স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দুই পরিচালক লুটের আখড়ায় পরিণত করেন !

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দুই পরিচালক লুটের আখড়ায় পরিণত করেন !
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দুই পরিচালক লুটের আখড়ায় পরিণত করেন !

আবুল খায়ের ।।

অনেকটা ওপেন সিক্রেট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দুর্নীতি। স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন কেনাকাটা ও এর ব্যবহার ঘিরে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ১৪ জন লাইন ডাইরেক্টর আছেন। তারা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তার ইচ্ছায় নিয়োগ পান। তাদের মধ্যে লাইন ডাইরেক্টর (হাসপাতাল) ও লাইন ডাইরেক্টর (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ৮০ ভাগ কেনাকাটা করে থাকেন। বাকি ২০ ভাগ কেনাকাটা করেন ১২ জন লাইন ডাইরেক্টর। আর কেনাকাটার নামে চলে পুকুরচুরি ও হরিলুট। এই ১৪ লাইন ডাইরেক্টরের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা নিয়মিত দুর্নীতির টাকার ভাগ পান।

জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৪ লাইন ডাইরেক্টরের দাপট অনেক বেশি। কারণ তারা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পছন্দের মানুষ। এদের দাপট এত বেশি যে তারা অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পর্যন্ত তোয়াক্কা করেন না। অধিদপ্তরের একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক সরকারি গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ পান না। অথচ লাইন ডাইরেক্টররা নামিদামি গাড়িতে চলাচল করেন। প্রকাশ্যে দুর্নীতি ও অনিয়ম চালিয়ে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ছেন তারা। বিশেষ করে দুই লাইন ডাইরেক্টর সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করেন। দুদকের নজর এই দুই লাইন ডাইরেক্টরের ওপর।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতির বিষয়টি স্বীকার করে একজন লাইন ডাইরেক্টর ইত্তেফাককে বলেন, কিছু কিছু লাইন ডাইরেক্টর কাউকেই পাত্তা দেন না। কারণ তারা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তার আস্থাভাজন। লাইন ডাইরেক্টররা তাদের পদ ধরে রাখতে যখন যেখানে যা প্রয়োজন তা-ই করেন। কাউকে গাড়ি উপহার দেন, কাউকে স্বর্ণের গহনা দেন। এই লাইন ডাইরেক্টররা গত ১০ বছরে কেনাকাটায় কী ধরনের দুর্নীতি করেছেন, তা তদন্ত করে বের করার জন্য দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদ (স্বাচিপ)। একই সঙ্গে এ দুই সংগঠন স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানোর দাবি জানিয়েছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লাইন ডাইরেক্টর পদ থাকার দরকার নেই। যে উদ্দেশ্যে এই পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল, তার উলটো ফল পাওয়া যাচ্ছে। এই লাইন ডাইরেক্টররা দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেদের আখের গোছান। গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তাদের দিয়ে চিকিত্সাক্ষেত্রে কোনো ভালো ফল আসছে না।

ভারতে ডিজি পদমর্যাদার সার্জন জেনারেল রয়েছেন। এই সার্জন জেনারেল দেশটির স্বাস্থ্য খাতের সবকিছুরই জবাবদিহি করেন। স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব ডা. এম এ আজিজ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লাইন ডাইরেক্টর পদ বিলুপ্ত করার দাবি জানিয়ে বলেন, দ্বৈত প্রশাসনের কোনো প্রয়োজন নেই। একটা প্রশাসন দুর্নীতির টাকা ভাগাভাগি করে, আরেকটি প্রশাসন কাজ করে। টাকা ভাগাভাগির প্রশাসন তুলে দিতে হবে।

গত বছর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১১টি খাতে দুর্নীতি ও অনিয়ম খুঁজে পায়। এর মধ্যে বেশি দুর্নীতি হয় কেনাকাটা, চিকিত্সাসেবা, চিকিত্সাসেবায় ব্যবহূত যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহ খাতে। সাদা চোখে দেখা দুর্নীতির বাইরে একটি অভিনব দুর্নীতির কথাও তখন বলে দুদক। আর তা হলো, দুর্নীতি করার জন্য অনেক অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা। এমন যন্ত্রপাতি কেনা হয়, যা পরিচালনার জনবল নেই। ঐ সব যন্ত্রপাতি কখনোই ব্যবহার করা হয় না। দুদক তখন এই দুর্নীতি প্রতিরোধে ২৫ দফা সুপারিশ করে বলে, দুর্নীতির কারণেই স্বাস্থ্য খাতের করুণ অবস্থা।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দুর্নীতিবাজরা সিন্ডিকেট গড়ে কেনাকাটার নামে হরিলুট চালিয়েছে। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের রথী-মহারথীদের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে এ ধরনের দুর্নীতি সম্ভব হতো না। কয়েক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনায়, যার বেশির ভাগই নিম্নমানের এবং অব্যবহূত। এমন তথ্য উঠে এসেছে দেশের অন্তত ২৭টি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কেনাকাটা-সংক্রান্ত তথ্যে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, উচ্চ পর্যায়ের গাফিলতি না থাকলে এত বড় অঙ্কের দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাত্ সম্ভব নয়। বেশির ভাগ যন্ত্রপাতিই কেনা হয়েছে চাহিদাপত্র ছাড়াই। ‘এ’ ক্যাটাগরির যন্ত্রপাতির মূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে ‘সি’ ক্যাটাগরির যন্ত্রপাতি। কখনো কখনো দেশে থেকেই যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে কোনো নামকরা বিদেশি কোম্পানির।

সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চাহিদাপত্র ছাড়াই ভুয়া বিল দাখিল করে পিএসিএস সফটওয়্যার সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতির নামে ৬ কোটি ৬ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়। সাতক্ষীরা ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজিতে ১১ কোটি ৭৪ লাখ টাকার, ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজে অন্তত ৩০ কোটি টাকা, নোয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৫ কোটি টাকা, নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালের ১৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা, ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ২৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা, মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যার হাসপাতালে ১৪ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হলেও এখনো তা অব্যবহৃত রয়েছে। সুত্র. ইত্তেফাক