সীতাকুণ্ডের কৃষকের মুখ যেন সূর্যমুখীর হাসি 

সীতাকুণ্ডের কৃষকের মুখ যেন সূর্যমুখীর হাসি 
সীতাকুণ্ডের কৃষকের মুখ যেন সূর্যমুখীর হাসি 

মেজবাহ খালেদ ।।

মুখে হাসি আর ছেলে আসিফ এবং পরিবারের অন্যান্যদের নিয়ে সীতাকুণ্ডের কুমিরা ইউনিয়নের দেলিপাড়ার কৃষক আবুল হাশেম তার সূর্যমুখী ফুল বাগানের বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিলেন বাগান দেখতে আশা শতশত দর্শনার্থীদের । নারী দর্শকদের পরিবারের নারী সদস্যরা আর পুরুষ দর্শনার্থীদের বাবা আর ছেলে মিলে বলে যাচ্ছিলেন তাঁদের অনুভুতির কথা ।

প্রকৃতির এক অসাধারণ রূপবান উদ্ভিদ সূর্যমুখী। কেউ কিনেন, কেউ চাষ করেন, আবার কেউ ফুলের সৌন্দর্য দেখেন। এ জন্য সবাই ফুলের কাছে ছুটে যান। আর এ ফুল যদি হয় শস্য ক্ষেত্রের সুন্দর হলুদ সূর্যমুখী, তাহলে তো কথাই নেই। চৈত্রের রোদে বাতাসে মাঝে মাঝে দোল খাচ্ছে মনকাড়া পাখি আর কীটপতঙ্গের দল । ফুল থেকে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছে মৌমাছি । এ যেন অপরূপ এক দৃশ্য । যেটি আকৃষ্ট করছে সূর্যমুখী ফুল বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে চলা পথচারীদের।

সরেজমিনে শুক্রবার দেখা যায়, উপজেলার মছজিদা দেলিপাড়া গ্রামের কৃষক আবুল হাশেমের জমিতে সূর্যের ঝলকানিতে হলুদ ঝলমল করছে চারপাশ। সূর্যের দিকে মুখ করে আছে ফুল, সকালে পূর্ব দিকে তাকিয়ে হাসলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের আবর্তনে তার দিক পরিবর্তন হয়। বিস্তীর্ণ মাঠতে এ যেন সবুজের মাঝে হলুদের সমাহার। সূর্যের দিকে মুখ করে হাসছে সূর্যমূখী। আর এমন মনোরম দৃশ্য দেখতে প্রতিদিনই অনেক মানুষ ভিড় করছেন সূর্যমুখী বাগানের সৌন্দর্য দেখতে। ফুলের সঙ্গে দর্শনার্থীরা মুখও যেন হাসছে।

দৃষ্টিকাড়া ফুলের মধ্যে মুঠোফোনে বন্দী করছেন প্রিয় মুহূর্তগুলো। সূর্যমুখী ওই ফুলের বাগানের আশেপাশের মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পুরো দিনই বাড়ছে মানুষের সমাগম। ফুলে ফুলে ভরে গেছে সূর্যমুখী ক্ষেত। একবার চোখ পড়লে তা ফেরানো কঠিন। বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় উদ্ভাবিত এই ফুলের তেলজাতীয় ফসল সূর্যমুখী জাতের ফুল চাষ করে আশার আলো দেখছেন কৃষক মো. হাশেম ও তাঁর পরিবার । 

সূর্যমুখী ফুলের মতো যেন হাসছিলো আবুল হাশেম এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের মুখে। এত দর্শনার্থীর উপস্থিতিতে বিরক্ত হচ্ছিলেন না মোটেও বরং তাঁদের বেশ ভালোই লাগছিল বললেন ছেলে আসিফ। তাঁদের বাগানের কারণে দূরদূরান্ত থেকে দেখতে আশা শতশত দর্শনার্থী দেখে তাঁরা বেশ উৎফুল্ল। 

সীতাকুণ্ডে শুধু আবুল হাশেমের না তাঁর বাগানের ঠিক ১০০ গজ দূরেই আরেকটি বাগান আছে কৃষক মনিরের । সে সবার জন্য উন্মুক্ত করে রেখেছিলো তাঁর বাগান । যে কারণে অনেক দর্শনার্থী তাঁর বাগানের ফুলগুলো ছিঁড়ে ফেলছিল অথবা ঢালা ভেঙ্গে ফেলছিল । অবশ্য এসবে মনিরের মুখে কষ্ট নেই । সে হাসিমুখে সবাইকে অনুরোধ করছিল ফুলে বা গাছে হাত না দেয়ার জন্য কিন্তু যতক্ষণ বলছেন ততক্ষণ । তাছাড়া শুক্রবার হওয়াতে দর্শনার্থীর উপস্থিতি ছিল বেশী ।

সীতাকুণ্ড উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার ও বীজ প্রণোদনার মাধ্যমে চাষ হচ্ছে সূর্যমুখী ফুলের চাষ। আবহাওয়া এখন পর্যন্ত অনুকূলে থাকায় কৃষকরা সূর্যমুখী ফুলের বাম্পার ফলনের আশা করছেন। বর্তমানে সূর্যমুখীর অধিকাংশ গাছেই ফুল ফুটেছে।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সীতাকুণ্ড উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ও পৌরসভার বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনী প্রকল্পের আওতায় সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছেন চাষিরা । বর্তমানে বাজারে ভোজ্য তেলের আকাশছোঁয়া দাম হওয়ার কারণে চাহিদা বেড়েছে সরিষা ও সূর্যমুখী তেলের। সূর্যমুখী ফুলের চাষ করলে ফুল থেকে তেল, খৈল ও জ্বালানি পাওয়া যায়। প্রতি কেজি বীজ থেকে কমপক্ষে আধা লিটার তৈল উৎপাদন সম্ভব। প্রতি বিঘা জমিতে ৭ মণ থেকে ১০ মণ বীজ উৎপাদন হয়। তেল উৎপাদন হবে প্রতি বিঘায় ১৪০ লিটার থেকে ২০০ লিটার পর্যন্ত। প্রতি লিটার তেলের বাজার সর্বনিম্ন বাজার মূল্য ২৫০ টাকা। অন্যদিকে সূর্যমুখী চাষে খরচ তেমন একটা নেই বললেই চলে। ফলে অন্যান্য ফসলের চেয়ে সূর্যমুখী চাষে লাভের সুযোগ অনেক বেশি বলে মনে করছেন কৃষকরা।

সূর্যমুখী ফুল চাষি কৃষক আবুল হাশেম বলেন, কৃষি অফিস থেকে বীজ প্রণোদনা নিয়ে আমি এই প্রথম আমার ১ বিঘা জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছি। এটা চাষ করতে তেমন কোনো কষ্ট নাই খুব সহজেই এটি চাষ করা যায়। খরচ বাদে অর্ধেক লাভ হওয়ার আশা করছি। পরবর্তীতে বড় পরিসরে করার চিন্তা রয়েছে। এটা আমাদের এলাকায় নাই কৃষি কাজ করি বিধায় আমি এই উদ্যোগ নিচ্ছি।

আরেক কৃষক মনির জানান, সূর্যমুখী ফুলের ফলন ভালো হয়েছে। তবে তেল উৎপাদনের মেশিন না থাকায় বীজ কম মূল্যে বিক্রয় করে দিতে হয়। যদি মেশিন থাকত তাহলে উপজেলায় প্রতিবছর সূর্যমুখী চাষ বাড়তো। 

সূর্যমুখী ফুল দেখার জন্য আসা হাফসা নামে এক দর্শনার্থী জানান, সবধরনের ফুল ভালো লাগলেও চারদিকে ফসলি জমির মাঝখানে একসঙ্গে অসংখ্য সূর্যমুখী ফুল ফোটায় সৌন্দর্য বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। নয়ন জুড়ানো সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি এবং কৃষকের পরিবারের সাথে কথা বলে অনেক ভালো লেগেছে । 

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাবীবুল্লাহ জানান, পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ সূর্যমুখীর তেল স্বাস্থ্যসম্মত ও মানসম্পন্ন। অলিভ ওয়েলের পরেই সূর্যমুখী তেলের অবস্থান। অন্য ফসলের চেয়ে সূর্যমুখী চাষে খরচ কম, লাভ বেশি। আগামীতে উপজেলায় সূর্যমুখী ফুলের চাষ আরও সম্প্রসারিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি ।

খালেদ /পোস্টকার্ড ;