সীতাকুণ্ড শিপ ইয়ার্ড যেন ইউরোপের বিষাক্ত জাহাজের ভাগাড়

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন

সীতাকুণ্ড শিপ ইয়ার্ড যেন ইউরোপের বিষাক্ত জাহাজের ভাগাড়
সীতাকুণ্ড শিপ ইয়ার্ড যেন ইউরোপের বিষাক্ত জাহাজের ভাগাড়

বিশেষ প্রতিবেদক।। 

ইউরোপের বিভিন্ন শিপিং কোম্পানি এমন কিছু জাহাজ স্ক্র্যাপের জন্য পাঠাচ্ছে যা চট্টগ্রামের বিপজ্জনক ও দূষণকারী ইয়ার্ডে পরিত্যক্ত করছে প্রতিমুহূর্তে । অথচ সবকিছুই তারা জানে । মানুষের জীবন ও পরিবেশের খরচের বিনিময়ে শ্রেফ মুনাফার জন্য তারা আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের ফাঁকফোকরগুলো ব্যবহার করে যাচ্ছে। বিপজ্জনক এই দূষিত জাহাজগুলো কাটতে গিয়ে নিচ্ছিত মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছেন অনেক শ্রমিকই ।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এবং বেলজিয়ামভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম’ যৌথভাবে প্রকাশ করা এক প্রতিবেদনে এমন সব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত ৯০ পৃষ্ঠার সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো প্রায়ই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে শর্টকাট পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। সৈকত ও আশেপাশের পরিবেশে সরাসরি বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে দেয় এবং আহত হলে শ্রমিকদের মজুরি, বিশ্রাম বা ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত করে। প্রতিবেদনে জাহাজ মালিকদের এমন এক সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্কের কথা প্রকাশ করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুনকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের এমন সব স্থাপনায় বিষাক্ত জাহাজ পাঠায়, যেখানে পর্যাপ্ত পরিবেশগত বা শ্রম সুরক্ষা নেই।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, ‘ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের সৈকতে পরিত্যক্ত জাহাজগুলো ফেলার মাধ্যমে মানুষের জীবন ও পরিবেশের বিনিময়ে মুনাফা করছে।’

তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করা থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিরত থাকতে হবে। নিজেদের পরিত্যক্ত জিনিস নিরাপদে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তাদের নিতে হবে।’

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে কর্মরত ৪৫ জন শ্রমিক ও তাদের আত্মীয়স্বজন, ১০ জন চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার ছাড়াও জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশের পরিবেশ ও শ্রম আইন, পাবলিক শিপিং ডাটাবেস, কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন ও ওয়েবসাইট, সমুদ্রপথে আমদানির রেকর্ড এবং ফাঁস হওয়া আমদানি সার্টিফিকেট বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ শিপব্রেকিং ইয়ার্ড, শিপিং কোম্পানি, ফ্ল্যাগ রেজিস্ট্রি এবং ক্রেতাদের পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন এবং চারটি বাংলাদেশি সরকারি সংস্থাসহ মোট ২১টি সংস্থার কাছ থেকে অনুসন্ধানের প্রতিক্রিয়াও জানতে চেয়েছিল।

উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সমুদ্রসৈকত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে নির্মাণশিল্পের জন্য ইস্পাতের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বাড়ছে। ফলে ইউরোপ থেকে আসা বিপজ্জনক জাহাজগুলো হয়ে ওঠেছে এই ইস্পাত জোগানোর অন্যতম প্রধান উৎস।

দেখা গেছে, ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশে পাঠানো ৫২০টি পরিত্যক্ত জাহাজের মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জাহাজও রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এসব জাহাজ ভাঙার কাজে নিয়োগ করা হয় অন্তত ২০ হাজার শ্রমিককে। যদিও এসব শ্রমিক জাহাজে থাকা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি এড়াতে সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন প্রতিনিয়ত ।

একটু পেছেনের দিকে তাকালে দেখা যায় ,

২০১৯ সালের ১৯ জুন সীতাকুণ্ডের একটি শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে ২৮ বছর বয়সী সাখাওয়াত (ছদ্মনাম) কাঁধে একটি লোহার বান্ডেল বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এর একপর্যায়ে হঠাৎ তিনি পিছলে পড়েন। এতে লোহার বান্ডিলটি পড়ে গিয়ে ডান পা ভেঙে যায়। এরপর তিনি একটি হাসপাতালে যান, সেখানে শেষ পর্যন্ত তার পা কেটে ফেলা হয়। কিন্তু ইয়ার্ড মালিক তার চিকিৎসার খরচও দিতে চাননি। ফলে সাখাওয়াত তার সব সঞ্চয় খরচ করার পরও বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নিতে বাধ্য হন। তার এখন ঘরও নেই, রেলস্টেশনে ঘুমান। ক্ষুধা মেটানোর জন্য তিনি ভিক্ষা করেন।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) জাহাজভাঙাকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। শ্রমিকরা বারেবারেই বলে আসছেন,  শিপব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে নিরাপদে কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ বা সরঞ্জাম দেওয়া হয় না তাদের। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জাহাজ ভাঙার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা জানিয়েছেন, জাহাজের ইস্পাত গলানোর সময় আগুনে পোড়ার হাত থেকে বাঁচতে তারা নিজেদের মোজা ও গ্লোভস ব্যবহার করে থাকেন। জাহাজে থাকা বিষাক্ত গ্যাস থেকে বাঁচতে শার্ট দিয়ে মুখ ঢেকে নেন। এরপর ইস্পাত কাটা শেষ হলে সেগুলো খালি পায়েই অন্যত্র টেনে নিয়ে যান তারা।

ইস্পাতের টুকরো পড়ে যাওয়া বা জাহাজে আগুন লাগার সময় বা পাইপ বিস্ফোরিত হওয়ার কারণে আহত হওয়ার কথা বর্ণনা করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে কাজ করা শ্রমিকরা জানান, অনেক সময় জাহাজের ইস্পাতের প্রচণ্ড ভারী খণ্ডাংশ শ্রমিকদের গায়ের ওপর এসে পড়ে। আবার জাহাজ ভাঙার সময় সেখানে আগুন লাগলে বা কোনো পাইপে বিস্ফোরণের সময় অনেক শ্রমিক জাহাজের ভেতরে আটকা পড়ে যান। এতে অনেক সময় গুরুতর আহত হন তারা।

১২ বছর বয়স থেকে শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে কর্মরত ৩৯ বছর বয়সী কামরুল (ছদ্মনাম) বলেন, ‘শিপইয়ার্ডে কাজ করার সময় আমরা নিরাপদ থাকি না। কখনও ধারালো ধাতব পদার্থ, কখনও আগুন আমাদের আঘাত করে। বেশিরভাগ শ্রমিকই কোনো না কোনো সময় পুড়ে যায়। আমি কখনোই নিরাপদ বোধ করি না এখানে।’

২৫ বছর বয়সী হাসান (ছদ্মনাম) বলেন, একটি জাহাজের দোতলা থেকে পড়ে যাওয়ার পরে ২০২১ সালের এপ্রিলে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে কোনও সুরক্ষা সরঞ্জাম ছিল না, তাই আমি প্রায় সাড়ে চার মিটার নিচে পড়ে গিয়েছিলাম।’

শিপইয়ার্ডগুলোতে জরুরি চিকিৎসারই ব্যবস্থা থাকে না, দায় নেন না ইয়ার্ডমালিকরা

ইস্পাতের টুকরো পড়ে যাওয়া বা জাহাজে আগুন লাগার সময় বা পাইপ বিস্ফোরিত হওয়ার সময় আটকা পড়ার কারণে আহত হওয়ার বর্ণনা দিয়ে চট্টগ্রামে জাহাজভাঙার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা জানিয়েছেন, শিপইয়ার্ডগুলোতে জরুরি চিকিৎসারই ব্যবস্থা থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে আহত সহকর্মীদের সৈকত থেকে রাস্তায় নিয়ে যেতে কিংবা তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য কারও ব্যক্তিগত গাড়িতে ঠাঁই পাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হয়। বাংলাদেশে শিপব্রেকিং শিল্পে কর্মরত পুরুষ শ্রমিকদের গড় আয়ু সাধারণ গড়ের চেয়ে ২০ বছর কম। ৩১ বছর বয়সী এক জাহাজভাঙা শ্রমিক বলেন, ‘আমি যেখানে কাজ করি সেখানে যদি এক মুহূর্তের জন্যও অন্যমনস্ক হই, তাহলে আমি মুহূর্তেই মরে যাবো।’

২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর মধ্যরাতে অবৈধভাবে চলা রাতের শিফট চলাকালে ২০ বছর বয়সী রাকিব (ছদ্মনাম) একটি ভারী লোহার টুকরা কাটার সময় তার বাম পা কেটে যায় এবং একটি লোহার রড ঢুকে তার পেটে ছিদ্র হয়ে যায়। অন্য শ্রমিকরা তাকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করার আগেই তিনি অন্তত ৪৫ মিনিট মাটিতে নিথর পড়ে থাকেন। যেহেতু তিনি মাঝরাতে কাজ করছিলেন, সেখানে কোনও গাড়ি বা রিকশাও ছিল না। পরে তার সহকর্মীরা তাকে কাঁধে করে কাছের হাসপাতালে নিয়ে যান। রাকিব বলেন, ইয়ার্ডমালিক শুধু চিকিৎসার অল্প খরচ বহন করতে ইচ্ছুক ছিলেন। এ কারণে ১৭ দিন পর তাকে হাসপাতাল ছেড়ে আসতে হয়। তার পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়।

রাকিব বলেন, ‘আমার বয়স মাত্র ২০ বছর। এই দুর্ঘটনায় আমার জীবন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।’

অন্যদিকে , বড় আকারের একটি জাহাজকাটায় নিয়োজিত ২৬ বছর বয়সী আহমেদ (ছদ্মনাম) বলেন, ‘জাহাজটি অনেক বড়। আমরা দড়ির সিঁড়ি ব্যবহার করে পাশে ঝুলে ঝুলে জাহাজটি কেটে ফেলেছি। শ্রমিকরা মাঝে মাঝে পিছলে পানিতে পড়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘যদি কোম্পানি জানতে পারে যে আমি আপনার সাথে কথা বলেছি, তাহলে আমি প্রতিশোধের সম্মুখীন হবো এবং আমার চাকরিটা হারাবো। কিন্তু আমি আপনাকে যা বলছি, তা সত্য। আমি জানি না, শিপব্রেকিং ইয়ার্ড কোম্পানিগুলো কখনও আমাদের মানুষ হিসেবে ভাববে এবং আদৌ নিরাপত্তার সরঞ্জাম দেবে কি না।’

২৭ বছর বয়সী সোহরাব (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমি প্রতিদিন মাত্র ২০০ টাকা আয় করি, তাই ৮০০ টাকা দামের গামবুট কিনতে পারি না। এ কারণে আমি খালি পায়ে কাজ করি। শ্রমিকরা প্রায়ই আগুনের কারণে বা পায়ে তার বা পেরেকের আঘাতে আহত হন। কোম্পানি আমাদের নিরাপত্তার জন্য কিছুই দেয় না। আমি নিরাপত্তার সরঞ্জাম চাইলে কোম্পানির মালিকরা বলে, ‘সমস্যা থাকলে চলে যান।’

এদিকে শিপব্রেকিং শ্রমিকদের ওপর ২০১৯ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ইয়ার্ডগুলোতে কর্মরত শ্রমিকের ১৩ ভাগই শিশু। তবে গবেষকরা বলেছেন, অবৈধভাবে চলা রাতের শিফটে এই সংখ্যাটি ২০ ভাগে পৌঁছায়। প্রতিবেদনের জন্য সাক্ষাৎকার নেওয়া অনেক শ্রমিকও ১৩ বছর বা কাছাকাছি বয়স থেকে ইয়ার্ডে কাজ করে আসছেন।

শিপব্রেকিং শ্রমিকরা জানান, কর্মস্থলে আহত হলেও শ্রম আইন লঙ্ঘন করে প্রায়ই তাদের বিরতি বা অসুস্থতার ছুটি দেওয়া হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, জাহাজভাঙা শ্রমিকদের মজুরি হয় খুবই কম। কাজ করার জন্য আনুষ্ঠানিক চুক্তিও থাকে না। ফলে ইয়ার্ডমালিকরা শ্রমিকের মৃত্যু এবং আহত হওয়ার ঘটনাগুলো ধামাচাপা দিতে পারেন সহজেই। আবার শ্রমিকরা যখন ইউনিয়ন বা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেন, তখন তাদের কাজ থেকে বের করে দেওয়া হয়। হেনস্তা কিংবা হয়রানিও করা হয়।

২৭ বছর বয়সী শ্রমিক অশোক (ছদ্মনাম) বলেন, ‘কিছু কোম্পানি শ্রমিকদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নেয় শুধুমাত্র অফিসিয়াল উদ্দেশ্যে। কিন্তু আসলেই এই ‘চুক্তি’ শ্রমিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয় না। কখনও আমরা একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করি, তবে কখনও কখনও কেবল একটি সাদা কাগজেও স্বাক্ষর নেওয়া হয়।’

২২ বছর বয়সী সৈয়দ (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমাদের কোনও শ্রমিক ইউনিয়ন নেই, যারা আমাদের অধিকারের জন্য লড়াই করতে পারে। কেউ আমাদের পক্ষে বা আমাদের অধিকার নিয়ে কাজ করে না।

২৮ বছর বয়সী সোহেল বলেন, ‘কোম্পানি মালিকদের চাপের কারণে ইয়ার্ডের ভেতরে বা বাইরে জাহাজ ভাঙা শ্রমিকদের জীবন সবসময় আড়ালে থাকে। আমরা যদি কথা বলি বা আওয়াজ তুলি, তাহলে আমরা চাকরি হারাবো।’

শ্রমিকরা জানান, সপ্তাহে ছয় দিন ৮-১২ ঘণ্টার শিফটে কাজ করার পরও তাদের খুব কমই বিরতি বা বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া হয়। ২৮ বছর বয়সী আরিফুল (২৮) বলেন, ‘বিশ্রাম করতে গেলে তাদের ধমক দেওয়া হয়। ফোরম্যান বা ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের বসে থাকতে বা বিশ্রাম নিতে দেখে তখন তারা আমাদের গালি দেয়।’

শ্রমিক অধিকারকর্মী রাশেদ বলেন, ‘শ্রমিকদের কোনো লিখিত চুক্তি নেই। এর অর্থ, মালিকরা মজুরি দিতে অস্বীকার করতে পারেন। নিয়োগকর্তারা সরকারঘোষিত ন্যূনতম মজুরিও দেন না। মালিকরা শুধু তাদের ইচ্ছামতো টাকা দেন।’

জীবনের কোন দাম নেই এখানে 

শ্রমিকরা যখন নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই জাহাজকাটার কাজ করেন, তখন অনেক বিষাক্ত পদার্থও শ্বাসের মাধ্যমে তাদের শরীরে ঢুকে যায়। ৫০ বছর বয়সী তানভীর (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমরা যখন কাটার কাজ করি, তখন ধোঁয়ার কারণে কাশি ও শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যায় পড়ি।আমাদের কোনও রেসপিরেটর (কৃত্রিম শ্বসন চালু রাখার যন্ত্র) সরবরাহ করা হয় না, তাই আমরা নিজেদের পোশাকআশাককে মাস্ক হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করি। কিন্তু এরপরও ধোঁয়া বের হয়।’

৪৫ বছর বয়সী অশোক তার ১০ বছর বয়স থেকে শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে কাজ করছেন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিপইয়ার্ডের মালিকরা বর্জ্য রাখার জন্য কিছু স্টোরেজ রুম তৈরি করলেও সেই বর্জ্য সমুদ্রে ফেলে দিচ্ছে।’

২৫ বছর বয়সী এজাজ ছিলেন মূলত একজন জেলে। সেই কাজ হারানোর পর তিনি জাহাজ ভাঙার কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘জাহাজের জ্বালানি ও রাসায়নিক পানিতে ফেলার পর সেই পানি দূষিত হয়ে যায়, যা সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও মাছের জন্য ক্ষতিকারক। জেলেরা আগের মতো মাছ পাচ্ছে না। এখানকার উপকূলীয় এলাকায় মাছের ঘাটতি রয়েছে।’

শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে আহত হওয়ার পর মাছ বিক্রি শুরু করা ৪৪ বছর বয়সী মাসুম বলেন, ‘জাহাজের বিষাক্ত বর্জ্য থেকে সমুদ্রের পানি বিষাক্ত হচ্ছে। তাই জেলেরা কোনো মাছ খুঁজে পাচ্ছেন না। মাছ সব মরে যাচ্ছে।’

ইউরোপের শিপিং কোম্পানিগুলো টাকার জন্য অভিনব কৌশল

আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক আইনে পর্যাপ্ত পরিবেশগত বা শ্রম সুরক্ষা না থাকা বাংলাদেশের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে জাহাজ রপ্তানি নিষিদ্ধ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এবং বেলজিয়ামভিত্তিক ‘শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম’ বলছে, অনেক শিপিং কোম্পানি নিয়মকানুন এড়িয়ে যাওয়ার এবং অপরাধ এড়ানোর উপায় খুঁজে পেয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পতাকাবাহী জাহাজগুলোকে ইইউর বিধিবিধান মেনে তাদের পুরনো জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে— যার কোনোটিই বাংলাদেশের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে নেই। ফলে ইউরোপের শিপিং কোম্পানিগুলো কৌশলে অন্য দেশের ‘পতাকা’ ব্যবহার করে ইইউর বিধিবিধানগুলো এড়িয়ে চলে। দেখা গেছে, ২০২২ সালে সারা বিশ্বে পরিত্যক্ত ঘোষিত হওয়া জাহাজের ৩০ ভাগই ছিল ইউরোপীয় শিপিং কোম্পানির মালিকানাধীন। কিন্তু স্ক্র্যাপের জন্য বিক্রি করার সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পতাকা ছিল মাত্র মাত্র পাঁচ ভাগ জাহাজে। বাকি ২৫ ভাগ জাহাজই ভিন্ন দেশের ‘পতাকা’র ওপর ভর করে বাংলাদেশের সীতাকুণ্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বেলজিয়ামভিত্তিক ‘শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের’ প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ইংভিল্ড জেনসেন বলেন, ‘জাহাজভাঙা শ্রমিকরা মারাত্মক পরিণতির পাশাপাশি চরম ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে। এই শিল্পের কারণে সংবেদনশীল উপকূলীয় পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। টেকসই জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের খরচ অবশ্যই শিপিং সেক্টরকে বহন করতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ ও পরিবেশকে নয়ই।’

খালেদ / পোস্টকার্ড ;