কবির স্টিল শীপ ইয়ার্ডে মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা, শ্রমিক মারধরের অভিযোগে সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা

কবির স্টিল শীপ ইয়ার্ডে মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা, শ্রমিক মারধরের অভিযোগে সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা

কাইয়ুম চৌধুরী, সীতাকুন্ড।।

কেএসআরএম গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সীতাকুন্ডের কবির স্টিল শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা, শ্রমিকদের মারধর, পাওনা না দেওয়া এবং ইয়ার্ডের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জাহাজ ভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরাম।

কেএসআরএম শিপ ইয়ার্ডসহ বিগত দিনে সংগঠিত সকল দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে ১২ দফা দাবি জানানো হয়েছে। এসব দাবির সমর্থনে ১০ এপ্রিল চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও শ্রমিক সমাবেশ এবং পরবর্তী সপ্তাহে সীতাকুন্ড উপজেলার মাদাম বিবিরহাট এলাকায় কেএসআরএম ইয়ার্ডের সামনে একই কর্মসূচি পালন, শিল্প মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি প্রদানের কমসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।

শনিবার সকালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের এস রহমান হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ তুলে ধরে কর্মসূচি ঘোষণা করেন সংগঠনের আহ্বায়ক তপন দত্ত। শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় অব্যাহতভাবে শ্রমিক নিহত ও আহতের প্রতিবাদে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এদিকে সংবাদ সম্মেলন বন্ধ করতে কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করেছে।

অভিযোগ করে লিখিত বক্তব্যে তপন দত্ত বলেন, আমরা কেন সংবাদ সম্মেলন করছি; সেটা নিয়ে কয়েকদিন ধরে পাগল বানিয়ে ফেলতেছে। কিন্তু আমরা শ্রমিকদের দাবি আদায়ের স্বার্থে পিছপা হইনি। গত ১ ফেব্রুয়ারি ইয়ার্ডে কাজ করার সময় লোহার পাত পড়ে সুজন নামে একজন শ্রমিক নিহত হন জানিয়ে তিনি বলেন, পুলিশের সুরতহাল রিপোর্ট ও ময়না তদন্তে দুর্ঘটনায় মুত্যুর বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। কিন্তু কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে নানামুখি অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।

শ্রমিক অসুস্থ হয়ে বমি করে নিচে পড়ে মৃত্যু হয়েছে; কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের এমন মন্তব্যের সমালোচনা করে তপন দত্ত বলেন, অধিদপ্তরের এমন বয়ান মালিকপক্ষের অপতৎপরতাকে সমর্থন করে। এ বক্তব্য ময়না তদন্ত, হাসপাতাল ও পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, কেএসআরএম ইয়ার্ডে শ্রমিক নিহতের ঘটনায় ১৪ ফেব্রুয়ারি ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে শিল্প মন্ত্রণালয়। অতীতের মতো এবারের কমিটিতেও কোন শ্রমিক প্রতিনিধিকে রাখা হয়নি। এমনকি গঠিত তদন্ত কমিটি শ্রমিক পক্ষের কোন বক্তব্য নেয়নি। ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও এখনো কমিটির রিপোর্টের কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। ফলে তদন্ত রিপোর্ট নিয়েও শ্রমিকদের মধ্যে হতাশা ও সংশয় তৈরি হয়েছে। এছাড়া দুর্ঘটনার পর শিল্প মন্ত্রণালয় ইয়ার্ড বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলেও মালিকপক্ষ তা পালন না করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সুজন নামে এক শ্রমিককে সীতাকু-ের মাদাম বিবিরহাট এলাকায় কবির শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে চাকরিচ্যুত করা হয় জানিয়ে তপন দত্ত বলেন, ওই শ্রমিক প্রতিকার চেয়ে মালিক বরাবর গ্রিভান্স দরখাস্ত দিলে তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়।

ফোরামের পক্ষ থেকে কয়েকবার মালিকপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেও কোন সুরাহা করা যায়নি। ১২ দফা দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা এবং আহত হয়ে কাজে অক্ষমদের ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান, বিএসবিআরএ-এর ব্যবস্থাপনায় শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের কেন্দ্রিয় ডাটাবেজ সংরক্ষণ, ইয়ার্ড সমূহে আধুনিক, নিরাপদ যন্ত্রপাতি ব্যবহার নিশ্চিত করা, কাটার আগে জাহাজকে পূর্ণাঙ্গভাবে বর্জ্যমুক্ত করা, দেশের প্রচলিত শ্রম আইন ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক কনভেনশন স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিতকরণ, ২০১৮ সালের ঘোষিত মজুরি বোর্ডের রোয়েদাদ অনুযায়ী ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা এবং দৈনিক মজুরি ৬১৫ টাকা কার্যকর করা, ইয়ার্ডকে নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তপন দত্ত বলেন, আমরা শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করি। যখন যে প্রতিষ্ঠানে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে, পাওনা আদায় করে না, শ্রমিকদের মারধর করে সেই পরিস্থিতিতে দাবি আদায়ে মাঠে নামি। এখানে আমাদের কোন পক্ষ নেই; কোন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও আমরা কথা বলছি না। সাম্প্রতিক সময়ে কেএসআরএম শিপ ইয়ার্ডে ঘনঘন দুর্ঘটনা, পাওনা না দিয়ে মারধরের ঘটনা বাড়ার কারণেই সংবাদ সম্মেলন করতে বাধ্য হয়েছি। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সীতাকুন্ড উপজেলার বঙ্গোপসাগরের সীতাকুন্ডের উপকূলে ১৫০টির বেশি ইয়ার্ডের রেজিস্ট্রেশন থাকলেও ৫০ থেকে ৬০টি সক্রিয়। এ শিল্পে ২০ থেকে ২৫ হাজার শ্রমিক কাজ করে। ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে দুর্ঘটনায় ৯৭ জন শ্রমিক নিহত এবং ১২৭ জন আহত হয়েছে। বিগত সময়ে নিহত ৯৭ জন শ্রমিকের পরিবার পাওনা পেয়েছে কিনা? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আগের সব ঘটনার দেনা-পাওনা সমাধান হয়েছে। কিন্তু কেএসআরএম পাওনা দিচ্ছে না আবার শ্রমিকদের মারধর করছে। সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক মু. শফর আলী, এএম নাজিম উদ্দিন, সদস্য শফি বাঙালি, কোষাধ্যক্ষ রিজওয়ানুর রহমান খান, কেএম শহিদুল্লাহ, মো. নুরুল আবসার, ফজলুল কবির মিন্টু, ইফতেখার কামাল খান ও মোহাম্মদ আলী উপস্থিত ছিলেন।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;