ছবি ছাড়া পর্দানশীন নারীদের জাতীয় পরিচয়পত্র করতে না দেয়া অসাংবিধানিক - মহিলা আনজুমান

ছবি ছাড়া পর্দানশীন নারীদের জাতীয় পরিচয়পত্র করতে না দেয়া অসাংবিধানিক - মহিলা আনজুমান
ছবি ছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্র করতে না দেয়া অসাংবিধানিক - মহিলা আনজুমান

পোস্টকার্ড ডেস্ক ।।

'ছবি ছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্র করতে না দেয়া বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে অসাংবিধানিক'- এমন দাবি করে পর্দার বিধান মেনে পর্দানশীন নারীদের পরিচয় সনাক্তের ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাব প্রদান করেছে রাজারবাগ দরবার শরীফের মহিলা আনজুমান। জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম মিলনায়তনে সোমবার (২১ মার্চ) এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানায় তারা। সংবাদ সম্মেলনে আলোচকরা জানান, পর্দানশীন মহিলাদের পর্দার সঙ্গে সকল রাষ্ট্রীয় সুবিধা ও নাগরিক অধিকার সুনিশ্চিত করা উচিত।

সংবাদ সম্মেলনে আলোচক হিসেবে ছিলেন রাজারবাগ দরবার শরীফের মহিলা আনজুমানের সদস্য ও অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক শারমিন ইয়াসমিন। তিনি জানান, ছবি থেকে পরিচয় সনাক্তকরণের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বলেই বর্তমানে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এ কারণেই ছবির বদলে সর্বক্ষেত্রে পরিচয় সনাক্তে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি প্রবর্তনের দাবি জানায় সংগঠনটি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে অসংখ্য পর্দানশীন মহিলা আছেন, যারা পবিত্র কোরআন-সুন্নাহ অনুসারে পরিপূর্ণ পর্দা করার চেষ্টা করেন। তারা কোন গায়েরে মাহরামকে চেহারা দেখান না। অথচ রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেতে জাতীয় পরিচয় পত্রসহ বিভিন্ন কাগজ করার সময় সনাক্ত করার জন্য চেহারা খুলে ছবি তুলতে হয় এবং গায়েরে মাহরাম পুরুষকে তার চেহারা দেখিয়ে পরিচয় নিশ্চিত করতে হয় এটি তার ছবি। পর্দানশীন হওয়ায় এসব মহিলারা চেহারা খুলে ছবি তুলছেন না বা গায়েরে মাহরাম পুরুষকে চেহারা দেখাচ্ছেন না। এতে তারা জাতীয় পরিচয়পত্রসহ কোন সরকারি কাগজ তৈরি করতে পারছেন না এবং কোন নাগরিক অধিকারও লাভ করতে পারছেন না।

শারমিন ইয়াসমিন বলেন, পরিস্থিতি বেশি জটিল হয়ে উঠছে বিধবা, তালাকপ্রাপ্তা মহিলা বা প্রবাসীদের স্ত্রীদের জন্য। কারণ সামান্য সহযোগিতার জন্য তারা নিকটস্থ মাহরাম পুরুষকে কাছে পাচ্ছেন না। এমন অবস্থায় সন্তান-সন্ততি নিয়ে জীবন ধারণ তাদের জন্য বেশ জটিল হয়ে উঠেছে।

আলোচনার সময় উপস্থিত ছিলেন রহিমা আহমদ নামক একজন বিধবা, ত্বহিরা জাহান নামক একজন প্রবাসীর স্ত্রী, শিল্পী আহমদ নামক একজন স্বামী পরিত্যক্তা এবং মার্জিয়া আহমদ নামক একজন অসুস্থ ব্যক্তির স্ত্রীর। তারা প্রত্যেকেই পর্দানশীন মহিলা হওয়ায় চেহারা খুলে ছবি তুলে জাতীয় পরিচয়পত্র করতে পারেনি, যাদের নিকটস্থ মাহরাম পুরুষ না থাকায় তাদের প্রত্যেকের জীবনে তৈরি হয়েছে মানবিক সংকট।

সংবাদ সম্মেলনের আলোচক আরো বলেন, কোরআন সুন্নাহ অনুসারে পরিপূর্ণ পর্দা করার কারণে মুখ খুলে ছবি তুলতে রাজি না হওয়ায় এরকম আরো অনেক পর্দানশীন নারী অনেক রাষ্ট্রীয় সুবিধা ও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যেমন: সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করা, চাকরির আবেদন করা, অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটা, বাসা ভাড়া নেয়া, সম্পত্তির উত্তরাধিকার হওয়া, জমি রেজিস্ট্রি করা, সন্তানের বৃত্তির টাকা উত্তোলন করা, সন্তান স্কুলে ভর্তি করানো, ব্যাংক লেনদেন করা, জমি ক্রয়-বিক্রয় করা, ওএমএস কার্ড করা, স্বামীর পেনশনের টাকা তোলা, জরুরি কাজে বাহিরে গেলে হোটেল ভাড়া করা, ট্রেড লাইসেন্স করা, বিদ্যুৎ বিল দেয়া, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা তোলা, মোবাইল ব্যাংকিং করা, দেশের অভ্যন্তরে প্লেনের টিকিট কাটা, সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করা এবং নমিনি হওয়া।

শারমিন ইয়াসমিন বলেন, সংবিধানের মৌলিক অধিকার অংশের ৪১ (১) অনুচ্ছেদের- (ক) অংশে বলা হয়েছে, 'প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে'। সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ অনুসারে একজন পর্দানশীন মহিলার পরিপূর্ণ পর্দা করার অধিকার রাষ্ট্রই তাকে দিয়েছে এবং পর্দা করাকে তার মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সংবিধানের এ অনুচ্ছেদকে লঙ্ঘন করে জাতীয় পরিচয় পত্রসহ বিভিন্ন কাগজপত্র তৈরিতে সনাক্তকরণের নামে মহিলাদের ধর্ম পালনের অধিকার হরণ করা হচ্ছে, তাও একটি অযৌক্তিক কারণ অর্থাৎ চেহারার ছবি দেখে সনাক্তকরণ করতে গিয়ে। অথচ পরিচয় সনাক্তকরণে ছবি নির্ভুল কোন মাধ্যমই না। পৃথিবীতে দুই জন মানুষের চেহারা প্রাকৃতিকভাবেই এক রকম হতে পারে। যেমন, দুই যমজ ভাই বা দুই যমজ বোনের চেহারা এক রকম হতে পারে। আবার কৃত্রিম উপায়েও দুইজনের চেহারা এক রকম করা সম্ভব। পাশাপাশি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে একজন মানুষের চেহারায়ও ভিন্নতা আসতে পারে। যেমন- বয়স, স্বাস্থ্য ও শারীরিক অবস্থার ভিন্নতার কারণে একজনের চেহারার ছবিতে অমিল লক্ষ্য করা যায়। এ সমস্ত কারণে সনাক্তকরণে নির্ভুলতার দণ্ডে ছবি অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। উপরন্তু ছবিকে সনাক্তকরণের মাধ্যম করায় অনেক অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে এবং নিরপরাধ লোক নির্যাতিত হচ্ছে। যেমন: ২০১৯ সালে আলোচিত জাহালম নামক এক ব্যক্তির কথা আপনাদের মনে থাকার কথা। ব্যাংক জালিয়াত সালেকের সঙ্গে চেহারায় মিল থাকায় যিনি ৩ বছর বিনা অপরাধে জেল খেটেছিলেন।

সনাক্তকরণে ছবির ব্যর্থতায় আধুনিক যুগে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি বহুল ব্যবহৃত হয়ে উঠেছে দাবি করে শারমিন ইয়াসমিন বলেন, প্রযুক্তি নির্ভর এ পদ্ধতিতে সনাক্তকরণ প্রায় শতভাগ নির্ভুল। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সনাক্তকরণে কখনই দুই ব্যক্তির মধ্যে মিল পাওয়া যায় না। বয়স বা শারীরিক অবস্থার সাথেও এই পদ্ধতিতে কোন তারতম্য ঘটে না। উদাহরণস্বরূপ: বায়োমেট্রিক পদ্ধতি, যেমন- ফিঙ্গারপ্রিন্ট সনাক্তকরণ নিয়ে বলা যায়; পৃথিবীতে যদি ৭০০ কোটি মানুষ থাকে, তবে একজনের সাথে অন্যজনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট কখনই মিলবে না। এমনকি দুইজন যমজ ব্যক্তিরও ফিঙ্গারপ্রিন্ট হবে ভিন্ন। তাই আধুনিক যুগে অপরাধী সনাক্তকরণে ফিঙ্গারপ্রিন্ট অধিক গ্রহণযোগ্য ও নির্ভুল মাধ্যম হিসেবে বিশ্বজুড়ে বহুল ব্যবহৃত হচ্ছ।

তিনি বলেন, ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহারের সুবিধাও অনেক। একজন মানুষ কোথাও গেলে আইডি কার্ড ভুলে বাসায় ফেলে আসতে পারে, হারিয়েও ফেলতে পারে। কিন্তু হাতের আঙ্গুল কখনই সে ফেলে আসে না বা হারিয়ে ফেলে না। মূলত: ছবি দিয়ে সনাক্তকরণ পদ্ধতি ত্রুটিযুক্ত হওয়ার কারণেই 'জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০'- এ ছবি দিয়ে সনাক্তকরণের বদলে বায়োমেট্রিক সনাক্তকরণকেই গ্রহণ করা হয়েছে। তারপরও ছবির মত একটি পুরাতন ও ত্রুটিযুদ্ধ পদ্ধতি ধরে রাখার জন্য অসংখ্য পর্দানশীন মহিলার মৌলিক অধিকার হরণ করা হচ্ছে, বঞ্চিত করা হচ্ছে রাষ্ট্রের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি থেকে, যা সত্যিই একটি অমানবিক বিষয়।

এ সময় আলোচকগণ সরকার ও প্রশাসনের কাছে ২টি দাবি উত্থাপন করেন। তাদের প্রথম দাবি, পর্দানশীন মহিলাদের সনাক্তকরণে পর্দার বিধান লঙ্ঘন হয় না, এমন পদ্ধতিতে জাতীয় পরিচয় পত্র, জমি রেজিস্ট্রেশন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ওএমএস কার্ড, বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতা কার্ড ইত্যাদি তৈরির ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সনাক্তকরণে পুরাতন ও ত্রুটিপূর্ণ ছবি পদ্ধতির বদলে আধুনিক ও আইনসম্মত বায়োমেট্রিক পদ্ধতি (যেমন ফিঙ্গারপ্রিন্ট) ব্যবহার করতে পারে।

তাদের দ্বিতীয় দাবি, সরকারি অফিস বা কার্যালয়ে পর্দানশীন মহিলাদের সঙ্গে যোগাযোগ/আদান-প্রদান বা সনাক্তকরণের জন্য নারী কর্মকর্তা/কর্মচারীর ব্যবস্থা রাখতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন রাজারবাগ দরবার শরীফের মহিলা আনজুমানের সদস্য সুমাইয়া আহমদ, মাশহুরা ফিরদাউসীসহ আরো শতাধিক পর্দানশীন মহিলা। - সময়ের আলো

খালেদ / পোস্টকার্ড ;