। এটি ডিম্বাকৃতির শ্বেত হীরা।

বর্তমান ওজন ১০৫ ক্যারেট (২১.৬ গ্রাম) বা ৩১৯ রতি। প্রাথমিকভাবে ওজন ছিল ৭৫৬ ক্যারেট। শাহজাহানের রাজদরবারে কোহিনূরের ওজন পরীক্ষা করা হয়। ফরাসি রত্ন ব্যবসায়ী তাভারনিয়ার যাচাই করে দেখেন, তার ওজন ২৬৮ ক্যারেটের সামান্য বেশি। ভেনিসের হীরক কর্তনকারী হরটেনসিও জর্জিস প্রথম অদক্ষ হাতে এ হীরা কেটে ফেলেন। এত বড় সর্বনাশ করায় সম্রাট শাহজাহান তাকে ১০ হাজার রুপি জরিমানা করেন। কোহিনূর কখনো ক্রয়-বিক্রয় করা হয়নি। এতে ৩৩টি পার্শ্ব রয়েছে। বিভিন্ন সময় হীরাটি হিন্দু, পারসি, মুঘল, তুর্কি, আফগান, শিখ এবং ব্রিটিশ শাসকদের অধিকারে ছিল।

স্যার ওলফের মতে, কোহিনূর মুঘলদের অধিকারে ছিল ২১৩ বছর, আফগানদের অধিকারে ছিল ৬৬ বছর এবং ২০১১ সাল নাগাদ ব্রিটেনের অধিকারে ১২৭ বছর। ঐতিহাসিক দলিল মতে, অন্ধ্র প্রদেশের হায়দরাবাদের গোলকোন্দা রাজ্যে প্রথম কোহিনূর দেখা যায় । আর এটাই পৃথিবীর প্রথম হীরা উৎপাদনকারী এলাকা । দক্ষিণ ভারতীয় লোককথায় কোহিনূর হীরা নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে ।

লোককথা অনূযায়ী এটা বর্তমানে অন্ধ্রপদেশের একটি জেলার খনিতে পাওয়া গিয়েছিল। গিয়াস উদ্দিন তুঘলকের সময় ১৩২৩ সালের এক যুদ্ধে তার সৈন্যরা প্রচুর পরিমাণে সোনা-দানা, হীরা-জহরত নিয়ে দিল্লিতে ফিরে আসেন। তখনিই হীরাটি দিল্লির শাসকদের হাতে আসে। ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে হীরাটি আতবদল হতে হতে শেষ পযন্ত তা সম্রাট বাবরের হাতে পড়ে। তিনি এ হীরার মূল্য নির্ধারণ করেন।

এ হীরার দামে সারা পৃথিবীর মানূষকে দু’দিন খাওয়ানো যাবে বলে তিনি তার বাবরনামায় উল্লেখ করেন। এরপর অনেক সম্রাটের হাত ঘুরে সম্রাট শাহজাহান এ হীরার গর্বিত মালিক হন। যিনি আজ তাজমহল ও ময়ূর সিংহাসনের জন্য সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত। সম্রাট শাহজাহান হীরাটি তার বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসনে যুক্ত করেছিলেন।

১৭৩৯ সালে ইরানের সম্রাট নাদের শাহ আগ্রা ও দিল্লির দখলের পর সেখান থেকে প্রচুর ধন-সম্পদের সঙ্গে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হীরাখচিত ময়ূর সিংহাসনটিও নিয়ে যান । এর আগে হীরাটির কোনো নাম ছিল না। কারণ ১৭৩৯ সালের আগে এই কোহিনূর নামের কোনো সূত্রও পাওয়া যায় না।

কোহিনূর সম্পর্কে লোকমুখে চমৎকার একটি গল্প চালু আছে। এর মূল্যমান নির্ধারণ করতে গিয়ে নাদির শাহ বলেছিলেন, যদি একজন শক্তিমান মানূষ পাঁচটি পাথর পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ ও শূণ্যে ছুড়ে মারে এবং ওই শূন্যস্থান যদি সোনার মতো মূল্যবান ধনরত্নে পরিণত করা হয় তাহলে তার যে দাম হবে, ওই কোহিনূরটির দাম তার সমান । আততায়ীর হাতে নাদির শাহর মৃত্যু হলে ১৭৪৭ সালে এই কোহিনূর আফগানিস্তানের সুলতান আহমেদ শাহ আবদালির হাতে আসে।

তারপর শাহ সুজার হাত ঘুরে পাঞ্জাবের রঞ্জিত সিংহ এবং শেষ পযন্ত আসে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে কোহিনূরও নিয়ে যায় তাদের দেশে । পরবর্তী সময়ে তা স্থান পায় ব্রিটেনের রানীর মুকুটে। এরপর ১৮টি টুকরো করে সবচেয়ে বড় টুকরোটি লাগানো হয় রানীর মুকুটে। প্রথম এটা ব্যবহার করেন কুইন আলেকজান্দ্রা । তারপর কুইন মেরি । আর ১৯৩৬ সালে এটি রাজা ষষ্ঠ জর্জের স্ত্রী রানী এলিজাবেথের মুকুটে স্থান পায় ।

কোহিনূরই ভারতের একমাত্র সর্বশ্রেষ্ঠ হীরা নয়
ইতিহাস ঘেঁটে কোহিনূরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অন্তত আরো দুটি হীরকখ্লের প্রমাণ পাওয়া যায়। একটি হলো দরিয়া-ই-নূর (আলোর সাগর), এবং অপরটি “ গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড” হিসেবে পরিচিত অরলভ হীরা। ১৭৩৯ সালে ইরানী শাসক নাদির শাহের লুটের অংশ হিসেবে তিনটি হীরাই ভারতবর্ষ ত্যাগ করেছিল। কেবল উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে যখন কোহিনূর পুনরায় পাঞ্জাবে ফিরেছিল, তখন থেকেই এটি সর্বশ্রেষ্ট হীরার তকমা পেতে শুরু করে, এবং এটি নিয়ে উচ্ছ্বাস শুরু হয়।

কোহিনূর নিখুঁত কোনো হীরকখণ্ড ছিলো না
অনেকেই মনে করে থাকেন, প্রকৃত কোহিনূর হয়তো একদম নিখুঁত ছিল। কিন্তু আদতে তা সত্য নয়। এর উপর অনেকগুলো হলুদ রঙের দাগ ছিল। কয়েকটি দাগ তো এত বড় ছিল যে, সেগুলোর কারণে হীরাটি ঠিকভাবে আলো প্রতিফলনের ক্ষমতাই হারিয়েছিল।

এ কারণেই রানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী, যুবরাজ আলবার্ট এত বেশি আগ্রহী ছিলেন হীরাটিকে নতুন করে কাটানোর জন্য। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোহিনূর বিশ্বের সবচেয়ে বড় হীরা তো নয়ই, এমনকি বৃহত্তম হীরার ধারেকাছেও নেই এটি। এর অবস্থান মাত্র ৯০তম। এ কারণেই টাওয়ার অফ লন্ডনে এর আকৃতি দেখে অনেক দর্শনার্থীই বেজায় অবাক হন। কেননা ঠিক পাশেই রাখা দুটি কালিনান হীরার সাথে তুলনা করলে কোহিনূরকে সত্যিই অনেক ক্ষুদ্রাকৃতির বলে মনে হয়।

কোহিনূর যে পুরুষ পড়েছে সেই ক্ষমতা হারিয়েছে
কোহিনূর নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশে অনেক রক্তপাত হয়েছে বলে অনেকেই হীরাটিকে অভিশপ্ত হীরা বলে মন্তব্য করেন । এর স্বত্ব দাবি করে অনেক দেশই ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন করেছিল । ১৯৭৬ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে কোহিনূরটি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য অনূরোধ করেছিলেন । কিন্তু তিনি ভদ্রভাবে তাকে না করে দিয়েছিলেন।

এরপর ভারত ও আফগানিস্তানও এর স্বত্ব দাবি করেছিল । হীরার অভিশাপগুলোর মূলে রয়েছে ইতিহাস। যে এই হীরা পেয়েছে সেই হারিয়েছে জীবন, সাম্রাজ্য। কোহিনূর হীরা নিয়ে কথিত আছে, এটিও কোনো হিন্দু দেবীর মন্দিরে খচিত ছিল। সম্রাট বাবরের স্বত্বাধিকারী ছিলেন। সিংহাসন থেকে বারংবার বিচ্যুত হয়েছেন তিনি। এরপর ছিল সম্রাট শাহজাহানের কাছে। ময়ূর সিংহাসনে বসিয়েছিলেন তিনি হীরাটি। ছেলে আওরঙ্গজেবের হাতে সিংহাসনচ্যুত হন তিনি। ভিয়েতনামে হীরাটি কেটে ছোট করা হয়।

এরপর অনেক শাসকের কাছে যায় হীরাটি এবং প্রত্যেকেরই পরিণতি হয় করুণ। সিংহাসন নিয়ে রক্তারক্তি, খুন হয় প্রায় সব রাজ পরিবারেই। ব্রিটিশ যে রাজাই এটা পরেছেন তারা সবাই তাদের ক্ষমতা হারিয়েছেন। তাই অবশেষে এর স্থান হয় রানী এলিজাবেথের মুকুটে। ১৮৬ ক্যারেটের হীরাটি এখন মুকুটের অংশ হিসেবে লন্ডন টাওয়ারে প্রদর্শিত হচ্ছে নিয়মিত। এই অভিশাপের ঘটনা তারপর থেকেই বাজারে ছড়িয়ে পড়ে কোহিনূর নিয়ে।

কোহিনূর নিয়ে যেভাবে ছড়ায় গল্পের ডালপালা
২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে উইলিয়াম ডালরিম্পল ও অনীতা আনন্দ রচিত “ কোহিনূর: দ্য স্টোরি অভ দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ইনফেমাস ডায়মন্ড” নামক বইটি। বইটি থেকে জানতে পারি, ১৮৪৯ সালে কোহিনূর যখন তৎকালীন ভারতের গভর্ণর- জেনারেল লর্ড ডালহৌসির হাতে আসে, তখন তিনি প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেন রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে সেটি পাঠানোর। কিন্তু কেবল হীরাটি পাঠালেই হবে কেন! সেটি যে ঠিক কতটা মূল্যবান, তা-ও তো রানীর সামনে তুলে ধরতে হবে।

তাই লর্ড ডালহৌসি ঠিক করলেন, রত্নটির সাথে এর একটি আনূষ্ঠানিক ইতিহাসও প্রেরণ করবেন তিনি। সেই লক্ষ্য অনূযায়ী তিনি নিয়োগ দেন দিল্লির একজন জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট, থিও মেটক্যাফকে। মেটক্যাফের কাজ ছিল কোহিনূরের ইতিহাসের উপর গবেষণা করা, এবং সেই গবেষণার উপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা। কিন্তু তিনি খুব একটা সুবিধে করতে পারেননি।

ইতিমধ্যেই বাজারে কোহিনূর সম্পর্কে যেসব অতিকথন প্রচলিত ছিল, সেগুলোরই পুনরুল্লেখ করেন তিনি তার প্রতিবেদনে। অথচ তার সেই প্রতিবেদনটিকেই রেফারেন্স হিসেবে ধরে এরপর থেকে হাজার হাজার নতুন আর্টিকেল ও বই প্রকাশিত হয়েছে, নির্মিত হয়েছে বহু তথ্যচিত্রও। এভাবেই কোনো একসময়ে কোহিনূর বিষয়ক যেসব তথ্য ছিল নিছকই মনগড়া, শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশে সৃষ্ট, সেগুলোই পরবর্তীতে বিবেচিত হতে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে।

ডালরিম্পল ও আনন্দের লক্ষ্য ছিল, অতিরঞ্জনগুলোকে ছেঁকে সেখান থেকে বাস্তব সত্যগুলোকে বের করে নিয়ে আসা। এবং সেই কাজটি তারা বেশ সফলভাবেই করতে পেরেছেন বলে রায় দিয়েছেন অনেক সমালোচক। বর্তমানে কোহিনূরের প্রকৃত ইতিহাস জানতে অনেকেই নির্ভর করছেন এই বইটির উপরই।

কোহিনূর ‘ গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড’ নয়
ফরাসি রত্নবণিক ও পর্যটক জন-ব্যাপ্টিস্ট ট্যাভারনিয়ার মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে অনূমতি পেয়েছিলেন তার ব্যক্তিগত রত্নালঙ্কারের সংগ্রহশালা পরিদর্শনের। তার ভাষ্যমতে, সম্রাটের ভাস্কর হোর্তেনসিও বোর্গিও খুব বড় আকারের একটি হীরাকে ভুলবশত কেটে ফেলেছিলেন।

এর ফলে হীরাটির আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়। ট্যাভারনিয়ার ওই হীরাটিকে চিহ্নিত করেছিলেন “ গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড” হিসেবে, যেটি শাহজাহান উপহার পেয়েছিলেন হীরক-বণিক মীর জুমলার কাছ থেকে। একটা সময় পর্যন্ত অনেকেই বিশ্বাস করত, ‘গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড’ই হয়তো কোহিনূর। কিন্তু বর্তমান সময়ের অনেক পন্ডিত ঐক্যমতে পৌঁছেছেন যে, সেটি ছিল আসলে অরলভ হীরা, যা বর্তমানে মস্কোর ক্রেমলিন জাদুঘরের শোভাবর্ধন করছে।