সীতাকুণ্ডে জঙ্গল সলিমপুরে অভিযান: ৩ টি স্ক্যাভেটর, ৬ টি ড্রাম ট্রাক ও ১ টি ট্রাক জব্দ

সীতাকুণ্ডে জঙ্গল সলিমপুরে অভিযান: ৩ টি স্ক্যাভেটর, ৬ টি ড্রাম ট্রাক ও ১ টি ট্রাক জব্দ
সীতাকুণ্ডে জঙ্গল সলিমপুরে অভিযান, ৩টি স্ক্যাভেটর ও  ৩টি ড্রাম ট্রাক জব্দ

পোস্টকার্ড ডেস্ক ।।

সীতাকুণ্ডের জংগল সলিমপুর ইউনিয়ন অপরাধীদের অভয়ারণ্যখ্যাত আলীনগর। খুলনা, বরিশাল, বগুড়া, নোয়াখালীর সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি, খুন-গুম মামলার আসামিরাই সলিমপুরের এই আলীনগর নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সেখানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রাতের বেলা দূরে থাক, দিনেও যেতে আতংকে থাকেন। এখানে সীতাকুন্ডের স্থায়ী বাসিন্দা হাতেগোনা। এভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অপরাধীরা এসে আস্তানা গড়ে তোলে জঙ্গল সলিমপুর সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আর তারা জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় খুন, ডাকাতি ও মাদক ব্যবসার পাশাপাশি এসকেভেটর দিয়ে বিশাল বিশাল পাহাড় কেটে প্লট ও মাটি বিক্রির কাজ করে থাকে। পাহাড়ি এই দুর্ভেদ্য সাম্রাজ্যে স্থানীয়রা ছাড়া বাইরের কেউ প্রবেশ করতে চাইলে নিতে হয় অনুমতি। এটা দীর্ঘ বহু বছরের নিজের গড়া আইন। আর এই আইনটি তৈরী করেছে এ সাম্রাজ্যের স্বঘোষিত রাজা মোঃ ইয়াসিন।

আর এই সাম্রাজ্যে প্রথমবারের মতো অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলার যৌথ বাহিনী। শুক্রবার ( ২২ জুলাই ) সকাল থেকে দিনব্যাপী আলীনগরে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর, র‍্যাবের যৌথ অভিযান পরিচালিত হয়। এতে বিভিন্ন বাহিনীর শতাধিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উপস্থিত ছিলেন।

অভিযানে আলীনগরের সরকারী শত শত একর পাহাড় কাটার দৃশ্য দেখা যায় । এসময় দূর্ঘম পাহাড় থেকে মাটি কাটার তিন স্কেভেটর, ৫টি ড্রাম ট্রাক ও দুইটি ট্রাক জব্দ করা হয়। সহকারী কমিশনার ভূমি ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আশরাফুল আলম এ অভিযান চালান।

এসময় ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ দেখে ভূমি দস্যুরা পালিয়ে গেলেও পাহাড় কাটায় ব্যবহৃত ৩টি স্কেভেটর , ৫টি ড্রাম ট্রাক ও দুইটি ট্রাক জব্দ করা হয়।

এর আগে, গত ১৫ জুলাই শুক্রবার স্থানীয় সরকার চট্টগ্রাম বিভাগের উপপরিচালক বদিউল আলম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নাজমুল আহসান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) মাসুদ কামাল, সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন, রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) মং মারমা ও সীতাকুণ্ড উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশরাফুল আলম ও স্থানীয় সলিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন আজিজ আলীনগর পরিদর্শনে যান।

পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে চেয়ারম্যানের গাড়ি থেকে নামিয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য মোহাম্মদ আরিফকে বেধড়ক মারধর করে ইয়াসিন বাহিনীর সন্ত্রাসীরা। এ সময় সবার সামনে মেম্বার আরিফের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে মারধর করে তারা। এ ঘটনায় আরিফ মেম্বারের ছোট ভাই আবদুল আলীম বাদী হয়ে ইয়াসিন, ফারুকসহ ৬ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন। এরপরই সোমবার দুপুর ১টার দিকে চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থেকে ডিবি পুলিশের সহায়তায় ইয়াসিনকে গ্রেফতার করে পুলিশের একটি দল।

সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে জনপ্রতিনিধিকে মারার ঘটনার পরই আলোচনায় আসে মোহাম্মদ ইয়াসিন ও জঙ্গল সলিমপুর।

সীতাকুণ্ড ভূমি অফিসের তথ্যমতে, জঙ্গল সলিমপুর মৌজার ১ নম্বর খাস খতিয়ানের বিএস ২০১ দাগে ১৮ দশমিক ৭৭ একর, ২০৩ দাগে ৪৩২ দশমিক ৯৯ একর, ২১২ দাগে ০ দশমিক ০৭ একর, ২৬২ দাগে ৩ দশমিক ৭০ একর, ২৭৮ দাগে ৩৯ দশমিক ৬৫ একর, ৩৫০ দাগে ২০০ দশমিক ১০ একর, ৩৫১ দাগে ৪৮ দশমিক ৫০ একর, ৩৫২ দাগে ৩ দশমিক ৪০ একর, ৩৫৫ দাগে ৭৪ দশমিক ৭৫ একর, ছুট খতিয়ানের ৩০৯, ৩৪৯, ৩০৭ দাগ ও ১৯ নম্বর খতিয়ানের বিএস শ্রেণি পাহাড়, ২০২ দাগে ০ দশমিক ৯৯ একর ছড়া এবং ২১২ দাগে ০ দশমিক ০৭ একর শ্রেণি নাল থাকার কথা। কিন্তু ৪০টির বেশি পাহাড় কেটে ওখানে তৈরি করা হয়েছে অন্তত ২০ হাজার প্লট এবং সরকারি হাজার হাজার একর পাহাড় দখল শেষে সেসব কেটে প্রতিদিনই নতুন নতুন প্লট তৈরি করে যাচ্ছে প্রভাবশালী ইয়াসিন বাহিনীরসহ ভূমিদস্যুরা।

অভিযানে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আশরাফুল আলম, জেলা পরিষদ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(সীতাকুণ্ড সার্কেল) আশরাফুল করিম, চট্টগ্রাম পরিবেশ উপ-পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার, মডেল থানার অফিসার্স ইনচার্জ আবুল কালাম আজাদ, র‍্যাবের সহকারী পরিচালক জিন্নাতুল ইসলামসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সদস্যবৃন্দ।

এ সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আশরাফুল আলম বলেন, জঙ্গল সলিমপুরের দূর্গম এলাকা আলীনগরে যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালনা করা হয়। এখানে পাহাড় খেকোরা সরকারী শত শত একর পাহাড় কেটে অবৈধভাবে আবাসন গড়ে তুলেছে। রাষ্ট্রের চেয়ে শক্তিশালী কেউ নয়, এই ম্যাসেজটি আমরা সকল দুষ্কৃতকারীকে দিতে চাই। আমাদের সীতাকুণ্ডের মাটিতে কেউ অপরাধের স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলবে তা আমরা হতে দিব না। সরকার জঙ্গল সলিমপুর নিয়ে উন্নয়নের একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করছে। খুব শীঘ্রই উচ্ছেদসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু হবে (পাশাপাশি প্রকৃত ভূমিহীদের পুনর্বাসন করা হবে)। অভিযানে আমরা ৩ টি স্কেভেটর, ৬ টি ড্রাম ট্রাক ও ১ টি ট্রাক জব্দ করেছি।

সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, সন্ত্রাসীদের নেতৃত্বে অবৈধ বসতি স্থাপনের মাধ্যমে জঙ্গল সলিমপুরকে কয়েকটি সমাজে বিভক্ত করেছে সন্ত্রাসীরা। তাদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন সমিতি। এসব সমিতির হিসাবে গত দুই দশকে এই এলাকায় লক্ষাধিক মানুষের বসতি স্থাপিত হয়েছে। এদের কাছ থেকে নানান অজুহাতে অর্থ আদায় করেন ইয়াছিন-মশিউররা। এভাবে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়ায় এখন ধরাকে সরাজ্ঞান করছে এই বাহিনী। প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও তেমন একটা পরোয়া করে না তারা।

ওসি আরও বলেন, সম্প্রতি চট্টগ্রামের প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই এলাকা পরিদর্শন করে ফিরে যাওয়ার পথে তাদের গাড়িবহর থেকে এক ইউপি সদস্যকে টেনে নামিয়ে ব্যাপক মারধর করেছে ইয়াছিনের বাহিনী। বিষয়টি প্রশাসনকে ভাবিয়ে তোলে। এর পরই মূলত বেপরোয়া ইয়াছিনের লাগাম টেনে ধরার পরিকল্পনা নিয়ে অভিযান শুরু হয়। ইউপি সদস্যের ওপর হামলার মামলায় ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ইয়াছিন আলী (৫৫)। পুলিশ তাঁকে রিমান্ডেও এনেছে। এরই মধ্যে তারা জানতে পারে সলিমপুরে ইয়াছিনের সাম্রাজ্যে আলীনগর এলাকায় ইয়াছিন না থাকলেও তাঁর বাহিনী একের পর এক পাহাড় কেটে সমতল ভূমি ও প্লট তৈরি করছে। ফলে শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সেখানে যৌথ অভিযান চালানো হয়।’ 

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন জানান, জঙ্গল সলিমপুরের পাহাড়ের বেশ কিছু পাহাড় দখল করে নিজের অপরাধের স্বর্গরাজ্য তৈরি করেছিল সন্ত্রাসী ইয়াছিন। জঙ্গল সলিমপুর, আলী নগরের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও পাহাড় খেকোদের বিরুদ্ধে আজকের অভিযান বিভিন্ন আঙ্গিকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। রাষ্ট্রের চেয়ে শক্তিশালী কেউ নয়- এই ম্যাসেজটি আমরা সকল দুষ্কৃতকারীকে দিতে চাই।সীতাকুণ্ডের মাটিতে কেউ অপরাধের স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলবে তা আমরা হতে দিব না। এই অভিযানে আমরা ৩ টি স্ক্যাভেটর, ৬ টি ড্রাম ট্রাক ও ১ টি ট্রাক জব্দ করেছি। যে উদ্দেশ্য আজকের অভিযান- তা শতভাগ সফল হয়েছে। আমরা মূলত আজ চেয়েছি পাহাড় কাঁটার কাজে ব্যবহৃত সকল সরঞ্জাম জব্দ করতে। সেটি করা হয়েছে। সরকার জঙ্গল সলিমপুর নিয়ে উন্নয়নের একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করছে। খুব শীঘ্রই উচ্ছেদসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু হবে। পাশাপাশি প্রকৃত ভূমিহীদের পুনর্বাসন করা হবে।

তিনি অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া মোঃ আশরাফুল আলম, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সীতাকুণ্ড, আব্দুল্লাহ আল মামুন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশরাফুল করিম, অফিসার ইনচার্জ, সীতাকুন্ড আবুল কালাম আজাদ, উপপরিচালক, পরিবেশ ফেরদৌস আনোয়ার, সহকারী পরিচালক, র‍্যাব জিন্নাতুল ইসলাম, উপস্থিত সাংবাদিকসহ সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা  জানান।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;