প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রিদেশীয় সফরে যত অর্জন -এমএকে জিলানী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রিদেশীয় সফরে যত অর্জন -এমএকে জিলানী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রিদেশীয় সফরে যত অর্জন -এমএকে জিলানী

টোকিও, ওয়াশিংটন ও লন্ডন সফর শেষে মঙ্গলবার দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অর্থনীতিবিদ ও কূটনীতিকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর এ সফর দেশের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে ২০৩০-৩১ সালের মধ্যম আয়ের দেশে ও ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হওয়ার এবং ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার যে রূপকল্প বাস্তবায়ন করছে প্রধানমন্ত্রীর ত্রিদেশীয় সফর তাতে ব্যাপক ও ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে।

এদিকে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে ১৫ দিনের সফর শেষে লন্ডন থেকে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিমান সকাল ১০টা ৬ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।

প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে দুই পক্ষের মধ্যে আরও শক্তিশালী ও দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত করেছে। উভয়পক্ষ প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি, কৃষি, সাইবার সিকিউরিটি ও আইসিটি, শিল্প, রোহিঙ্গা সংকট, ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যু, বিশে^ শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুসহ দ্বিপক্ষীয় সব খাতে আরও শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। এ সফরে দুই দেশের মধ্যে ৮ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

এ সফরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ‘ব্যাপক অংশীদারত্ব’ থেকে ‘কৌশলগত অংশীদারত্বে’ উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশকে এনার্জি ও লজিস্টিক হাব হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি মাতারবাড়ীতে রোড, রেল ও মেরিটাইম কানেক্টিভিটি বৃদ্ধির বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়েছে জাপান। এ জন্য ২০০০ কোটি ডলারের মহেশখালী-মাতারবাড়ী ইন্টিগ্রেটেড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ নিয়ে কাজ করছে দুই দেশের সরকার। এটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের যৌথ বিবৃতিতে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে ৩০ বিলিয়ন ইয়েন সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। জাপান সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাসের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ এবং বৈশি^ক ঋণদাতার মধ্যে ৫০ বছরের অংশীদারত্ব উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত ১ মে সকালে টোকিও থেকে সরাসরি বিশ্বব্যাংকের সদর দফতর ওয়াশিংটন পৌঁছেন। সেখানে বিশ্বব্যাংক সদর দফতরের প্রিস্টন অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্বব্যাংক-বাংলাদেশ অংশীদারত্বের ৫০ বছরের প্রতিফলন’ শীর্ষক পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকে পাঁচটি সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দেন।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে একটি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার জন্য তার পরবর্তী রূপকল্প বাস্তবায়ন করছে, যার লক্ষ্য ডিজিটালভাবে নাগরিকদের ক্ষমতায়িত করা, চেহারাহীন সরকারি সেবা প্রদান, নগদ অর্থ লেনদেনহীন অর্থনীতি এবং একটি অধিকারভিত্তিক ন্যায়সঙ্গত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ। অনুষ্ঠানে ৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি সই হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের কাছে পদ্মা বহুমুখী সেতুর একটি ছবি তুলে দেন।

ওয়াশিংটন থেকে প্রধানমন্ত্রী গত ৪ মে লন্ডন যান। সেখানে তিনি যুক্তরাজ্য ও কমনওয়েলথভুক্ত অন্যান্য দেশের রাজা ও রানি হিসেবে তৃতীয় চার্লস ও তার পতœী ক্যামিলার অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রী গত ৫ মে বিকালে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের সঙ্গে বৈঠক করেন। গত বছরের ২৫ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম দুই নেতার বৈঠক হয়। রাজা তৃতীয় চার্লসের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিসর ও রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট, সিয়েরা লিওন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, গাম্বিয়া, নামিবিয়া ও উগান্ডার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিনিময় করেন। কমনওয়েলথ মহাসচিব ব্যারনেস প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড গত ৭ মে লন্ডনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় বাংলাদেশে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণে কমনওয়েলথের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠাতে ব্যারনেসকে আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর টোকিও-ওয়াশিংটন-লন্ডন সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ ও সফল আখ্যায়িত করে সাবেক রাষ্ট্রদূত আবদুল হান্নান সময়ের আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সফর শুরু হয়েছে জাপান দিয়ে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু জাপানের সঙ্গে অসম্ভব অংশীদারত্ব সম্পর্ক সৃষ্টি করেছিলেন। রাজনৈতিক সম্পর্কের সেই মাত্রায় এখন উল্লম্ফন ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যার জাপান সফরে সেই সম্পর্ক এখন কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীত। জাপান বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু এবং অর্থনৈতিক অংশীদার। এ সফরে জাপানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কেও নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সফর দ্বিপক্ষীয় ছিল না, ছিল মূলত বিশ্বব্যাংকের জন্য। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার সময়ে প্রধানমন্ত্রীর এ সফর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চমৎকার অংশীদারত্ব সৃষ্টি করেছে। এ সফরের মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মাণকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন এবং দুই পক্ষের মধ্যে সাম্প্রতিককালের ভুল-ভ্রান্তির অবসান ঘটেছে। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক আবারও বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রশংসা করেছে। এ প্রশংসা বৈশ্বিক অন্য অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (জাইকা ইত্যাদি) সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে। কেননা লক্ষ করেছি, বিশ্বব্যাংক পিছু হটার সময়ে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও পিছু হটেছিল, আবার বিশ্বব্যাংক প্রশংসা করায় এখন বাকিরাও আবার এগিয়ে আসবে। বাংলাদেশ ২০৩০-৩১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ থেকে ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে যোগ দেওয়া এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার যে রূপকল্প বাস্তবায়ন করছে তাতেও এ সফর ইতিবাচক প্রভাব রাখবে।

সবশেষে শেখ হাসিনার লন্ডন সফর নিয়ে এ কূটনীতিক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাজ্য সফর খুব ভালো হয়েছে এবং এটাও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এ সফরে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী যে ছয়-সাতজন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার এ সাক্ষাৎ বাংলাদেশের নেতৃত্বের সফল স্বীকৃতির প্রমাণ। প্রধানমন্ত্রীর এই ৩ দেশ সফর আগামী এক দশক দেশের অর্থনীতি বিনির্মাণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘জাপান আমাদের সিঙ্গেল মোস্ট সাপোর্টার এবং জাপানের সঙ্গে এখন আমাদের বিভিন্নমুখী কোলাবেরশন চলছে। প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে পরিবহন, যাতায়াত থেকে শুরু করে মাতারবাড়ী, বঙ্গোপসাগরে বিগ বি প্রকল্পসহ জাপানের সঙ্গে সই হওয়া চুক্তিগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাপানের বিনিয়োগে বাংলাদেশে এলে দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় বাজারেই ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর পরবর্তী ৩ বছর অতিরিক্ত মার্কেট অ্যাকসেসের সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, জাপানের সঙ্গে এমন কোনো আলাপ-আলোচনা হয়েছে কি না আমি জানি না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সফরে এর বাইরে যেসব কর্মকা- ঘটেছে তা আমাদের অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। জাপান এখন বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিশেষ করে দেশটি চীন থেকে তাদের শিল্পকারখানা সরিয়ে এনে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। আমাদের মাতারবাড়ী, ঢাকার কাছে আড়াইহাজারে করতে চাচ্ছে। যদি আমরা জাপানের আগ্রহের সুযোগকে কাজে লাগাতে চাই তা হলে এসব জায়গায় তাদের ওয়ান স্টপ সার্ভিস, নিষ্কণ্টক জমি এবং অন্য সেবাগুলোও দিতে হবে। কেননা এরই মধ্যে জাপান বাংলাদেশের বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিয়ে অসন্তোষ জানিয়েছে। তারা যাতে স্থানীয়ভাবে দক্ষ কর্মী পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। এ সফরের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশের উন্নয়নের পথ সুগম করার যে মেকানিজম সৃষ্টি করেছেন তা কার্যকর করতে হলে আমাদের এসব ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে। 

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর সফরে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের যে উন্নয়ন ঘটেছে তাও খুব গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এর আগে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের বিরোধ হয়েছে; তারপরও বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সঙ্গে আছে এবং এখন তারা বাংলাদেশের যে ৫ প্রকল্পে বিনিয়োগের কথা বলেছে তা দেশের উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আসলে প্রধানমন্ত্রীর যা করার প্রয়োজন তিনি করেছেন, এখন আমাদের অভ্যন্তরীণ ও প্রাতিষ্ঠানিক যে দায়িত্ব আছে তা নিশ্চিতভাবে পালন করতে হবে। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও রাষ্ট্রদূত মো. মাহফুজুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরে দুই দেশের মধ্যে আটটি চুক্তি ও সমাঝোতা হয়েছে। কিন্তু দুই পক্ষের বৈঠকের রেজাল্ট হচ্ছে সফরের যৌথ বিবৃতি। জাপান সফরের যৌথ বিবৃতি দেখে আমি কিছুটা হতাশ। কারণ যৌথ বিবৃতিতে জাপানের রাজনৈতিক উপাদানগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যেমন জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা, উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ চীন সাগর-এগুলো জাপানের রাজনৈতিক ইস্যু। বিবৃতিতে জাপানের রাজনৈতিক ইস্যু যেভাবে গুরুত্ব পেয়েছে সেখানে আমাদের ইস্যু সেভাবে গুরুত্ব পায়নি; যেমন রোহিঙ্গা সংকট। ওয়াশিংটন সফরটা ছিল মাল্টিলেটারাল কন্টেন্ট রিলেটেড। হেড অব স্টেটের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের মতো বৈশি^ক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সদর দফতরের বৈঠকে যাওয়া সচরাচর ঘটে না। নিশ্চয়ই এ ক্ষেত্রে কোনো আন্তর্জাতিক অর্থনীতির মারপ্যাঁচের বিষয় আছে। সে কারণে প্রধানমন্ত্রী সেখানে গেছেন। বিষয়টি নিশ্চয়ই সরকার জানাবে। প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সফর ছিল যুক্তরাজ্য, এটি ভালো সফর ছিল। কেননা এমন সফরে অনেক রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়। - সময়ের আলো ।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;