সামনের বর্ষায় পাহাড় ধসের শঙ্কা বাড়ছে চট্টগ্রামে

সামনের বর্ষায় পাহাড় ধসের শঙ্কা বাড়ছে চট্টগ্রামে
সামনের বর্ষায় পাহাড় ধসের শঙ্কা বাড়ছে চট্টগ্রামে

পোস্টকার্ড ডেস্ক ।।

এবারও আসন্ন বর্ষা মৌসুমে প্রতিবছরের মতো পাহাড় ধসের শঙ্কা বাড়ছে চট্টগ্রামে। ঘটতে পারে প্রাণহানি। যা আঁচ করতে পারছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনও। তবে এ সমস্যা সমাধানে বরাবরের মতোই পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলো উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নিয়ে এগোচ্ছে প্রশাসন। অথচ যুগ যুগ ধরে এই সমস্যা প্রকট হয়ে উঠলেও স্থায়ী সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেই বলে চট্টগ্রামের পরিবেশবাদী সংগঠন পিপলস ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহানের দাবি। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে প্রতিবছর কোনো না কোনো জায়গায় পাহাড়ধসে ঘটে প্রাণহানি। গত ১৩ বছরে পাহাড় ধসে দুই শতাধিক মানুষের মুত্যু হলেও থেমে নেই ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস। 

তিনি আরও বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও আসন্ন বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধসের শঙ্কা বাড়ছে। কারণ আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে এবার অতিবৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। যা জেনে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন বরাবরের মতো ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলোকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নিয়েছে। শরীফ চৌহান বলেন, চট্টগ্রাম নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাস করছে কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ। পুরো জেলায় পাহাড়ে বসবাসকারির সংখ্যা ১ লাখের ওপরে। এ বছরও যদি বেশি পরিমাণে বৃষ্টি হয় তাহলে পাহাড়ধস হতে পারে। প্রাণহানিও ঘটতে পারে। এ সমস্য সমাধানে ২০০৭ সালে টেকনিক্যাল কমিটি যে ৩৭ দফা সুপারিশ করেছিল সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। 

ঝুঁকিপূর্ণ ৩৪ পাহাড় চিহ্নিত : মহানগরে ৬৫ পাহাড়ের মধ্যে ৩৪ পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। এর মধ্যে সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বসবাস করছে। অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৫৩১টি। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩০৪টি।

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাজমুল আহসান এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, এসব পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলো উচ্ছেদ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে বসতিগুলো থেকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। 

তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) চট্টগ্রামের প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান সামিনা বানু বলেন, আমরা সংযোগ না দিলেও ওরা চুরি করে বিদ্যুৎ নেয়। অভিযান চালিয়ে অবৈধ লাইন বিচ্ছিন্ন করলেও ফের সংযোগ দেয়। 

ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসের কারণ : নগরীর পরিবেশ অধিদফতর সংলগ্ন    সিটি করপোরেশন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি গড়ে বসবাস করছেন লিটন মজুমদার। তিনি বলেন, স্বল্প বেতনে চাকরি করি। বাসা ভাড়া কম, তাই এখানে থাকি। ২০০৪ সাল থেকে বসবাস করছি। এর মধ্যে ২০১০ সালে একবার পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে।

পরিমল নামে একজন পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে থাকেন বায়েজিদ থেকে সীতাকুণ্ডে যাওয়া সিডিএ লিংক রোডের পাশের পাহাড়ে। তিনি বলেন, মাসে যা আয় করি, এখানে থাকা ছাড়া তো উপায় নেই। ধস হলে বিপদ হবে জেনেও এখানে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। সরকার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলে চলে যাব।

মতিঝরনার টাঙ্কির পাহাড়ে নিজেই ঝুঁকিপূর্ণ বসতি গড়ে তোলেন জোছনা বেগম। তিনি বলেন, বৃষ্টি হলেই ভয়ে থাকি। যাওয়ার জায়গা নেই। কেউ পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা করে না। এ কারণে ঝুঁকি এখানে থাকা। একইভাবে বাটালি হিলের বাসিন্দা মায়া আক্তার বলেন, পুনর্বাসনের জন্য প্রশাসন থেকে আমাদের তালিকা করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ঝুঁকি নিয়েও আমাদের এখানে বসবাস করতে হচ্ছে।

বসবাসকারী লোকজনের অভিযোগ, পাহাড়ের পাদদেশে ঘর নির্মাণের পেছনে রয়েছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। তারাই পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করে নিম্ন আয়ের লোকজনকে কম ভাড়ার কথা বলে বসবাসের প্ররোচনা দেন। প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না। শুধু বর্ষা আসলেই বসতিদের উচ্ছেদ করে।

বর্ষা এলে যা হয় পাহাড়গুলোতে : বর্ষা আসলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন পাহাড় থেকে বসতিদের উচ্ছেদ করতে উঠে-পড়ে লাগে। এ সময় অতিবৃষ্টি বা ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্কেত পেলে মাইকিং করে বসতিদের সরিয়ে নেওয়ার নামে জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বসতিরা এ সময় নিরুপায় হয়ে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে চলে যায়। 

ঘূর্ণিঝড় ও বৃষ্টি কমে আসলে আবার ফিরে আসে। অথচ বসতিদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ নেই। এই সমস্যা সমাধানে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে দেওয়া প্রতিবেদনে ৩৭ দফা পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশও করা হয়। 

সচেতন নাগরিক কমিটি চট্টগ্রামের আহ্বায়ক ও নগর পরিকল্পনাবিদ দেলোয়ার মজুমদার এ বিষয়ে বলেন, যেসব প্রভাবশালী পাহাড় দখল করে ঘর তৈরি করে নিম্ন আয়ের লোকজনকে ঝুঁকিতে থাকার প্ররোচনা দিচ্ছে, তাদেরও চিহ্নিত করা জরুরি। 

পাহাড় ধসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা : প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রামের কোথাও না কোথাও পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে পাহাড়ধসে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় ২০০৭ সালে। ওই বছরের ১১ জুন টানা বর্ষণের ফলে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালে মারা যায় ৩০ জন। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বৃষ্টির সময় নগরের বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড়ধসে তিনজন নিহত হয়। একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় পাহাড়ধসে মা-মেয়ে মারা যায়। অথচ এ দুটি পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় ছিল না। 

পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে বালি মাটি বেশি। ফলে মাঝারি বৃষ্টিপাত হলেও পাহাড়ধস ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। 

আর এই পাহাড় ধসের মূল কারণ পাহাড় কাটা। চট্টগ্রামে এক শ্রেণির চিহ্নিত ভূমিদস্যু পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত। যারা পাহাড় দখল করে স্থাপনা তৈরির মাধ্যমে ভাড়া আদায় করে। তারা বিভিন্ন দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো কোনো ব্যবস্থা নেয় না। নিলেও দায়সারা। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরী বলেন, পাহাড় কাটা রোধে নিয়মিত মামলা করা হয়। পাশাপাশি জরিমানাও করা হয়। ২০২১ সালেও চট্টগ্রাম নগরীতে পাহাড় কাটার দায়ে ৪৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে সরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি রয়েছে। কিন্তু এসব করেও পাহাড় কেটে স্থাপনা নির্মাণ ঠেকানো যাচ্ছে না। 

পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীদের বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান বলেন, পাহাড়ে অবৈধ দখলদার ও ভূমিদস্যু কেউ থাকলে তাদের উচ্ছেদ করা হবে। এ বছর কোনো প্রাণহানির ঘটনা যাতে না ঘটে সে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যারা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বসবাস করছেন, বৃষ্টি হলে পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে এমন স্থানে বসবাসকারীদের সরিয়ে আনা হবে।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;