ঈদ ও আগস্টকে টার্গেট করে জঙ্গিদের ভয়ঙ্কর নাশকতার ছক

ঈদ ও আগস্টকে টার্গেট করে জঙ্গিদের ভয়ঙ্কর নাশকতার ছক

আলমগীর হোসেন ।।

কোরবানী ঈদ ও ঘটনাবহুল আগস্ট মাসকে টার্গেট করে বড় হামলা বা ভয়ঙ্কর নাশকতার ছক কষছে জঙ্গিরা। এই নাশকতার তৎপরতায় প্রথম সারিতেই আছে জঙ্গি সংগঠন জেএমবি বা নব্য জেএমবি, আনসার আল ইসলাম, আল্লাহর দল ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম অন্যতম। গোয়েন্দারা মনে করছেন, জঙ্গিরা প্রথমত জনসমাগমে হামলার মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারে। এতে ব্যর্থ হলে তারা একক টার্গেটেও হামলা চালাতে পারে। তবে হামলার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে প্রধানত টার্গেট করতে পারেÑ পুলিশ, যানবাহন, দূতাবাস বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, বিমানবন্দর ও বিভিন্ন ধরনের উপাসনালয়। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই জঙ্গিরা রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় কৌশলে বা ছদ্মবেশে অবস্থান নিয়ে আস্তানা গড়ার অপচেষ্টা করছে বলেও মনে করা  এ হচ্ছে। জানা যায়, জঙ্গি হামলার আশঙ্কা করে ২৬ জুলাই বাংলাদেশ পুলিশের সকল ইউনিটকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার। সেই নির্দেশনায় ইতোমধ্যেই জঙ্গিবিরোধী অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ভোররাতে ঢাকার ধামরাই ধলিভিটা বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের ৫ জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৪ ব্যাটালিয়ন।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনার কারণে অনেকটা ফাঁকা হয়ে যাওয়া রাজধানীতে সহজেই আস্তানা গড়ার সুযোগ পেতে পারে জঙ্গিরা। অনেক বাড়িমালিক ভাড়াটিয়া সংকটের কারণে কোনো যাচাই ছাড়াই যে কাউকে বাসা ভাড়া দিয়ে থাকতে পারেন। ফলে এ ব্যাপারে আরও বেশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। তবে জঙ্গিরা কোথাও কোনো নাশকতা বা অপতৎপরতা চালানোর চেষ্টা করলেই কঠোরভাবে দমন করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জঙ্গিবিরোধী অভিযানে প্রধান ভ‚মিকা রাখা এলিটফোর্স র‌্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আশিক বিল্লাহ।

জানা গেছে, ২৭ জুলাই ভোররাতে ঢাকার ধামরাই থানাধীন ধলিভিটা বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের ৫ জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৪ ব্যাটালিয়ন। র‌্যাব-৪-এর অপারেশন্স অফিসার এএসপি মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরী সময়ের আলোকে বলেন, গ্রেফতারকৃত জঙ্গিরা নাশকতার পরিকল্পনায় সংঘবদ্ধ হয়ে গোপন বৈঠকে বসেছিল। গোয়েন্দা তথ্যেরভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকালে তাদের কাছ থেকে জঙ্গিবাদী বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে।

জানা যায় এর আগে ১৯ জুলাই সাভারের ভাটপাড়া থেকে জেএমবির ৬ জঙ্গিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৪ ব্যাটালিয়ন। তারও আগে ২ জুলাই ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থেকে জঙ্গি সংগঠন ‘আল্লাহর দলের’ ঢাকা দক্ষিণের আমির মো. ফারুক শেখকে গ্রেফতার করে পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)। এ ছাড়া ২০ জুন রাজধানীর দক্ষিণখান থেকে গোপন তৎপরতাকালে জঙ্গি সংগঠন আল্লাহর দলের ৭ সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১ ব্যাটালিয়ন। এ রকম প্রায়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিষিদ্ধ গোষিত বিভিন্ন সংগঠনের জঙ্গিদের গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে।
এ প্রসঙ্গে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আশিক বিল্লাহ সময়ের আলোকে জানান, বাংলাদেশের জঙ্গিরা মোটেও শক্তিশালী অবস্থায় নেই। তারপরও এর আগে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের দিনেই জঙ্গি হামলা হয়েছিল। এ ছাড়া বর্তমানে বৈষিক প্রেক্ষাপটেও জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে গেছে। সে কারণে বর্তমান সময়টাতে আমরা জঙ্গি হামলার আশঙ্কা করছি। তবে সুনির্দৃষ্টভাবে জঙ্গি হামলার কোনো হুমকি নেই। র‌্যাবের এই মুখপাত্র বলেন, আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় র‌্যাব জঙ্গি মোকাবিলায় আরও বেশি সক্ষমতা অর্জন করেছে। যেখানেই তারা অপতৎপরতা চালানোর চেষ্টা করছে সেই কঠোরভাবে দমন করা হবে।
জানা যায়, বাংলাদেশে হত্যাকাÐ, নাশকতা ও ধ্বংসাত্মকমূলক কর্মকাÐের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আদলে গঠিত নব্য জেএমবির সদস্যরা। যারা গুলশানের হলি আর্টিজানের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। এ জন্য পুলিশের সব ইউনিটকে সতর্ক করে দেশব্যাপী কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদরদফতর।
জানা গেছেÑ জঙ্গিদের প্রধান টার্গেটে রয়েছে পুলিশ। এরপর রয়েছে যানবাহন ও ক‚টনৈতিক এলাকা। এসব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে। এ নির্দেশনার পরপরই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে বাড়ানো হয়েছে চেকপোস্ট তল্লাশি। ক‚টনৈতিক এলাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বাড়ানো হয়েছে টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি।

পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা সময়ের আলোকে বলেন, জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে পুলিশের সকল ইউনিটকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে জঙ্গিরা হামলার জন্য খুব বেশি শক্তিশালীও নয়। বিগত সময়ে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অভিযান তারা অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে। তবুও বৈষয়িক প্রেক্ষাপটসহ নানা কারণে জঙ্গিদের তৎপরতার সম্ভাব্য সবদিকে বাড়তি নজরদারি করছেন গোয়েন্দারা। পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী ইতোমধ্যেই জঙ্গিবিরোধী অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে।
জানা গেছেÑপুলিশ হেডকোয়ার্টারের ওই নির্দেশনার চিঠি অনুযায়ী পুলিশ (পুলিশের কোনো টিম, স্থাপনা বা যানবাহন) বিমানবন্দর, দূতাবাস ভবন বা দূতাবাস সংশ্লিষ্ট বিশেষ ব্যক্তি, শিয়া-আহমদিয়া উপাসনালয়, মাজার কেন্দ্রিক মসজিদ, চার্চ, প্যাগোডা, মন্দিরগুলোকে টার্গেট করা হতে পারে বলে। চিঠিতে হামলার সম্ভাব্য দিন-তারিখ উল্লেখ না থাকলেও গোয়েন্দারা যে ধারণা দিয়েছেন তাতেÑ হামলার সময় সকাল ৬ থেকে ৭টা অথবা সন্ধ্যা ৭ থেকে রাত ১০টায় হতে পারে। হামলাকারীর বয়স ১৫-৩০ বছরের মধ্যে হতে পারে। চেহারা ক্লিন শেভড দাড়ি থাকতে পারে, গোফহীন হতে পারে। পরনে শার্ট/টিশার্ট, প্যান্ট, ক্যাপ মাস্ক, কেডস এবং পেছনে ব্যাকপ্যাক থাকতে পারে। হামলার সময় হামলাকারী অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে।

দূতাবাস অধ্যুষিত রাজধানীর গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী সময়ের আলোকে বলেন, জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় গুলশানের ক‚টনৈতিক জোনসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কয়েকস্তরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারি করা হচ্ছে। টহল বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন পয়েন্টে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের মাধ্যমেও সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমানে সবকিছু মাথায় রেখে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাজানো হয়েছে। পশুরহাট, মার্কেট ও জনগণের চলাচলের ওপর বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে।

আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের এক সদস্য গ্রেফতার : নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের এক সদস্যকে গ্রেফতার করেছে অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)। তার নাম সবুজ শেখ। গত সোমবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার তারাব এলাকার সুলতানবাগ থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এটিইউর গণমাধ্যম শাখার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসলাম খান।

তিনি জানান, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গত সোমবার দুপুরে এটিইউর একটি দল আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সক্রিয় সদস্য সবুজকে গ্রেফতার করে। তার বাড়ি ফরিদপুরের শালথায়। তার কাছ থেকে জঙ্গি কর্মকাÐে ব্যবহৃত মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সবুজ নিজেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সক্রিয় সদস্য বলে স্বীকার করেছে। সবুজ শেখ অনলাইনে ‘সত্যের সন্ধানে’ নামের ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। সে ‘লোন উলফ মুজাহিদীন’ গ্রæপে জঙ্গিবাদী প্রচার-প্রচারণা, জননিরাপত্তা বিপন্ন করে ত্রাস সৃষ্টি ও জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। তার বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইন মামলা দায়ের করা হয়েছে।- দৈনিক সময়ের আলো ।