মাকে গুলি করে হত্যাকারী মাঈনু গ্রেফতার

মাকে গুলি করে হত্যাকারী মাঈনু গ্রেফতার
মাকে গুলি করে হত্যাকারী মাঈনু গ্রেফতার

বিশেষ প্রতিবেদক ।। 

মাকে গুলি করে হত্যাকারী মোহাম্মদ মাঈনুকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। এ সময় হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রটিও উদ্ধার করা হয়। বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র‍্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এম এ ইউসুফ।

তিনি বলেন, মাঈনুল ছোট থেকে খুবই উচ্ছৃঙ্খল ছিল। উচ্ছৃঙ্খলতার কারনে তার সদ্য প্রয়াত বাবা জাতীয় পার্টির (এরশাদ) নেতা ও পটিয়া পৌরসভার সাবেক প্রথম মেয়র মাস্টার শামসুল আলম উত্তরাধিকার হিসেবে ছেলে মাইনুলের নামে তেমন কোন টাকা পয়সা ব্যাংকে রাখেনি। রাখেনি জমি-জমাও। যা রেখেছেন তার মা ও বোনের নামে। সেই থেকে ক্রমেই তার ক্ষোভ জমে।

শুধু তাই নয়, এ কারণে মাঈনুল উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার পর বিবিএ পড়ার জন্য চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার ইউনির্ভার্সিাটতে ভর্তি হলেও তেমন লেখাপড়া করেনি। বরং ক্ষোভ থেকে সে নেশা করত। ইয়াবা গাঁজা সেবন করত। এসব বিষয়ে পারিবারিক শাসনও তেমন ছিল না। ফলে পারিবারিক অবক্ষয় ঘটে তার। এই অবক্ষয় থেকে মাকে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটালো সে।

র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, ছাত্রজীবন থেকে নানা অপরাধে লিপ্ত ছিল মাঈনুল। এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে অস্ত্রসহ ৪টি মামলার সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে তার বোন শায়লা শারমিন নিপা বলছে তার বিরুদ্ধে ১২-১৩টি মামলা রয়েছে। এরমধ্যে ৪টি অস্ত্র মামলা রয়েছে।

এম এ ইউসুফ বলেন, গুলি করে মাকে হত্যার বিষয়টি চট্টগ্রামের মানুষকে নাড়া দিয়েছে। আমরাও চুপ থাকতে পারিনি। মাকে গুলি করে ছেলে পালিয়ে যাবে তা কখনো হতে পারে না। এ কারণে আমরা গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করি।

আমাদের গোয়েন্দা তথ্যমতে, ঘটনার পর মাঈনুল তার মাকে যে অস্ত্র দিয়ে গুলি করে। সে অস্ত্র নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পটিয়া হয়ে প্রথমে দোহাজারী চলে যায়। সেখানে এক বড় ভাইয়ের আশ্রয়ে অফিসে রাত কাটায়। সেখান থেকে পরের দিন বুধবার (১৭ আগস্ট) ঢাকা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ জন্য সে নগরীর একটি বাস স্টেশন থেকে একটি বাসের সুপারভাইজারের সাথে কন্টাক্ট করে গাড়িতে উঠে বসে। এ খবর পেয়ে বাস থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারের পর তার কোমর থেকে সে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এ সময়ও তাকে বেশ উচ্ছৃঙ্খল দেখা যায়। মাকে হত্যা করার কোন রকম অনুশোচনা তার মধ্যে আমরা দেখতে পায়নি। আপনারাও (সাংবাদিকরা) চাইলে কথা বলে দেখতে পারেন। সে যা করেছে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মেজাজে করেছে। আমরা তাকে ধরে আইনের হাতে সোপর্দ করছি, এটাই আমাদের সান্তনা।

সেদিন যা ঘটেছিল :
মাকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী মাঈনুলের বোন শায়লা শারমীন নিপা। ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তির প্রতি মাঈনুলের স্ত্রী আসিফা সুলতানার লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। পিতার সম্পত্তি এককভাবে ভোগ করার জন্য মাঈনুলের স্ত্রী প্রায় সময় মাইনুলকে কুপরামর্শ দিয়ে আসছিলেন।

ব্র্যাক ব্যাংক পটিয়া শাখায় বাবার একাউন্টে ১৩ লাখ টাকা ছিল। সেখানে আমি নমিনি। জনতা ব্যাংক পটিয়া শাখায় আরেকটি একাউন্টে ছিল ৩ লাখ টাকা। ওই একাউন্টের নমিনি মা। এসব টাকা তোলার জন্য গত মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে শায়লা শারমীন নিপা ও মা জেসমিন আকতার ব্যাংকে যান। কিন্তু ব্যাংক থেকে টাকা তোলার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় পৌনে ১টার দিকে আমরা বাসায় ফিরে আসি। বাসায় পৌঁছানোর পর দুপুর দেড়টার দিকে ক্ষুব্ধ অবস্থায় বাড়িতে আসে মাঈনুল। এরপর তাকে না বলে ব্যাংকে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করে।

এক পর্যায়ে মাঈনুল কোমরে থাকা পিস্তল বের করে আমাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। গুলি লক্ষভ্রষ্ট হলে আমি বেঁচে যাই। পরবর্তীতে মাকে সামনে পেয়ে গুলি চালায়। মা গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে। ঘটনার পর মাঈনুল পালিয়ে যায়। মঙ্গলবার রাতেই বাদী হয়ে আমি মাঈনুলের বিরুদ্ধে পটিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করি।

অস্ত্রটি ছিল তার মৃত বাবার:

র‌্যাব এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মো. নুরুল আবছার জানান, মাকে গুলি করা অস্ত্রটি ছিল তার বাবা শামসু মাস্টারের লাইসেন্স করা। বাবার মৃত্যুর পর অস্ত্রটি বাড়ির ড্রয়ারে খুঁজে পান মাঈনুল। সেই অস্ত্রের অনুসন্ধান করতে গিয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ১০ রাউন্ড কার্তুজ ও ১টি এয়ারগান, ব্যবহৃত ও অব্যহৃত দুটি গুলি উদ্ধার করে। এমনকি দক্ষিণ জেলা জাপার কার্যালয়ে তল্লাশি করলে সেখানেও মিলেছে অবৈধ আরেকটি পিস্তল। তবে ওই পিস্তলটি খুনের ঘটনায় ব্যবহার করা হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন পটিয়া থানার ওসি (তদন্ত) রাশেদুল ইসলাম।

ঘটনার নেপথ্যে বোনের বাড়াবাড়ি:

ব্যাপক অনুসন্ধানের পর আমাদের পটিয়া প্রতিনিধি মোরশেদ আলমের পাঠানো প্রতিবেদনে জানানো হয়, চলতি বছরের জুন মাসে বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামের মেয়ে আসিফা সুলতানাকে বিয়ে করে মাঈনুল। শুরুতে পরিবারের সম্মতি ছিল না তাতে। পরে মা মেনে নিলেও বোন নিপা আসিফাকে মেনে নিতে পারেনি।

মাঈনুলের বোন শায়লা শারমিন নিপা তার ছোট ভাই মাশফিকুল আলম মাশফিকে নিয়ে তার স্বামীসহ অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করেন। তার মাও কয়েক বছর ধরে তাদের সাথে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করে আসছিল। দীর্ঘদিন করোনার কারনে দেশে আসতে চেয়ে পারেনি। চলতি বছর করোনার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ঈদের সময় তার মা ভাই, বোন দেশে আসে। এরপর গত ১৩ জুলাই শামসুল আলম মাস্টার মারা যায়। এ কারনে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও যাওয়া হয়নি তাদের।

সেপ্টেম্বরে প্রয়াত শামসুল আলম মাস্টারের চল্লিশা শেষে ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু ছেলে মাঈনুল তার পিতার মৃত্যুর পর তার মা জেসমিন আক্তারকে তার সাথে দেশে রেখে দেওয়ার জন্য তার বোনের কাছে জোর দাবি জানিয়ে আসছিল। এরমধ্যে তার মা জেসমিন আক্তার ও তার বোন নিপা তার বাবার রেখে যাওয়া সকল সম্পত্তি গুছিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেটা জানতে পেরে মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) দুপুর একটার দিকে মাঈনুল বাসায় গিয়ে তার মাকে জিজ্ঞেস করছিলেন তিনি দেশে আর থাকবেন না কেন। সে কথা জিজ্ঞেস করতেই বোন তেঁড়ে আসে ভাইয়ের দিকে। নিপা বলে সেটা আমাদের ব্যাপার, আমরা থাকব কি না।

বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে বোন নিপা বলে- সে কোনো সম্পত্তি পাবে না। তার বাবা সব তার মা আর ছোট ভাই মাসফির নামে উইল করে রেখে গেছেন। তারা সব গুছিয়ে নিয়েছে। একথা বলতেই শুরু হয়ে যায় বোনের সাথে বাকবিতণ্ডা। ঘটনার এক পর্যায়ে বোনকে রেগে মারতে যায় মাঈনুল। বোন ও তার দিকে রেগে দৌড়ে যায়। একপর্যায়ে মাঈনুল রাগ সহ্য করতে না পেরে তার বোনকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে।

যেমন ছিলেন শামসুল আলম মাস্টার :

চট্টগ্রামের রাজনীতিতে শামসুল আলম মাস্টার একটি অনন্য নাম। ব্যাপক পরিচিত জাতীয় পার্টির এ নেতার নাম উচ্চারিত হয় পটিয়াবাসীর মুখে মুখে। তার হাত ধরে পটিয়া পৌরসভায় হয়েছে অনেক নতুন রাস্তাঘাট ও নানা স্থাপনা। পটিয়ার যেকোন সমস্যা সমাধানে তিনি ছিলেন অগ্রসৈনিক।

তার পরিবারের প্রতি পটিয়াবাসীর রয়েছে অগাধ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। কিন্তু গত মঙ্গলবার সেই শামসু মাস্টারের পুত্র মাঈনুল বাবার রেখে যাওয়া টাকার জন্য মা জেসমিন আক্তারকে গুলি করে হত্যা করেন। এতে হঠাৎ যেন অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো আলোকিত পরিবারটি। চেনা পরিবারটিতে সংঘটিত এ ঘটনাকে হঠাৎ অচেনা কাহিনী বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

স্থানীয়রা জানান, বাবা শামসু মাস্টারের দেখানো আলোকিত পথে হাটেনি পুত্র মাঈনুল। তার বিচরণ ছিলো অন্ধকার জগতে। তারা জানান, পটিয়ার মানুষের সঙ্গে শামসু মাস্টারের সম্পর্ক ছিলো মধুর। পটিয়ার সর্বস্তরের মানুষ তাকে ভালোবাসতেন। তিনি পটিয়া পৌরসভার সৃষ্টির পর ১৯৯৩ সালে প্রথম নির্বাচনে ও ১৯৯৭ সালে দ্বিতীয় নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;