জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান - বাংলাদেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলাম প্রচার-প্রসারের স্থপতি

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান - বাংলাদেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলাম প্রচার-প্রসারের স্থপতি
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান - বাংলাদেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলাম প্রচার-প্রসারের স্থপতি

তাশফিক মুহাম্মদ।।

মুসলিম প্রধান দেশবাংলাদেশ। এ দেশের মানুষও ধার্মিক। ধার্মিক ছিলেন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও। তিনি ছিলেন উদার চেতনার অধিকারী একজন খাঁটি মুসলমান। বাংলাদেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামের প্রচার-প্রসারে তাঁর ভ‚মিকা অসামান্য।

বঙ্গবন্ধুর পূর্বপুরুষ শেখ আউয়াল ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে হজরত বায়জিদ বোস্তামী (রা.)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তাঁর সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশে আসেন প্রথম। পরবর্তীতে তাঁরই উত্তরপুরুষেরা বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় বসতি স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন ইসলাম প্রচারক শেখ আউয়ালের সপ্তম বংশধর। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন একজন সুফি চরিত্রের অধিকারী অন্যতম ধর্মপ্রাণ মুসলমান।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে সব ধর্মের সব মানুষের জন্য শান্তির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে ছিলেন সদাসচেষ্ট। তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত শাসনামলে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি যেমন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, তেমনি বাংলাদেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামের প্রচার-প্রসারের স্থপতিও। ইসলাম প্রচার-প্রসারে বঙ্গবন্ধুর অবদানসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে তুলে ধরা হলো।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে একদিকে যেমন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনে মনোযোগ দিলেন, অন্যদিকে সহিহ ইসলাম প্রচার, প্রসার এবং গবেষণার জন্য ১৯৭৫ সালে সরকারিভাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। এই ফাউন্ডেশন এখন সরকারি অর্থে পরিচালিত অন্যতম একটি বৃহৎ ইসলামিক সংস্থা। এ প্রতিষ্ঠান থেকে এ পর্যন্ত পবিত্র কোরআনের বাংলা তরজমা, তাফসির, হাদিস গ্রন্থের অনুবাদ, রাসুল (সা.)-এর জীবন ও কর্মের ওপর রচিত ও অনূদিত গ্রন্থ, ইসলামের ইতিহাস, ইসলামী আইন ও দর্শন, ইসলামী অর্থনীতি, সমাজনীতি, সাহাবি ও মনীষীদের জীবনী ইত্যাদি নানা বিষয়ে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠান ঢাকার প্রধান কার্যালয়সহ সারা দেশের ৬৪টি জেলা কার্যালয়, আর্তমানবতার সেবায় ২৮টি ইসলামিক মিশন, সাতটি ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির মাধ্যমে নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। বৃহত্তর কলেবরে ২৮ খÐে ইসলামী বিশ^কোষ, ১২ খÐে সিরাত বিশ^কোষ প্রকাশ করে ধর্মতাত্তি¡ক জ্ঞানের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছে।

মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন
ইসলামী আকিদাভিত্তিক জীবন গঠন ও দ্বীনি শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুই প্রথম মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে এর নাম রাখেন বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। জাগতিক শিক্ষার সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষার আধুনিকীকরণের পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চতর শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করা এবং মাদ্রাসা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা ও যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করেছিলেন।

বিশ^ ইজতেমার স্থান বরাদ্দ
বিশ^ ইজতেমা শান্তিপূর্ণভাবে পালন করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম স্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে তুরাগ নদীর তীরবর্তী জায়গাটি প্রদান করেন। সে থেকে অদ্যাবধি তাবলিগ জামাত ওই স্থানে বিশ^ ইজতেমা পালন করে আসছে। টঙ্গীতে বঙ্গবন্ধু এই স্থান বরাদ্দের বদৌলতেই বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তের লাখ লাখ মুসলিম এখানে সমবেত হয়ে ইসলামের দ্বিতীয় বৃহৎ সম্মেলন করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া তাবলিগ জামাতের কেন্দ্র নামে পরিচিত কাকরাইল মসজিদের সম্প্রসারণের দরকার হলে তখন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু নির্দ্বিধায় কাকরাইল মসজিদকে সরকারি জায়গা বরাদ্দ দিয়ে এর সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করে দেন।

আরব বিশে^র পক্ষে সমর্থন ও সাহায্য প্রেরণ
১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু আরব বিশ্বের পক্ষে সমর্থন করেন এবং এ যুদ্ধে বাংলাদেশ তার সীমিত সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ অবদান রাখার চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমর্থনে এক লাখ পাউন্ড চা, ২৮ সদস্যের মেডিকেল টিমসহ একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী পাঠানো হয়।

ওআইসি সম্মেলনে যোগদান
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুসলিম বিশে^র সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) অধিবেশনে যোগদান করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে এই সংস্থার অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়েই বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মাঝে বাংলাদেশের স্থান করে নেন। ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করে ইসলাম ও বাংলাদেশ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু মুসলিম নেতাদের সামনে যে বক্তব্য তুলে ধরেন এতে আরবসহ মুসলিম বিশে^ বাংলাদেশের ভাব উজ্জ্বল হয় এবং মুসলিম বিশ্বের নেতাদের সঙ্গে সুদৃঢ় ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে ওঠে।

রাশিয়ায় তাবলিগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা
রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়নে বিদেশ থেকে কেউ গিয়ে ইসলাম প্রচারের সুযোগ পেত না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার সুসম্পর্কের সুযোগ নিয়ে ইসলাম প্রচারের জন্য সর্বপ্রথম তাবলিগ জামাতের একটি দল রাশিয়াতে প্রেরণের ব্যবস্থা করেন।

সিরাত মজলিশ প্রতিষ্ঠা
বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় সিরাত মজলিশ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। সিরাত মজলিশ ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে রবিউল আউয়াল মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বৃহত্তর আঙ্গিকে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) মাহফিল উদযাপনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। সরকারপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু বায়তুল মোকাররম মসজিদ চত্বরে মাহফিলের শুভ উদ্বোধন করেছিলেন।

বেতার-টেলিভিশনে ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রচার
বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে তারই নির্দেশে সর্বপ্রথম বেতার ও টেলিভিশনে গুরুত্বের সঙ্গে পবিত্র কোরআন ও তার তাফসির এবং অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রচার করার সুব্যবস্থা করেন।

ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসে সরকারি ছুটি ঘোষণা
ধর্মীয় দিবসসমূহ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাংলাদেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন এবং সেসব দিবসের পবিত্রতা রক্ষার্থে সিনেমা হল বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেন।

মদ-জুয়া নিষিদ্ধকরণ ও শাস্তির বিধান
ইসলামে মদ-জুয়া সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। ইসলামের এই বিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারিভাবে আইন করে এসব অপকর্ম নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং শাস্তির বিধান জারি করেছিলেন। ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এসব যুগান্তকারী অবদানের কথা বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষভাবে তার রূহের মাগফেরাত কামনা করি এবং মহান আল্লাহর দরবারে তার ও তার পরিবারের শহীদদের জন্য জান্নাত প্রার্থনা করি।