আগ্রাবাদ এক্সেস ও পিসি রোড : প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ , ঠিকাদারের কার্যাদেশের মেয়াদ আগামী সপ্তাহে শেষ হচ্ছে

মোরশেদ তালুকদার ।।

আগ্রাবাদ এক্সেস ও পিসি রোড :  প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ  , ঠিকাদারের কার্যাদেশের মেয়াদ আগামী সপ্তাহে শেষ হচ্ছে
আগ্রাবাদ এক্সেস ও পিসি রোড

আগামী সপ্তাহে শেষ হচ্ছে আগ্রাবাদ এক্সেস রোড এবং পোর্ট কানেকটিং রোড (পিসি রোড) সড়ক দুটি’র সংস্কারে নিয়োজিত ঠিকাদারের কার্যাদেশের মেয়াদ। যদিও শেষ হয়নি সংস্কার কাজ। পরিবর্তন হয়নি সড়ক দুটির উপর নির্ভরশীল লোকজনের দুর্ভোগও। কারণ, এখনো ‘ভাঙাচোরা’ অবস্থায় আছে সড়কের বেশিরভাগ অংশ। সেখানে আছে ছোট-বড় গর্ত। কিছু কিছু অংশে খানাখন্দগুলোও রয়ে গেছে আগের মতই। পরিবর্তন বলতে কেবল এতটুকু, ভারী বর্ষণ হলে গর্তগুলোতে পানি জমে থাকত। রূপ নিত ‘পুকুরে’। বৃষ্টি একটু কমলে কাদা-বালি। এখন আছে ধুলোবালি।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর এক্সেস রোডের ২ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার অংশের উন্নয়নে ৪৮ কোটি ৯৬ লাখ ৬৬ হাজার ৮৪৮ টাকায় নিয়োগ করা হয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম.এম. বিল্ডার্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড ও মেসার্স রয়েল এসোসিয়েট (জেভি)কে। তখন কার্যাদেশের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত। তবে গত ১৩ মে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আবেদনের প্রেক্ষিতে সময় বাড়ানো হয়। বর্ধিত মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৮ আগস্ট। গত জুন মাসের অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী কাজের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৬২ শতাংশ। এদিকে পিসি রোডের কাজটি করা হচ্ছে ৫টি প্যাকেজে। সেখানে দুটি প্যাকেজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর। এরমধ্যে নিমতলা থেকে অলংকার পর্যন্ত প্রথম প্যাকেজে ৫০ কোটি ৫৮ লাখ ৬৩ হাজার ৩৩৯ টাকা এবং দ্বিতীয় প্যাকেজে ৫০ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ৩৩৮ টাকা। দুই অংশেরই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে রানা বিল্ডার্স নামের প্রতিষ্ঠান। এসড়কে গত জুন মাসে কার্যাদেশের মেয়াদ শেষ হয় এবং ঠিকাদারের আবেদনের প্রেক্ষিতে আগামী ৩০ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে গত জুন মাসের অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রথম প্যাকেজে ৫৯ শতাংশ এবং দ্বিতীয় প্যাকেজে ৬২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া তৃতীয় প্যাকেজে ২৬ জুন সড়কটির আনন্দিপুর পর হতে সরাইপাড়া মাজার পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৪৫০ মিটার অংশে ৪২ কোটি টাকায় কাজের উদ্বোধন করেন সিটি মেয়র। বাকি প্যাকেজের দরপত্র আহবান প্রক্রিয়া চলছে।
প্রসঙ্গত, সিটি গভর্নেন্স প্রজেক্টের (ব্যাচ-২) আওতায় এক্সেস রোড ও পিসি রোডের উন্নয়ন কাজে অর্থায়ন করছে জাইকা (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি)। তবে সড়কগুলোর সংস্কারে ঠিকাদার নিয়োগ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চলমান উন্নয়ন কাজের মনিটরিং করে চসিক। ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর সড়কগুলোর উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন করেছিলেন সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন।
সরেজমিন চিত্র : দুইদিন আগে সরেজমিন সড়ক দুটি পরিদর্শনকালে, এক্সেস রোডের উন্নয়ন প্রকল্পভুক্ত ড্রেন সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে। প্রায় অর্ধেক অংশে মিডআইল্যান্ড অংশেরও কাজ শেষ হয়েছে। সড়কের দক্ষিণ পাশে কাপের্টিং কাজ প্রায় শেষ। তবে অপরপাশের বেশিরভাগ অংশ বেশ খারাপ অবস্থায় আছে। ইতোপূর্বে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেখানে ম্যাকাডম দিলেও সাম্প্রতিক বর্ষণে সেগুলো উঠে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় গর্ত। এতে বেগ পেতে হচ্ছে যানবাহন চালকদের।
এদিকে পোর্ট কানেকটিং রোডের অবস্থাও একই। সাগরিকা মোড় থেকে সরাইপাড়ার দিকে যাওয়ার সময় বেহাল দশা বেশি চোখে পড়ে। একে তো খানাখন্দ, তার উপর সাগরিকা মোড় থেকে নয়াবাজার পর্যন্ত অংশে ভারী যানবাহন ও ভারী যন্ত্রপাতি রেখে সড়কটির দুইপাশের বেশিরভাগ অংশ দখল করে রাখা হয়েছে। পিসি রোড এবং এক্সেস রোডের উপর নির্ভরশীল লোকজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গত চার-পাঁচ বছর ধরেই সড়ক দুটির অবস্থা করুণ। এতে সড়ক দুটির উপর নির্ভরশীল লোকজনের দুর্ভোগ ছিল সীমানহীন। তবে প্রায় দুই বছর আগে সংস্কার কাজ শুরু হওয়ায় র্দীঘদিনের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার স্বপ্ন দেখেন তারা। কিন্তু ধীরগতির সংস্কারে দুর্ভোগ থেকে আদৌ মুক্তি মিলবে কি না সেটা নিয়ে তারা শংকিত।
সৈয়দ নামে এক রিকশা চালক বলেন, ভাঙা সড়কে খালি রিকশা টেনে নেয়াও কষ্টের। প্যাসেঞ্জার নিয়ে তো অবস্থা বেগতিক হয়। করিম নামে একজন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কাজ না করে বন্ধ রাখা হয়েছে। বৃষ্টি হলেই আমাদের দুর্ভোগ বাড়ে। এটা দেখার কি কেউ নেই? সেলিম নামে এক চালক বলেন, পোর্ট কানেকটিং রোডের খানাখন্দকের কারণে প্রায় সময় কোন না কোন গাড়ির যন্ত্রাংশ ভেঙে যায়।
কাজ বিলম্বের কারণ :
দীর্ঘদিন ধরেও সড়কগুলোর কাজ শেষ না হওয়ার কারণ সম্পর্কে এলজিইডি’র একজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঠিকাদারদের মধ্যে একজন আছেন যিনি কাজ শেষ করা নিয়ে আগ্রহী নন। এইক্ষেত্রে তিনি কাজ না করেই চলে যেতে চাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে ওই ঠিকাদারকে ১০ শতাংশ জরিমানা দিতে হবে। কিন্তু কাজ শেষ করলেও আর্থিকভাবে লাভবান হবেন না, উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এইক্ষেত্রে ক্ষতির অংক জরিমানার চেয়ে বেশি হবে। কারণ, ইতোপূর্বে ম্যাকাডমের কাজ করলেও বর্ষায় সেগুলো নষ্ট হয়েছে। এখন নতুন করে ম্যাকাডম করতে হবে। আবার প্রকল্পের অর্থায়ন করা সংস্থা জাইকা কাজের গুনগত মানের মনিটরিং করেন এবং তাদের নিজস্ব অডিট টিমও এগুলো দেখেন। ফলে কাজের মানে বিন্দু পরিমাণ ফাঁকি দেয়ারও সুযোগ নাই। এছাড়া দরপত্র অংশ নেয়ার সময় প্রকল্পের বরাদ্দকৃত টাকার চেয়ে ১০ শতাংশ কমে টেন্ডার জমা করেছেন ওই ঠিকাদার। কিন্তু জাইকা প্রকল্পের জন্য যে বরাদ্দ দিয়েছিল সেটা তারা বাজারমূল্যের উপর হিসেব করে দিয়েছে। এইক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কমে দরপত্রে অংশ নিলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, কার্যাদেশ দেয়ার পর দুইটি বর্ষা ছিল। এবং বর্ষার সময় কপেটিং কাজ করা যায় নি। তবে এর আগে ম্যাকাডম করা হলেও তা বর্ষায় নষ্ট হয়। এছাড়া এক্সেস রোডের যে অংশে কার্পেটিং করা হয়েছে সেখানে এক জায়গায় আবার সেবাসংস্থাগুলো তাদের সাভির্স লাইন নেয়ার জন্য কেটেছে। ফলে কাজগুলো পুরোপুরি দৃশ্যমান হচ্ছে না।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম.এম. বির্ল্ডাস এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের স্বত্তাধিকারী মো. দিদারুল আলম বলেন, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়ে সিটি কর্পোরেশনে আবেদন করেছি। কারণ, এবার বর্ষার জন্য কাজ করা যায়নি। তাছাড়া আমাদের যখন ওয়ার্ক অর্ডার দিয়েছিল তখনো বর্ষাকাল ছিল। ওইসময়ও কাজ করতে পরিনি। মাঝখানে কিছু সময় পেয়েছিলাম। আগামী দুয়েকদিনের মধ্যে কাজ শুরু করে দিব। তিনি বলেন, ইতোপূর্বে যেখানে কাজ করেছি সেখানে বিদ্যুৎ, ওয়াসা এবং কণুফুলী গ্যাস কর্তৃপক্ষ রাস্তা কেটে ফেলেছে। সম্পন্ন করা রাস্তা খুঁড়ে ফেলায় সেগুলো সংস্কারে সময় লাগবে। কি পরিমাণ কাজ শেষ হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু কার্পেটিং বাকি আছে। শুষ্ক মৌসুম ছাড়া তো কার্পেটিং করা যায় না।
চসিক প্রকৌশলীরা যা বলেছেন :
পোর্ট কানেকটিং রোড সম্পর্কে চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সাদাত মো. তৈয়্যব দৈনিক আজাদীকে বলেন, রানা বিল্ডার্স দুই লটে যে কাজ করছে তার দূরত্ব তিন হাজার ৬শ মিটার। এরমধ্যে ঈদের আগে সড়কের পূর্ব পাশে প্রায় তিন হাজার মিটারের কার্পেটিং হয়ে গেছে। বাকি অংশটা করে ফেলব। এটা শেষ করার পর পূর্ব পাশে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দিব। এরপর পশ্চিম পাশে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে কাজ শুরু করবো। সেটা শেষ করতে দুই আড়াই মাস লাগতে পারে। এ প্রকৌশলী বলেন, পশ্চিম পাশে ম্যাকাডম করা আছে। কিন্তু বৃষ্টির জন্য নষ্ট হয়েছে। ওগুলো আবার ঠিক করতে হবে। বর্ষা না থাকলে কিন্তু কাজ অনেকদূর এগিয়ে যেত।
আগ্রাবাদ এক্সেস রোড প্রসঙ্গে চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী বিপ্লব দাশ বলেন, গত মঙ্গলবার ঠিকাদার সময় চেয়ে আবেদন করেছে এবং আমরা সেটা জাইকার প্রকল্প পরিচালকের কাছে পাঠিয়ে দিব। জাইকা ডিজহাইন দিতে দেরি করেছে এবং যে ডিজাইন দিয়েছিল সেটা মনপূত না হওয়ায় সংশোধন করতে হয়েছে। এসব কারণে সময়ক্ষেপণ হয়েছে বলে ঠিকাদার তাদের আবেদন পত্রে উল্লেখ করেছে।
এ প্রকৌশলী বলেন, সবমিলিয়ে প্রায় ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এক্সেস রোড উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ড্রেনের কাজ শেষ হয়েছে, মিডআইল্যান্ড হয়েছে ৫০ শতাংশ। সড়কের একপাশে এক হাজার ৭০০ ফুট কার্পেটিং কাজ শেষ হয়েছে। বৃষ্টির জন্য কার্পেটিং করা যায়নি। যদিও সেখানে ম্যাকাডম করা হয়েছে।
সামগ্রিক বিষয়ে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, পিসি রোডে ৭০ শতাংশ এবং এক্সেস রোডে ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। পিসি রোডে একপাশ তো প্রায় কাপেটিং হয়ে গেছে। দুই সড়কের উন্নয়নে নিয়োগকৃত ঠিকাদার ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সময় চেয়ে আবেদন করেছেন। সেটা আমরা পিডির কাছে পাঠিয়ে দিব।