বঙ্গবন্ধু কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন

বঙ্গবন্ধু কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন

নিজস্ব প্রতিবেদক ।।

 

শতাব্দীর মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী ও বিজ্ঞানমনস্ক। চির আধুনিক রাজনৈতিক নেতা। বিখ্যাত দার্শনিক রুশো বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও গৌরবমণ্ডিত শিল্প হচ্ছে কৃষি।’ বঙ্গবন্ধু দার্শনিক রুশোর বাণীকে লালন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে বিশ^াস করতেন, অর্থনৈতিকভাবে উন্নত ও সমৃদ্ধ একটি সোনার বাংলা গড়তে কৃষিশিল্পের উন্নয়ন অপরিহার্য।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে সোনালি ফসলে ভরপুর দেখতে চেয়েছিলেন। সে কারণে স্বাধীনতার পর তিনি ডাক দিয়েছেন সবুজ বিপ্লবের, কৃষিকে দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব। কৃষকের সব বকেয়া খাজনা ও সুদ তিনি মাফ করে দেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরতরে মওকুফ করেন। ১৯৭২-৭৩ সালে ৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন বরাদ্দে ১০১ কোটি টাকা তিনি রাখেন শুধু কৃষির উন্নয়নে। কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক ও আনুষঙ্গিক উপকরণ, কৃষি যন্ত্রপাতি, সেচসুবিধা সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে ১৯৭২ সালে ১৬ হাজার ১২৫ টন উচ্চফলনশীল ধানবীজ, ৪৪ টন পাটের বীজ, ১ হাজার ৩৭ টন গমের বীজ বিতরণের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে কৃষির উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের অগ্রযাত্রা সূচিত করেন। টেকসই কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে গবেষণাসহ কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং পুনর্গঠন করেন। তিনি আধুনিক ও উন্নত কৃষির প্রয়াসে কৃষি শিক্ষায় মেধাবীদের চাকরিতে আকৃষ্ট করে উন্নত কৃষিব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে, কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদা প্রদান করেন। তাঁর এই যুগান্তকারী পদক্ষেপে দেশের মেধাবীরা আগ্রহী হন কৃষি পেশায়।

বঙ্গবন্ধুর প্রাণের চেয়েও প্রিয় ছিল বাংলার কৃষক। বঙ্গবন্ধু যখন দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন তখন এ দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ লোক ছিল কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তিনি বলেছিলেন, ‘গ্রামের দিকে নজর দিতে হবে। কেননা গ্রামই সব উন্নয়নের মূল কেন্দ্র। গ্রামের উন্নয়ন আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন যখন বেগবান হবে, তখন গোটা বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।’ তাঁর অদম্য ইচ্ছা ছিল যেকোনো উপায়ে কৃষকদের স্বার্থরক্ষা করা। কেননা কৃষকরাই এ দেশের উন্নয়নের আসল নায়ক, যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের সবার অন্ন জোগান। কৃষকদের চলমান চাহিদা যথোপযুক্তভাবে নিশ্চিত করতে পারলে কৃষক অনেক আগ্রহে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেকে বিনিয়োগ করতে পারবেন। তখন উন্নয়নের জোয়ার বইবে।
কৃষির সার্বিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু যে মমত্ববোধ ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে তাঁর প্রদত্ত ভাষণটি একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে আজও সাক্ষ্য দেয়। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি গৌরবময় দিন। বঙ্গবন্ধু শত ব্যস্ততার মধ্যেও কৃষি ও কৃষকের টানে ছুটে গিয়েছিলেন কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের সবুজ-শ্যামল আঙিনায়। এ দেশের কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদদের সঙ্গে যে তাঁর আত্মার সম্পর্ক ছিল তা প্রদত্ত ভাষণে তিনি স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে এসেছি। সবুজ বিপ্লবের কথা আমরা বলছি। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের যে অবস্থা, সত্য কথা বলতে কি বাংলার মাটি, এ উর্বর জমি বারবার দেশ-বিদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ও শোষকদের টেনে এনেছে এই বাংলার মাটিতে। এই উর্বর এত সোনার দেশ যদি বাংলাদেশ না হতো, তবে এতকাল আমাদের থাকতে হতো না। যেখানে মধু থাকে, সেখানে মক্ষিকা উড়ে আসে। সোনার বাংলা নাম আজকের সোনার বাংলা নয়। বহুদিনের সোনার বাংলা। বাংলার মাটির মতো মাটি দুনিয়ায় দেখা যায় না। বাংলার মানুষের মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলার সম্পদের মতো সম্পদ দুনিয়ায় পাওয়া যায় না।’

তিনি কৃষির গুরুত্ব উপলব্ধি করে বলেন, ‘যেভাবে মানুষ বাড়ছে যদি সেভাবে আমাদের বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে, তবে ২০ বছরের মধ্যে বাংলার মানুষ বাংলার মানুষের মাংস খাবে।’ সে কারণেই আমাদের কৃষির দিকে নজর দিতে হবে এবং কৃষিবিদদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের কোট-প্যান্ট খুলে একটু গ্রামে নামতে হবে। কেমন করে হালে চাষ করতে হয়, এ জমিতে কত ফসল হয়, এ জমিতে কেমন করে লাঙল চষে, কেমন করে বীজ ফলন করতে হয়। আগাছা কখন পরিষ্কার করতে হবে। ধানের কোন সময় নিড়ানি দিতে হয়। কোন সময় আগাছা ফেলতে হয়। পরে ফেললে আমার ধান নষ্ট হয়ে যায়। এগুলোর বই পড়লে হবে না। গ্রামে গিয়ে আমার চাষি ভাইদের সঙ্গে প্রাকটিক্যাল কাজ করে শিখতে হবে। তা হলে আপনারা অনেক শিখতে পারবেন। অনেক আগে কৃষি বিপ্লবের কথা বলছি। ৫০০ কোটি টাকার ডেভেলপমেন্ট বাজেট করেছিলাম এবং ১০১ কোটি টাকা কৃষি উন্নয়নের জন্য দিয়েছি। ভিক্ষা করে টাকা আমি জোগাড় করেছি।’

এই উপমহাদেশের আরেক জাতির জনক ও অসহযোগ আন্দোলনের পথিকৃৎ মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘একজন ক্ষুধার্ত ব্যক্তি একটুকরো রুটির মধ্যে স্রষ্টাকে দেখেন।’ বঙ্গবন্ধু এই ঐতিহাসিক বাণী উপলব্ধি করে বলেছিলেন, ‘খাবার অভাব হলে মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। সেজন্য খাওয়ার দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে অন্নহীন মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিতে।’ এ লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার জন্য বাঙালি জাতি যখন অগ্রসরমাণ, ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি কুচক্রী মহল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুকে নিজ বাসভবন ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একটি স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রী মহলের হস্তক্ষেপে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আর আশার আলো দেখেনি। কৃষিখাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার, অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ইত্যাদির ফলে বিগত দিনগুলোতে বিপুল সম্ভাবনাময় কৃষিখাতে উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া লাগেনি।