নতুন নকশায় নির্মিত হচ্ছে সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপো, হচ্ছে আরও নতুন কন্টেইনার ডিপো

নতুন নকশায় নির্মিত হচ্ছে সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপো, হচ্ছে আরও নতুন কন্টেইনার ডিপো
নতুন নকশায় নির্মিত হচ্ছে সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপো, হচ্ছে আরও নতুন কন্টেইনার ডিপো

বিশেষ প্রতিবেদক ।।

বিএম কন্টেইনার ডিপো নতুন নকশায় ফের নির্মাণ হচ্ছে। এরইমধ্যে নতুন নকশা অনুযায়ী নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে বলে জানান বিএম কন্টেইনার ডিপোর জেনারেল ম্যানেজার ক্যাপ্টেন (অব.) মাইনুল আহসান খান। 

অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত বিএম কন্টেইনার ডিপো বুধবার (২৮ সেপ্টেম্বর) সকালে এইচঅ্যান্ডএম ও মার্সক লাইনের দুই গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান দুটির কান্ট্রি ম্যানেজারসহ প্রায় ২০ জনের প্রতিনিধিদল ডিপো পরিদর্শনের সময় তিনি একথা বলেন।

তিনি বলেন, আমরা পুরো ডিপোটি রি-কন্সট্রাকশন (পুনর্নির্মাণ) করছি। এরইমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। ডিপোর ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। এগুলো ভেঙে নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে। সে কারণে বিষয়টি অবগত করে বন্দর, কাস্টমস, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদফতর, পিডিবি, সীতাকুণ্ড থানা, বিস্ফোরক অধিদফতরসহ ১০ প্রতিষ্ঠানকে আমরা চিঠি দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, ওই প্রতিনিধিদল ডিপো পরিদর্শনের সময় দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে ডিপো কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপসহ পুনর্নির্মাণে নিরাপত্তার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখেন তারা। পরে সার্বিক বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।

প্রতিনিধিদলে ছিলেন, এইচঅ্যান্ডএমের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ম্যাটস স্যামুয়েলসন, সুইডেন থেকে এইচঅ্যান্ডএমের বিজর্ন ব্লোমেগ্রেন, বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশের পাবলিক অ্যাফেয়ার্স ক্যালেবো অ্যানেলি, গুলশান আরা মুন্নি, ফ্রান্সিস গোমেজ এবং মার্সক লাইনের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্লাউস কোয়েলার্ট প্যাগ, সুইডেন থেকে সোফিয়া পার্টোভি, নেদারল্যান্ড থেকে কার্লিন ভ্যান ডের মার্ক, অ্যাক্তা কোহলি, মানব মেহতা, অভিজিৎ পাল, রাশেদুজ্জামান রানা প্রমুখ।

এসময় বিএম ডিপোর সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) তৌফিকুল ইসলাম, ডিজিএম নুরুল আকতারসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বিএম ডিপোর কর্মকর্তারা জানান,  গত ৪ জুন রাত সাড়ে ৯টায় বিস্ফোরণের পর থেকে ডিপোর অপারেশনাল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে চিঠি দিয়ে ডিপোর অপারেশনাল কার্যক্রম বন্ধ রাখে কাস্টমস কর্তৃপক্ষও। দুর্ঘটনার পর গঠিত হয় বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটিগুলো তাদের কাজ এখনো শেষ না করলেও বন্দর ও কাস্টমসের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ডিপোতে থাকা কন্টেইনারগুলো পরীক্ষার কাজ শুরু করেছে ডিপো কর্তৃপক্ষ। 

এরই মধ্যে পণ্যভর্তি ১৫০০ টিইইউস কন্টেইনার অক্ষত হিসেবে পাওয়া গেছে। তন্মধ্যে ৮৫০ টিইইউস রফতানি পণ্য এবং বাকিটা আমদানি পণ্য। এসব পণ্যের মধ্যে তৈরি পোশাক, নিটওয়্যার, অ্যাগ্রো প্রসেস ফুডসহ বিভিন্ন ধরনের রফতানি পণ্য রয়েছে। পাশাপাশি খাদ্যসামগ্রীসহ শিল্পের বিভিন্ন কাঁচামাল বাদেও রয়েছে প্যাকেজিং সামগ্রীও।

গত কয়েকদিন আগে ডিপোর অপারেশনাল কার্যক্রম চালু করার জন্য বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ। তবে এসব পণ্য খালাস কিংবা রফতানির বিষয়ে এখনো কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কোনো সাড়া দেয়নি।

আমদানি ও রফতানি খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা বলছেন, আমদানি করা কাঁচামাল না পাওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া রফতানি পণ্যগুলোর জাহাজীকরণের মেয়াদ পেরিয়ে যাচ্ছে। চুক্তি মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে পণ্য পাঠাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে অর্ডার হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া রফতানি পণ্যের মধ্যে অনেক পচনশীল খাদ্যপণ্য থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়েছে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রফতানিকারকরাও।

এ বিষয়ে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান বলেন, দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখে চট্টগ্রাম বন্দর। চট্টগ্রাম বন্দরকে গতিশীল রেখেছে আমাদের অফডকগুলো। ৩৮টি আমদানি পণ্য খালাস হয় অফডক দিয়ে। এই ৩৮ পণ্যের মধ্যে কোনো ডেঞ্জারাস গুডস-ডিজি (বিপদজ্জনক পণ্য) নেই। তবে অফডকগুলোর মাধ্যমে শতভাগ রফতানি পণ্য জাহাজীকরণ হয়।

তিনি বলেন, বিএম কন্টেইনার ডিপোতে যে দুর্ঘটনা হয়েছে তা অপ্রত্যাশিত। এরইমধ্যে প্রায় চার মাস অতিবাহিত হতে চলেছে। ডিপোতে অক্ষত অনেক কন্টেইনার রয়েছে। আমদানি, রফতানি পণ্য রয়েছে। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এসব আমদানি পণ্য যেমন খালাস করা জরুরি, তেমনি রফতানি পণ্যগুলোও পাঠানো প্রয়োজন। এজন্য বিকডার পক্ষ থেকে আমরা বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং কাস্টমসকে চিঠি দিয়েছি। আমরা অনুরোধ করেছি কাস্টমস অথরিটির সুপারভিশনের মাধ্যমে বিএম ডিপোতে থাকা অক্ষত আমদানি পণ্যগুলো খালাস এবং রফতানি পণ্যগুলো শিগগির শিপমেন্টের উদ্যোগ নিতে। রাষ্ট্রের স্বার্থে, দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এখন ডিপোটির অপারেশনাল কার্যক্রম চালু করা প্রয়োজন।

এদিকে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ডিপোর অভ্যন্তরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা চালাচ্ছে ডিপো কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসার পাশাপাশি হতাহতদের জন্য সহায়তায় প্রতিশ্রুত অর্থের প্রায় ১৮ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ।

উল্লেখ্য, গত ৪ জুন বিএম ডিপোতে আগুন লাগে। পরে সেখানে থাকা রাসায়নিকভর্তি কন্টেইনারের বিস্ফোরণ ঘটে। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় ৫১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ৩৯ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি ১২ জনের মরদেহ শনাক্তে কাজ করছে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের ডিএনএ বিভাগের টিম। 

চট্টগ্রামে হচ্ছে আরও দুটি নতুন কন্টেইনার ডিপো: 

চট্টগ্রামে আরও দুটি বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ডিপো দুটি প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছে। একটির নাম বে-লিংকস কন্টেইনার লিমিটেড, অপরটি অ্যাংকোরেজ লিমিটেড।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপকমিশনার মো. মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, বে-লিংকস কন্টেইনার লিমিটেড ও অ্যাংকোরেজ লিমিটেড নামের দুটি বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। কন্টেইনার ডিপো দুটি চালু হলে বর্তমানে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোর সংখ্যা দাঁড়াবে ২১ টিতে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামের বাড়বকুণ্ড এলাকায় ২০ একর জমির ওপর বে-লিংকস কন্টেইনার লিমিটেড ডিপোটি গড়ে তোলা হচ্ছে। যেখানে প্রায় মোট ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ হবে। এ ডিপো চালু হলে সাড়ে ৪ হাজার একক কন্টেইনার ওঠানো-নামানো এবং রাখা সম্ভব হবে। ঢাকার একটি পোশাক কারখানা এ ডিপো নির্মাণ করছে। গত বছরের ২৪ অক্টোবর সেটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুমোদন পায়।

অন্যদিকে অ্যাংকোরেজ লিমিটেড নামের অন্য বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোটি চট্টগ্রামের টোল রোডের পাশে স্থাপন করা হচ্ছে। অ্যাংকোরেজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফয়সাল আমিন বলেন, আমাদের ডিপোটি সরকারি নিয়ম কানুন মেনে নির্মাণ করা হচ্ছে। সমস্ত স্থাপনা নির্মাণ ও প্রক্রিয়া শেষে মূল অপারেশনে যাবে। তবে কখন মূল কার্যক্রম শুরু হবে তা তিনি বলতে পারেননি। 

বে-লিংকস কন্টেইনার লিমিটেডের কর্মকর্তা মো. সোলাইমান বলেন, প্রথমে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী খালি কন্টেইনার দিয়ে কার্যক্রম শুরু করতে হয়। পরে মূল কার্যক্রমে যেতে হয়।

কাস্টমস সূত্র জানায়, বর্তমানে ৩৮ ধরনের আমদানিপণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে আসা জাহাজ থেকে নামিয়ে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে নিয়ে খালাস হয়। এছাড়া সব ধরনের রফতানি পণ্য বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো হয়েই বন্দর জেটিতে যায়। সেখান থেকেই জাহাজে তোলা হয়।

বন্দর উপদেষ্টা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, চট্টগ্রাম শহরে যানজট কমাতে বন্দর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো স্থাপনের অনুমতি আছে। নতুন করে যেসব ডিপো হবে সেগুলোর ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে। সেই সঙ্গে বিদ্যমান ডিপোগুলোকে সরিয়ে ২০ কিলোমিটার দূরে নিয়ে যেতে হবে।

সে দিক থেকে এখন সবচেয়ে দূরে (২৬ কিলোমিটার) আছে নেমসান কন্টেইনার ডিপো। আর কেডিএস কন্টেইনার ডিপো ২৩ কিলোমিটার দূরে। মূলত চট্টগ্রাম শহরের পর পণ্যবাহী গাড়ির চাপ কমাতেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বন্দর উপদেষ্টা কমিটি।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, চট্টগ্রামে বর্তমানে ১৯টি ডিপোতে ৬৫-৭০ হাজার খালি কন্টেইনার রাখতে পারে। নতুন ডিপো দুটি চালু হলে পণ্য রফতানিতে সক্ষমতা আরও একধাপ বেড়ে যাবে। সময়ের আলো ।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;