সীতাকুণ্ড কনটেইনার ডিপাে বিস্ফোরণ , দুই মাসেও ক্ষতিপূরণ পাননি অনেক পরিবার

সীতাকুণ্ড কনটেইনার ডিপাে বিস্ফোরণ , দুই মাসেও ক্ষতিপূরণ পাননি অনেক পরিবার
সীতাকুণ্ড কনটেইনার ডিপাে বিস্ফোরণ , দুই মাসেও ক্ষতিপূরণ পাননি অনেক পরিবার

বিশেষ প্রতিবেদক ।।

দুই মাস হয়ে গেল সীতাকুন্ডে বিএম কনটেইনার ডিপােতে অগ্নিকান্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনার। অথচ নিহত আহতদের অনেকে এখনও প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। তাদের অনেকেই প্রয়ােজনীয় সকল কাগজপত্র জমা দেওয়ার পরেও অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। অবশ্য ডিপাে কর্তৃপক্ষ বলছে, এখনও ৫০-৬০ জনের মতাে দগ্ধ ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া বাকি আছে।

ক্ষতিপূরণের সর্বশেষ তথ্য নিয়ে জানা যায়, দগ্ধ ও হতাহতদের ১০ ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে বলেছে বিএম ডিপাে কর্তৃপক্ষ। সেগুলাে হলে চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল কাগজপত্র, ডিপােতে নিয়ে যাওয়া মালামালের ডেলিভারি চালান, বিল অফ এন্ট্রি, এক্সপাের্টের মাল হলে গার্মেন্টসের প্রত্যয়নপত্র, ইমপাের্টের মাল হলে ট্রান্সপাের্ট এজেন্সির প্রত্যয়নপত্র, গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স, মারা গেলে মৃত্যু সনদ, ওয়ারিশ সনদ, প্রত্যেক ওয়ারিশের জাতীয় পরিচয়পত্র/জন্ম নিবন্ধন সনদ, ক্ষমতা অর্পণ / প্রত্যয়নপত্র ও এক কপি করে মৃত ব্যক্তি ও ওয়ারিশগণের আহত বা দগ্ধ ব্যক্তির ছবি। তবে ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে বেশিরভাগ কাগজ দিলেও এক প্রত্যয়নপত্র নিয়ে আছেন বিপাকে। ডিপাে কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নিতে চাইছে না বলে অভিযােগ করেছেন তাদের অনেকেই। এখন পর্যন্ত কতজন সকল কাগজপত্র জমা দিয়েছেন, কতজন আংশিক জমা দিয়েছেন এবং কতজন কোনও কাগজ জমা দেননি এসব তথ্য জানাতে পারেনি বিএম ডিপাে কর্তৃপক্ষ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডিপাে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়ােজনীয় এসব কাগজপত্রের মধ্যে এক্সপাের্টের মালামালের ক্ষেত্রে গার্মেন্টসের প্রত্যয়নপত্র এবং ইমপাের্টের মালের ক্ষেত্রে ট্রান্সপাের্ট এজেন্সির প্রত্যয়নপত্র নিয়ে বিপাকে পড়েছেন দগ্ধ কয়েকজন। সংশ্লিষ্ট গার্মেন্টস ও ট্রান্সপাের্ট এজেন্সি না দেওয়ায় তারা ওইসব কাগজ ডিপােতে জমা দিতে পারছে না বলে জানিয়েছেন তারা।

দগ্ধ বদরুজ্জামান রুবেল ও তার ভাই নাজমুল জানান, পানামা টেক্সটাইলের মাল আনতে রিজওয়া ট্রান্সপাের্ট এজেন্সির গাড়ি দিয়ে বিএম ডিপােতে গিয়েছেন। এখন ওই প্রতিষ্ঠান দুটি প্রত্যয়নপত্র দিতে অস্বীকার করছে। ফলে বিল অফ এন্ট্রিসহ অন্যান্য সকল কাগজ জমা দিয়েছি ডিপােতে। কিন্তু প্রত্যয়নপত্র ছাড়া কিছুই করার নেই বলে জানিয়েছে বিএম কর্তৃপক্ষ।

আরেক দগ্ধ সুমন হাওলাদার জানিয়েছেন, পানামা টেক্সটাইলের মাল লােড করতে বিএম ডিপােতে গিয়েছিলাম। সেই কাগজসহ সকল কাগজ জমা দিয়েছি ডিপােতে। কিন্তু পানামার প্রত্যয়নপত্র ছাড়া সেগুলাে গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে তারা। পানামা কাগজটি দিবে না বলে জানিয়েছে।

দগ্ধ সবুজ জানান, অনন্ত জিন্স ওয়ারের মাল খালাস করতে জনি ট্রান্সপাের্টের গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম ডিপােতে। ডিপাের এন্ট্রি খাতায় নথিভুক্ত করে ভেতরে গিয়েছিলাম। এখন তারা কেউ প্রত্যয়নপত্র দিতে চায় না। এটি ছাড়া অন্য সকল কাগজপত্র ডিপােতে জমা দিয়েছি। রুবেল, সুমন ও সবুজের মতাে আরও বেশ কয়েকজন দগ্ধ ব্যক্তি প্রত্যয়নপত্র নিয়ে বিপাকে থাকার বিষয়টি জানিয়েছেন। তারা অন্যান্য কাগজ জমা দিলেও ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন বলে জানান।

আগামী ১৫ আগস্টের মধ্যে প্রত্যয়নপত্র জমা দিতে হবে বলেও ডেডলাইন দিয়ে দিয়েছে ডিপাে কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে বিএম ডিপাের মালিকপক্ষ স্মার্ট গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, এখনও ৫০-৬০ জনের মতাে দগ্ধ মানুষকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া বাকি আছে। তাদের বিষয়ে ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে বসে আলােচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং পর্যায়ক্রমে দেওয়া হবে। তাদের আগে ডিএনএ জটিলতায় থাকা নিহত ১৭ জনের ক্ষতিপূরণের টাকা হস্তান্তর করার চেষ্টা চলছে।

আরেক দগ্ধ নজরুল ইসলাম মণ্ডল ও ভাই কামরুল ইসলাম বলেন, শারমিন গ্রুপের নিজস্ব গাড়িতে তাদের মাল নিয়ে ডিপােতে গিয়েছিলেন। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রত্যয়নপত্রসহ সকল কাগজ জমা দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিপূরণ দিতে সময় লাগবে বলে আমাদের জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, নজরুলের মতাে আরও বেশ কয়েকগুন সকল কাগজ জমা দেওয়ার পরেও এখনও ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। ডিপাে কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়েছে, ক্ষতিপূরণের অর্থ পেতে আরও সময় লাগবে। তবে সেই 'আরও সময়' কবে নাগাদ শেষ হবে, তা জানেন না তারা কেউই। এ নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন এসব দগ্ধ মানুষ ও তাদের স্বজনরা।

এদিকে, ডিএনএ শনাক্ত সংক্রান্ত জটিলতায় থাকা পাঁচ জন পুলিশ সদস্য এবং পাঁচ জন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ সদস্যের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের তিনজনের টাকা চট্টগ্রাম পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল ২১ জুলাই, সেটিও পিছিয়ে গেছে। আহতদের অবস্থা অনুসারে ২, ৪ বা ১০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পাবেন তারা।

এ বিষয়ে মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী জানান, ডিএনএ পরীক্ষা সংক্রান্ত জটিলতায় অপেক্ষমাণ থাকা ১০ জনের ক্ষতিপূরণের টাকা আগামী সপ্তাহে হস্তান্তর করা হতে পারে। সেটি জেলা প্রশাসকের সিদ্ধান্তের ওপর। নির্ভর করছে। অন্যদের বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।

উল্লেখ্য, গত ৪ জুন রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিএম ডিপােতে প্রথমে আগুন এবং পরে দফায় দফায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, যা নিয়ন্ত্রণে ৮৬ ঘণ্টা সময় লাগে। ওই ঘটনায় ৫১ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এরমধ্যে ২৯ জনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। এসব লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তরও করা হয়েছে। ২২ লাশের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ রিপাের্টের জন্য আটকে থাকলেও গত ৭ জুলাই আট জনের পরিচয় মেলে। এসব লাশও হস্তান্তর করা হয়েছে।

জানা যায়, গত ২০ জুন হতাহতদের মধ্যে তিন ক্যাটাগরিতে ৬৯ জনকে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের টাকা হস্তান্তর করে ডিপাে কর্তৃপক্ষ। তাদের মধ্যে ৩১ জনই বিএম কনটেইনার ডিপাের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ফায়ার সার্ভিসের ২৬ জন এবং অন্যান্য আট জন। বাকিদের মধ্যে ডিএনএ পরীক্ষার জটিলতায় ১৪টি লাশের পরিচয় এখনও শনাক্ত হয়নি, তাদের ক্ষতিপূরণও আটকে আছে। অন্যদের তালিকা এখনও চূড়ান্ত করতে পারেনি ডিপাে কর্তৃপক্ষ।

স্মার্ট গ্রুপ জানায়, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এখন পর্যন্ত দগ্ধ ৬৯ জনকে ৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। গত ২০ জুন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এই টাকা হতাহতদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডিএনএ জটিলতায় মৃত ২০ জনের পরিবারের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের তিন জন বাদে ১৭ জনের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাবে। ফায়ার সার্ভিসের ওই তিনকর্মীকে মৃত ধরে ইতােমধ্যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। তিন ক্যাটাগরিতে ২৬ জনের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ১৩ জনের পরিবারকে ১৫ লাখ করে, বিএম ডিপাের ৯ জন ও অন্যান্য ৪ জনের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। অঙ্গহানি হওয়া ১৫ জনের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ৯ জনকে ১০ লাখ করে, বিএম ডিপোর ৩ জন ও অন্যান্য ৩ জনকে ৬ লাখ করে টাকা দেওয়া হয়েছে। দগ্ধ বা আহত ২৩ জনের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ৪ জন, বিএম ডিপোর ১৯ জন ও অন্য একজনকে ৪ লাখ করে টাকা দেওয়া হয়েছে।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;