হিজড়ারা প্রতিমুহূর্তে বিড়ম্বনার মুখোমুখি, কবরের জায়গা পেতেও বঞ্চনা

হিজড়ারা প্রতিমুহূর্তে বিড়ম্বনার মুখোমুখি, কবরের জায়গা পেতেও বঞ্চনা
হিজড়ারা প্রতিমুহূর্তে বিড়ম্বনার মুখোমুখি, কবরের জায়গা পেতেও বঞ্চনা

বিশেষ প্রতিবেদক ।।

পুরুষ-স্ত্রী লিঙ্গের পাশাপাশি সমাজে রয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) মানুষ। যারা সমাজ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। যথাযথ মর্যাদা বঞ্চিত তারা। তাদের নিয়ে সরকারের নানা ধরণের পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়ন হয়নি কখনও। পরিবার থেকেই প্রথমে তাদের মর্যাদা লোপ পেতে থাকে। পরবর্তিতে সমাজচ্যুত হয়ে রাস্তায়-রাস্তায় কাটে তাদের গোটা জীবন।

মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্য-বস্ত্রের খোঁজেই জীবন পার হয়ে যায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের। কেউ কেউ চাঁদাবাজ আখ্যায়িত করলেও জীবন-জীবিকার জন্যই যে তারা রাস্তায় নামেন সেটা বাধ্য হয়েই। তৃতীয় লিঙ্গের এসব মানুষের জীবন কীভাবে কাটছে তা নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই পরিবার, সমাজ এমন কি রাষ্ট্রেরও। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নেই কোনো জোরালো পদক্ষেপ।

বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটলেও বদলাচ্ছে না তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবনমান। বাড়ি-বাড়ি ঘুরে তারা জোগাড় করছেন অন্ন-বস্ত্র। কখনও ঘুরছেন দোকানে-দোকানে। কতোটা অসহায় আর বাধ্য হলেই না একজন মানুষ এভাবে দ্বারে-দ্বারে ঘুরে জীবন-জীবিকা চালাতে পারে তা নিয়ে কোনো ভাবনা নেই অন্যদের।

তৃতীয় লিঙ্গের এ সম্প্রদায়ের মানুষ টাকা তুলে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের বেশিরভাগেরই নেই নিজস্ব বাসস্থান। নেই মানসম্মত কর্মসংস্থান। ভাড়া বাড়িতে কাটিয়ে দিতে বাধ্য হয় গোটাজীবন। দিনভর ঘুরে যে উপার্জন তারা করেন তাতে খাদ্য আর বস্ত্রের ব্যবস্থা করাই দায় হয়ে পড়ে। এদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেই।

জীবনমান নিয়ে কথা হয় তৃতীয় লিঙ্গের অনেকের সঙ্গে। তাতে বেরিয়ে আসে তাদের জীবনের প্রকৃত চিত্র। সমাজে আর দশজনের মতো জন্ম হলেও অবহেলার দায় বেশি নিতে হয় হিজড়া সম্প্রদায়কে। জন্মের পর বোঝার উপায় থাকে না তাদের। ধীরে ধীরে তাদের আচরণে পরিবর্তন হতে থাকে। স্ত্রী লিঙ্গ হয়েও বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আসক্তি হারাতে থাকে। একই পরিস্থিতি দেখা যায় পুং-লিঙ্গের ক্ষেত্রেও। যখন পরিবার বা অভিভাবকরা বুঝতে পারেন, তাদের সন্তান হিজড়া তখন নানাভাবে সামাজিক চাপে পড়তে হয়। যা সন্তানের প্রতি কদর অনেকটা কমিয়ে দেয়।

পরিবারের পর যখন বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশার পালা ঠিক সে সময়ে খেলার সঙ্গীদের অবহেলা পেতে হয়। বন্ধুদের কাছ থেকে এমন বঞ্চনা তাদের অন্যরকম সমাজ গঠনের দিকে নিয়ে যায়। বাড়ির বাইরে গেলেই বন্ধুদের কাছে অবহেলিত হতে থাকেন তারা। শুরু হয় স্কুলজীবন। অধিকাংশ স্কুলে ভর্তি হতে পারে না এ সস্প্রদায়। সব শিশুর স্কুলে ভর্তির অধিকার থাকলেও হিজড়া শিশুরা যেন অন্য গ্রহের বাসিন্দা। নানা কৌশলে এরা শিক্ষা বঞ্চিত হতে থাকে।

সমাজে অবহেলিত হয়ে যখন হতাশাগ্রস্ত হয় তখন খোঁজে একটি দল। একটি সঙ্গ। পাশেই হিজড়াদের ঐক্যবদ্ধ চলাচল দেখে তখন তারা দলে ভেড়ে। এভাবেই হিজড়ারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে চলাচল শুরু করে। পরিবার, সমাজ অতঃপর রাষ্ট্রের যথাযথ দায়বদ্ধতা থাকলে হিজড়াদের হয়তো রাস্তায়-রাস্তায় জীবন পার করতে হতো না। সামাজিক সম্মানবোধ ও অধিকার বঞ্চিত, অবহেলিত, যথাযথ কর্মক্ষেত্রের অভাববোধ থেকে হিজড়ারা চেয়ে চিন্তে জীবন জীবিকা চালাতে শুরু করে। এদের স্বাভাবিক কর্মক্ষেত্রের ব্যবস্থা করাটা জরুরি মনে করে তাদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো।

বাংলাদেশে হিজড়া সম্প্রদায় মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রাথমিক জরিপ মতে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার ছিল। তবে ২০২২ সালের জনশুমারি মতে দেশে হিজড়ার সংখ্যা ১২ হাজার ৬শ’ ২৯ জন। এ জনগোষ্ঠী অবহেলিত ও অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। 

সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার এ জনগোষ্ঠীর পারিবারিক, আর্থসামাজিক, শিক্ষাব্যবস্থা, বাসস্থান, স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ সর্বোপরি তাদের সমাজের মূল স্রোতধারায় এনে দেশের সার্বিক উন্নয়নে সম্পৃক্তকরণ অতি জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। সুবিধাবঞ্চিত এসব হিজড়াদের সাথে কথা বলে জানা যায় তাদের জীবন মান।

লাকি নামের একজন হিজড়া জানান, শৈশবেই শুরু হয় পরিবারের অবহেলা। অতপর বন্ধু ও সমাজের অবহেলা থেকে চলে আসেন হিজড়া সম্প্রদায়ের দলে। এখন এ দলের সঙ্গে মিশেই চলছে তার জীবন জীবিকা। একই কারণে হিজড়া দলে চলে এসেছেন কালিহাতীর বৈশাখী। পরিবারের সাথে তার তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। সমাজের চাপ থেকে পরিবারকে রেহাই দিতে পরিবার বিচ্ছিন্ন বৈশাখী।

জেরিন শেখ জানান, শৈশবে তার শরীর ও মানসিক পরিবর্তন হতে থাকলে শুরু হয় অবহেলা। বন্ধুদের সাথে মেশার সুযোগ পাননি। স্কুলে গেলে বন্ধুরা তার সাথে মেশেনি। বন্ধুরা বলতেন হিজড়া, হাফ লেডিস। পরিবারও তাকে সাপোর্ট করেনি। এরপর স্কুল ছাড়েন জেরিন। তারপর আর পড়ালেখা করতে পারেননি তিনি। সরকারিভাবে বিউটিশিয়ানের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরও তিনি আর্থিক সহযোগিতা না পাওয়ায় পার্লার চালু করতে পারছেন না। একই অপবাদে তৃতীয় শ্রেণির পর আর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেনি মর্জিনা। সমাজে নানা অধিকার বঞ্চিত হয়ে হিজড়া দলে যোগ দিয়েছেন সোহানা।

হিজড়া সংগঠন বন্ধনের সভাপতি জেরিন শেখ বলেন, জেলাতে অনেক হিজড়া রয়েছেন। এরা সুবিধা বঞ্চিত মানুষ। সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে এরা সবসময় সুবিধা বঞ্চিত থাকেন। সম্মানজনক কর্মসংস্থান না পেয়ে এরা রাস্তায় রাস্তা ঘুরে উপার্জন করেন। মানসম্মত উপার্জন ব্যবস্থা থাকলে এদের রাস্তায় ঘুরে উপার্জন করতে হতো না। উপার্জনের বড় অংশ ধারাবাহিকভাবে গুরুদের ভাগ দিতে হয়। এরপর যা থাকে জীবন জীবিকা চালানোই কষ্টকর। সরকারিভাবে ৫০০ টাকা হিজড়া ভাতা থাকার নিয়ম থাকলেও ভাতা পাচ্ছে ৫০ উর্ধ্ব বয়সের হিজড়ারা। কম বয়সি হিজড়ারা জীবন জীবিকার খোঁজে রাস্তায় নামেন।

জেরিন শেখ বলেন, সমাজে আমাদের সম্মান নেই। আমরা হোটেলে বসলে স্বাভাবিক মানুষ অন্য টেবিলে চলে যান। বাসের সিটে বসলে উঠিয়ে দেন। কখনও স্বাভাবিক মানুষ অন্য সিটে চলে যান। হাসপাতালে একজন হিজড়া ভর্তি হলে রোগিরা অন্য সিটে চলে যায়। এমন কি কবরস্থানেও কবর দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত এরা। একজন হিজড়া মারা গেলে অনুরোধ করে কবর দেওয়ার জায়গা নিতে হয়। আমি নিজেও একটি কবরস্থানে দুই শতাংশ জায়গা কিনে রেখেছি আমার কবরের জন্য।

সংগঠনের পক্ষ থেকে জেরিন আরও বলেন, তিনটি লিঙ্গের একটিকে বাদ দিয়ে দেশকে উন্নয়ন করা সম্ভব না। দেশকে উন্নয়ন করতে হলে তিন জাতিকেই সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে। হিজরাদের পুনর্বাসন, হিজড়া ভাতা নিশ্চিত করা, চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আলাদা সিটের ব্যবস্থা করা, সকল কাজে হিজড়াদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি নিশ্চিত করাসহ হিজড়াদের জন্য আলাদা কলোনি তৈরির দাবি জানান তিনি।

তবে সমাজ সেবা অধিদপ্তর তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে ২০১২-১৩ অর্থ বছর ৭টি জেলাতে পাইলট প্রকল্প শুরু হয়। ২০১২-১৩ অর্থ বছরে মোট বরাদ্দ ছিল বাহাত্তর লক্ষ সতের হাজার টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে ১৪টি জেলায় কর্মসূচি সসম্প্রসারণ করে মোট ২১টি জেলায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। মোট বরাদ্দ ছিল চার কোটি সাত লক্ষ একত্রিশ হাজার ছয়শত টাকা।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে পূর্বের ২১ জেলায় বাস্তবায়িত হয়। কর্মসূচির মোট বরাদ্দ ছিল চার কোটি আটান্ন লক্ষ বাহাত্তর হাজার টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পূর্বের ২১ জেলাসহ নতুন ৪৩টি জেলায় কর্মসূচি সম্প্রসারণ করে মোট ৬৪ জেলায় এ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ আট কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ নয় কোটি টাকা।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ এগার কোটি পয়ত্রিশ লক্ষ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ এগার কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ পাঁচ কোটি ছাপ্পান্ন লক্ষ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ পাঁচ কোটি ছাপ্পান্ন লক্ষ টাকা। স্কুলগামী হিজড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ৪ স্তরে (জনপ্রতি মাসিক প্রাথমিক ৭০০, মাধ্যমিক ৮০০, উচ্চ মাধ্যমিক ১০০০ এবং উচ্চতর ১২০০ টাকা হারে) উপবৃত্তি প্রদানের কথা থাকলেও স্কুলে ভর্তি হতেই হোঁচট খেতে হয় তাদের।

এদিকে, ৫০ বছর বা তদুর্ধ বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল হিজড়াদের বিশেষ ভাতা জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা প্রদান করা হলেও ১-৪৯ বছর বয়সিদের অন্যের কাছে হাত পেতেই চলতে হয়। হিজড়াদের দাবি তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া। 

হিজড়াদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের তেমন সুযোগ নেই। জীবন জীবিকার তাগিদে হিজড়া সম্প্রদায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে। অন্ন,বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাটা জরুরী। জাতির উন্নয়নে পুরুষ-স্ত্রীর পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গ হিজড়াদের সম্পৃক্ততার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;