আজ সেই ভয়াল ১৭ আগস্ট, ১৫ বছরেও শেষ হয়নি সিরিজ বোমা হামলার বিচার

আজ সেই ভয়াল ১৭ আগস্ট, ১৫ বছরেও শেষ হয়নি সিরিজ  বোমা হামলার বিচার

আলমগীর হোসেন, ঢাকা ।।

আজ সেই ভয়াল ১৭ আগস্ট। ২০০৫ সালের এদিনে মুন্সীগঞ্জ ছাড়া দেশের ৬৩ জেলায় ৪৩৪ স্থানে একযোগে বোমা হামলা চালায় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গিরা। জঙ্গিদের সেই সিরিজ বোমা হামলার ১৫ বছর পূর্তি হলেও এখনও প্রায় ৪৭টি মামলা দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। এরই মধ্যে সাক্ষী ও আসামিদের নাম-পরিচয়সহ নানা তথ্যপ্রমাণের অভাবে ঢাকার ১৭টি মামলার ৮টিরই ফাইনাল রিপোর্ট (চুড়ান্ত প্রতিবেদন) জমা দিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া ৪টি মামলার রায় ঘোষণা বোমা হামলার বিচার এবং ৫টি মামলা এখনও বিচারাধীন রয়েছে।

জঙ্গি তৎপরতা প্রসঙ্গে এলিটফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমরা মনে করি না যে জঙ্গিরা সেই সিরিজ বোমা বা তেমন বড় কোনো হামলা চালানোর মতো সক্ষমতায় আছে। তাদের মেরুদন্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তবে আমরা (র‌্যাব) জঙ্গিদের বিষয়ে সার্বক্ষণিক সজাগ ও সতর্ক দৃষ্টি রেখেছি। আমাদের গোয়েন্দারা সবসময় জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছেন। জঙ্গিরা যেকোনো ধরনের অপতৎপরতা চালালে কঠোরভাবে দমন করা হবে।’

র‌্যাব মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘হলি আর্টিজানের হামলা থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে যেখানেই জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে সেখানেই তাদের সব পরিকল্পনা নস্যাৎ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই র‌্যাবের জঙ্গিবাদবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট। র‌্যাব জঙ্গিদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করে যাচ্ছে।’

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমার বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয় গোটা দেশ। ভয়াবহ ওই সিরিজ বোমা হামলায় বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ ও সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ ৩৩ জন নিহত হন। আহত হন চার শতাধিক মানুষ। প্রায় একই সময়ে দেশব্যাপী বোমা হামলার মাধ্যমে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যরেও জানান দেয় জঙ্গি সংগঠন জেএমবি। এরপর ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজানে নৃশংস হামলা চালানোর মাধ্যমে ফের জঙ্গিদের ভয়ঙ্কর মিশন শুরু হয়। এ ছাড়াও ত্রিশালে জঙ্গি আসামি বহনকারী প্রিজনভ্যানে সশস্ত্র হামলাসহ বড় বড় কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনায় চলে আসে জঙ্গিরা। জেএমবি ভেঙে নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), আনসার আল ইসলাম, ‘আল্লাহর দল’সহ নানা নামে বর্তমানে জঙ্গিরা সাংগঠনিক ও নাশকতামূলক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলাটি জেএমবির দিক থেকে ছিল সাংগঠনিক ও সফল। তবে জঙ্গিদের এখন বড় হামলা করার সামর্থ্য নেই। বর্তমানে সাংগঠনিক কাঠামোও তাদের নেই। তাদের যে সক্ষমতা তা খুবই সামান্য। যদিও ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানের ঘটনাটি নানাভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। তবে ওই সময়ের সক্ষমতার তুলনায় এটি তেমন কিছুই না। জঙ্গিরা এখন সাইবার স্পেসকে তাদের প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে। কোভিড আসার পর মানুষ ঘরে বেশি থেকেছে, ফলে জঙ্গিরা অনলাইনে প্রচার-প্রচারণা বেশি চালিয়েছে।

জেএমবির সিরিজ বোমা হামলার মামলার ঘটনায় সারা দেশে ১৫৯টি মামলা হয়। পুলিশ ও র‌্যাব সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে এসব মামলায় জেএমবির সহশ্রাধিক সদস্য গ্রেফতার করে। ১৬টি মামলার চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে পুলিশ। ১৪৩টি মামলার চার্জশিট প্রদান করেছে। এ মামলার ৯৬টি মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে। ৪৭টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। রায় দেওয়া এসব মামলায় ৩০৭ জনের সাজা হয়েছে। মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে ২৭ জনকে। অন্যদিকে রাজধানী ঢাকার ১৭ মামলার সবগুলোর বিচারকাজ এখনও শেষ হয়নি।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু সময়ের আলোকে বলেন, সিরিজ বোমা হামলায় ঢাকায় মোট ১৭টি মামলা হয়। এর মধ্যে সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে ৮টি মামলারই চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে ৪টি মামলায় রায় হয়েছে। বর্তমানে বিচারাধীন আছে ৫টি মামলা। অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আবু বলেন, বিচারাধীন মামলাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এ বছরের মধ্যেই বাকি ৫ মামলার রায় ঘোষণা হয়ে যাচ্ছে।

শুক্রবার রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সক্রিয় তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৪ ব্যাটালিয়ন। গ্রেফতারকৃতরা হলো আবুল হায়াত (২৬), আব্দুল কুদ্দুস (৩০) ও আল-আমিন (৩০)। এ সময় তাদের কাছ থেকে উগ্রবাদী বিভিন্ন বই, মোবাইল ফোন ও লিফলেট উদ্ধার করা হয়।

সর্বশেষ গত ১১ আগস্ট সিলেটে অভিযান চালিয়ে হামলার পরিল্পনায় ব্যস্ত থাকা নব্য জেএমবির ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। তার আগে গত ২৭ জুলাই ঢাকার ধামরাই ধলিভিটা বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের ৫ জঙ্গিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৪ ব্যাটালিয়ন। একই দিনে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের তারাব এলাকার সুলতানবাগ থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য সবুজ শেখকে গ্রেফতার করে পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। এর আগে ১৯ জুলাই সাভারের ভাটপাড়া থেকে জেএমবির ৬ জঙ্গিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৪। তারও আগে ২ জুলাই ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থেকে জঙ্গি সংগঠন ‘আল্লাহর দলের’ ঢাকা দক্ষিণের আমির মো. ফারুক শেখকে গ্রেফতার করে এন্টি টেররিজম ইউনিট। এ ছাড়া গত ২০ জুন রাজধানীর দক্ষিণখান থেকে গোপন তৎপরতাকালে জঙ্গি সংগঠন আল্লাহর দলের ৭ সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১ ব্যাটালিয়ন। এ ছাড়াও জঙ্গি হামলার আশঙ্কা করে গত ২৬ জুলাই বাংলাদেশ পুলিশের সব ইউনিটকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয় পুলিশ হেডকোয়ার্টার। ওই সতর্কতায় বলা হয়, হামলার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে প্রধানত টার্গেট করতে পারে পুলিশ, যানবাহন, দূতাবাস বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, বিমানবন্দর ও বিভিন্ন ধরনের উপাসনালয়। এ লক্ষ্যে জঙ্গিরা রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে কৌশলে বা ছদ্মবেশে অবস্থান নিয়ে আস্তানা গড়ার অপচেষ্টা করছে বলেও মনে করা হয়। সেই নির্দেশনায় জঙ্গিবিরোধী অভিযান আরও জোরদার করা হয়।

প্রসঙ্গত, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবির জঙ্গিরা একযোগে প্রায় একই সময়ে সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলা চালায়। নজিরবিহীন এ নৃশংস হামলায় বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ ৩৩ জন নিহত হন। আহত হন ৪ শতাধিক।

অন্যদিকে ওই সময়ে সদ্য নতুন বাহিনী র‌্যাব প্রথম থেকেই জঙ্গি ও সর্বহারা দমনে কঠোর ভ‚মিকা পালন শুরু করে। জেএমবির আমির শায়খ আব্দুর রহমান ও সেকেন্ড-ইন কমান্ড (দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা) সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইসহ বেশকিছু ভয়ঙ্কর জঙ্গিকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করে র‌্যাব। ২০০৭ সালের মার্চে শীর্ষ ৬ জঙ্গি নেতার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরপর ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গিরা ফের ভয়ঙ্কর রূপে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়।

এ বিষয়ে র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে র‌্যাব তার ম্যান্ডেটের আলোকে জঙ্গি দমনে বলিষ্ঠ ভ‚মিকা পালন করে আসছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৩১২ জন জঙ্গিকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে। ২০০৫ সালে ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় ৬৭ জন আসামিকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। এর মধ্যে তৎকালীন জেএমবির আমির শায়খ আব্দুর রহমান বাংলাভাই ও আতাউর রহমান সানির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। একইভাবে হলি আর্টিজান হামলা পরবর্তী সময়ে দেশে জঙ্গি দমনে র‌্যাবের সাঁড়াশি অভিযান চলমান রয়েছে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের কোনো ঠাঁই হবে না এবং প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতির আলোকে জঙ্গিবাদ নির্মূলে আমরা বদ্ধপরিকর।