চিকিৎসকদের প্রশ্ন ফাঁস বাণিজ্য , তাদের কারণে ঝরে গেছে অনেক মেধাবী

চিকিৎসকদের প্রশ্ন ফাঁস বাণিজ্য , তাদের কারণে ঝরে গেছে অনেক মেধাবী
চিকিৎসকদের প্রশ্ন ফাঁস বাণিজ্য , তাদের কারণে ঝরে গেছে অনেক মেধাবী

বিশেষ প্রতিবেদক ।।

অল্প সময়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হতে নিজে চিকিৎসক হলেও চিকিৎসায় মন না দিয়ে একসময় খোঁজে নেন মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস জগতের। অল্প সময়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হতে নিজেই চালু করেন মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টার। ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে তার কোচিং সেন্টারের নাম ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে আরও অনেককে যুক্ত করে দল ভারী করেন। এভাবে চিকিৎসক থেকে হয়ে ওঠেন অপরাধী। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে চিকিৎসক হয়েছেন অনেকে। তাদের কারণে ঝরে গেছে অনেক মেধাবী ।

সম্প্রতি মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সাত চিকিৎসকসহ ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধী তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এরপরই প্রকাশ পায় এমন ভয়াবহ তথ্য। গত ১৬ বছর ধরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর কাছে প্রশ্ন ফাঁস করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন চক্রটি। সিআইডি জানায়, গ্রেফতারকৃতরা হলেন-চক্রের হোতা ডা. ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান (৫০), ডা. সোহেলী জামান (৪০), ডাক্তার মোহাম্মদ আবু রায়হান, ডা. জেডএম সালেহীন শোভন (৪৮), ডা. মো. জোবায়দুর রহমান জনি (৩৮), ডা. জিল্লুর হাসান রনি (৩৭), ডা. ইমরুল কায়েস হিমেল (৩২), জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার (৬৮), রওশন আলী হিমু (৪৫), আখতারুজ্জামান তুষার (৪৩), জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পি (৪৫) ও আবদুল কুদ্দুস সরকার (৬৩)।

এ সময় তাদের কাছ থেকে ১৯টি মোবাইল ফোন, ৪টি ল্যাপটপ, বিভিন্ন ব্যাংকের চেকবই, ব্যাংক কার্ড, ভর্তির অ্যাডমিট কার্ড নগদ ২ লাখ ১১ হাজার টাকা, থাইল্যান্ডের মুদ্রা ১৫ হাজার ১০০ বাথ উদ্ধার করা হয়েছে। চক্রের পাঁচ চিকিৎসক জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তারা ২০০১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে দশবার প্রশ্ন ফাঁস করে। তাদেরকে শিক্ষা খাতের ‘ক্যানসার’ হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেছে সিআইডি।

গতকাল রোববার দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির সদর দফতরের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী বলেন, চিকিৎসক ময়েজ উদ্দিন প্রশ্ন ফাঁস চক্রের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড। মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে জড়িয়ে পড়েন প্রশ্ন ফাঁসে। নিজেই ‘ফেইম’ নামের একটি কোচিং সেন্টার চালু করে শুরু করেন প্রশ্ন ফাঁস। গত ২০ বছর এভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন।

সিআইডি প্রধান বলেন, ময়েজ আগে ছাত্রশিবিরের রাজনীতি করতেন। বর্তমানে জামায়াতের চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে দুটি মানি লন্ডারিং মামলা রয়েছে। এ ছাড়া গ্রেফতার সালেহীন শোভন, জোবায়দুর রহমান, জিল্লুর হাসান রনি ও জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী বর্তমানে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ও সাবেক ছাত্রদলের নেতাকর্মী। তারা সবাই ২০০৫ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হন। এরপর বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের আড়ালে প্রশ্ন ফাঁস করে আসছিলেন।

সিআইডি প্রধান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাসহ যেকোনো পাবলিক পরীক্ষা এলেই প্রশ্ন ফাঁস চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা নানা কায়দায় প্রশ্ন ফাঁস করত। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় মিরপুর মডেল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২০২০ সালে মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ভয়াবহ তথ্য পায় সিআইডি। শিক্ষা খাতের ক্যানসার হিসেবে বিবেচিত চক্রের অন্তত ৮০ জন সদস্য প্রায় ১৬ বছর ধরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর কাছে ফাঁস করা প্রশ্ন সরবরাহ করেছে। এভাবে শতকোটি টাকা আয় করেছে তারা, যা দেশে বিলাসবহুল জীবন ও বিদেশে পাচার করেছেন।

তিনি বলেন, ঢাকা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ ও বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে চক্রের ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে সাতজনই ডাক্তার। এদের প্রায় সবাই বিভিন্ন মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টার, নয়তো প্রাইভেট পড়ানোর আড়ালে প্রশ্ন ফাঁস করতেন। তাদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের দেওয়া বিপুল পরিমাণ ব্যাংকের চেক এবং অ্যাডমিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি মোবাইল ফোন, ৪টি ল্যাপটপ, বিভিন্ন ব্যাংকের চেকবই, ব্যাংক কার্ড, ভর্তির অ্যাডমিট কার্ড, ২ লাখ ১১ হাজার টাকা, থাইল্যান্ডের মুদ্রা ১৫ হাজার ১০০ বাথ রয়েছে। এগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এ ছাড়াও মাস্টারমাইন্ড জসীম উদ্দিন ভূঁইয়ার কাছ থেকে একটি গোপন ডায়রি উদ্ধার করা হয়, যেখানে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা চক্রের অন্য সদস্যদের নাম রয়েছে।

এদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে, যেগুলো মানি লন্ডারিং মামলায় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আটজন তাদের দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। প্রশ্ন পেয়ে মেডিকেলে ভর্তি হওয়া অনেকে ইতিমধ্যে ডাক্তারও হয়ে গেছেন। তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে কাজ চলছে বলে জানা যায়।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;