প্রশাসনের ব্যস্ততায় চলছে পাহাড় দখলের মহোৎসব, কয়েকদিনে পাঁচ শতাধিক ঘর নির্মাণ

প্রশাসনের ব্যস্ততায় চলছে পাহাড় দখলের মহোৎসব, কয়েকদিনে পাঁচ শতাধিক ঘর নির্মাণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।

প্রাণঘাতী করোনাকালে প্রশাসনের ব্যস্ততায় পাহাড় দখলের মহোৎসব চলছে। ফৌজদারহাট বায়েজিদ সড়কের দুই ধারে চট্টগ্রাম মহানগরী, সীতাকুণ্ড ও হাটহাজারী উপজেলার পাহাড়গুলো কেটে কেটে ঘর তৈরি করা হচ্ছে। বাড়ি-ঘরের পাশাপাশি মসজিদ, মাদ্রাসা এবং মাজারের নাম করেও তৈরি করা হচ্ছে স্থাপনা। পাকা দালানও নির্মাণ করা হচ্ছে। মাত্র দিনকয়েকের মধ্যে নগরীর উত্তর পাহাড়তলী, সীতাকুণ্ডের জঙ্গল ছলিমপুর এবং হাটহাজারীর জালালাবাদ এলাকায় পাহাড় কেটে পাঁচ শতাধিক নতুন ঘর গড়ে তোলা হয়েছে। কোথাও কোথাও পাহাড় ঝরে ঝরে পড়ছে। এমনকি কাটা পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ পাদদেশেই তৈরি করা হয়েছে ঘর। সংঘবদ্ধ একটি চক্র এসব ঘর-বাড়ি তুলে দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এবং পরিবেশ অধিদপ্তর বিষয়টি জানার কথা স্বীকার করে বলেছে, করোনাযুদ্ধের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে এসব করা হচ্ছে। সমন্বিতভাবে অভিযান চালিয়ে এদের উচ্ছেদ করা হবে।

সূত্র জানিয়েছে, নগরীর উপকণ্ঠে নান্দনিক পাহাড়ি এলাকাটি দীর্ঘদিন ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। ফৌজদারহাট থেকে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী পর্যন্ত চার লেনের বাইপাস সড়কটি নির্মাণের কার্যক্রম শুরুর পরই এলাকাটি মানুষের চোখে পড়ে। ফৌজদারহাট-বায়েজিদ সড়কটি নগরীর উত্তর পাহাড়তলী, সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুর এবং হাটহাজারীর জালালাবাদ মৌজায় অবস্থিত। বাইপাস সড়কটি নির্মাণের পরই এলাকাটিতে ভূমিদস্যুদের অপতৎপরতা শুরু হয়। গত কয়েকবছর ধরে এই এলাকায় শত শত একর ভূমি অবৈধ দখলদারদের খপ্পরে চলে গেছে। ইতোমধ্যে কয়েক হাজার বাড়ি-ঘর নির্মিত হয়েছে জঙ্গল সলিমপুরসহ আশপাশের পাহাড়ি এলাকায়। একই স্থানে এশিয়ান উইম্যান ইউনিভার্সিটি স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হলে ভূমি দস্যুদের তৎপরতা আরো বেড়ে যায়। ফৌজদারহাট বায়েজিদ বাইপাস সড়কটি চালুর সময় যত ঘনিয়ে আসছে এলাকাটিতে যেন দখলদারিত্ব কায়েমের অপতৎপরতা আরো বাড়তে শুরু করেছে। গত কয়েক বছর ধরে ওই এলাকার ভূমির দখলদারিত্ব বিক্রি করে সংঘবদ্ধ চক্র কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

সূত্র বলেছে, ধীরে ধীরে ওই এলাকায় কিছু কিছু বাড়ি-ঘর নির্মাণ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙেছে। করোনাকালে প্রশাসনের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে সংঘবদ্ধ চক্র উক্ত তিনটি এলাকায় পাঁচ শতাধিক ঘর নির্মাণ করেছে। এসব ঘর নির্মাণের সময় সংঘবদ্ধ চক্রটি অনেকগুলো পাহাড় এবং টিলা কেটে সাবাড় করে দিয়েছে।

সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, পুরো এলাকাটিতে হাজার হাজার বাড়ি-ঘর তৈরি হয়েছে। পাহাড় কাটার মহোৎসবও চলছে চরমভাবে। কোনো কোনো পাহাড় কেটে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। কোনো কোনোটি আবার কেটে ঢালু করে ফেলা হয়েছে। পুরো পাহাড় ধসে ধসে পড়ছে। পাহাড় রক্ষায় ঠেসও দেয়া হয়েছে। এর নিচে আবার ঘর তৈরি করা হয়েছে।

সম্প্রতি কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট সিডিএ লিংক রোডের দু’ধারের পাহাড়ি এলাকা পরিদর্শন করতে যান। নিজের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সাথে আলাপকালে জানান, আমরা যখন সেখানে পৌঁছি তখন পাহাড় কেটে তৈরি করা ভূমিতে পাকা ঘর নির্মাণ করা হচ্ছিল। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে নির্মাণ কাজের সাথে জড়িতরা পাহাড়ের ঢালু দিয়ে জঙ্গলের ভিতরে চলে যায়। আমরা বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী জব্দ করি। জঙ্গল ছলিমপুরের জনৈক মনির নামের একজন ঠিকাদার ঘর তৈরির কাজের সাথে জড়িত বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, করোনাকালে জেলা প্রশাসন, ভূমি অফিস এবং থানা-পুলিশের ব্যস্ততার সুযোগে ১৫ টির মতো টিলা এবং বেশ কিছু পাহাড় কেটে পাঁচ শতাধিক ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এশিয়ান উইম্যান ইউনিভার্সিটি সংলগ্ন সীতাকুণ্ডের জঙ্গল ছলিমপুর এবং হাটহাজারী উপজেলাধীন জালালাবাদ মৌজায়ও পাহাড় কাটার মহোৎসব চলছে। গত কয়েকদিনে এসব এলাকায়ও অসংখ্য বাড়ি-ঘর তৈরি করা হয়েছে। ভর বর্ষা মৌসুমে এসব পাহাড় ধসে বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টিরও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।

সরজমিনে অনুসন্ধানকালে দেখা যায়, পাহাড় কেটে শুধু ঘরই নয়, ধর্মীয়ভাবে সুবিধা নিতে অনেক মাজারের নাম ব্যবহার করে ভুয়া দরগা, মাদ্রাসা এবং মসজিদও বানিয়েছে ভূমিদস্যুরা। সামনের দিকে মসজিদ মাদ্রাসা হলেও ভিতরের দিকে পরিবার পরিজন নিয়ে দখলকারীরা বসবাস করছে। পথে পথে বহু মসজিদ এবং মাজারের ব্যানার টানিয়েও দখলদারিত্ব চালানো হচ্ছে।

কাট্টলী সার্কেল ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সংঘবদ্ধ চক্রটি ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে সুবিধা নিতে পাহাড় কেটে ভূমি দখল করছে বলে সরজমিন অভিযানের সময় প্রমাণ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

গতকাল সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘উক্ত এলাকায় পাহাড় কাটা এবং অবৈধভাবে ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। সরজমিনে অভিযান চালিয়ে দেখেও এসেছি। বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তরকেও জানানো হয়েছে। সম্মিলিতভাবে বিশেষ এ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করে অভিযান চালানোর প্রক্রিয়া চলছে বলেও তিনি জানান।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক (চট্টগ্রাম অঞ্চল) মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোছাইনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমরা জেনেছি। আমাদের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে সংঘবদ্ধ একটি চক্র নানাভাবে অপতৎপরতা চালাচ্ছে। জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ সমন্বিতভাবে একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নেয়া হবে। পাহাড়ের উপর যারা অত্যাচার চালাচ্ছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে ।