শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বুলিং দমনে কাজ শুরু, ‘বুলিং’করলেই বহিষ্কার

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বুলিং দমনে কাজ শুরু, ‘বুলিং’করলেই বহিষ্কার

এম মামুন হোসেন ।।

ভয়ঙ্কর সব বুলিং গ্রুপ দেশের নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তৈরি হচ্ছে । শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে এ মন্দ সংস্কৃতি। বুলিং গ্রুপ ঐক্যবদ্ধ হয়ে দুর্বল শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক আঘাত করার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে।

এতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হয়। এ ছাড়াও অনেক সময় আত্মহত্যার মতো পথও বেছে নেয় বুলিংয়ের শিকার এ শিক্ষার্থীরা। তাই বুলিং রোধে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কারের বিধান রেখে ‘বুলিং’ প্রতিরোধ কাউন্সেলিং নীতিমালা করতে যাচ্ছে সরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘বুলিং’ প্রতিরোধে কাউন্সেলিং করা হবে।

খসড়ায় বলা হয়েছে, অভিযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে প্রতিষ্ঠান থেকে সাময়িক বা স্থায়ী বহিষ্কারের বিধান রাখা হয়েছে। এর বাইরে বুলিংয়ের ধরন পর্যালোচনা করে দেশের প্রচলিত আইনেও ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রাখা হয়েছে।

গত বছরের ডিসেম্বরে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারী আত্মহত্যার ঘটনার পর ‘শুধু শিক্ষার্থী নয় শিক্ষকদেরও মানসিক কাউন্সেলিং দরকার’ বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট। সে  পরিপ্রেক্ষিতে আত্মহত্যা প্রতিরোধে নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু করে সরকার।

স্কুল চলাকালীন বা শুরুর আগে ও পরে, ক্লাস রুমে, স্কুলের ভেতরে, প্রাঙ্গণে বা স্কুলের বাইরে কোনো শিক্ষার্থী দ্বারা অন্য শিক্ষার্থীকে শারীরিক আঘাত করা বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা, অশালীন বা অপমানজনক নামে ডাকা, অসৌজন্যমূলক আচরণ করা, কোনো বিশেষ শব্দ বারবার উত্ত্যক্ত বা বিরক্ত করাকে স্কুল বুলিং হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সাধারণত স্কুলে মৌখিক, শারীরিক ও সামাজিক এ তিন ধরনের বুলিং হয়ে থাকে। মৌখিক বুলিং হলো কাউকে উদ্দেশ করে এমন কিছু বলা বা লেখা, যা খারাপ কোনো কিছুর প্রতি ইঙ্গিত করা যেমন উপহাস, খারাপ সম্বোধন বা ডাকা, অশালীন শব্দ ব্যবহার করা বা হুমকি দেওয়া। শারীরিক বুলিং বলতে কাউকে আঘাত করা, হাত দিয়ে চড়-ধাপ্পড় বা পা নিয়ে লাথি মারা, ধাক্কা মারা, খোঁচা মারা, কারও জিনিসপত্র জোর করে নিয়ে যাওয়া বা ভেঙে দেওয়া, মুখ বা হাত দিয়ে অশালীন বা অসৌজন্যমূলক অঙ্গভঙ্গি করাকে বোঝায়। সামাজিক বুলিং বলতে বোঝানো হয়েছে সামাজিক স্ট্যাটাস, এক বা দলগত বন্ধুত্ব বা পারস্পরিক সম্পর্ক, পরিচিতি বা বংশগত অহংকারবোধ থেকে কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা বা তা করতে প্ররোচিত করা বা কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে বারণ করা, কারও সম্পর্কে গুজব ছড়ানো, প্রকাশ্যে কাউকে অপমান করা, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাত তুলে কোনো কথা বলা ইত্যাদি। এ ছাড়াও সাইবার বুলিং হলো বাজে মেসেজ পাঠানো, কোনো গোপন বিষয় মিডিয়ায় প্রকাশ করে দেওয়া, অনলাইনে হুমকি দেওয়া।

বুলিং প্রতিরোধে খসড়া নীতিমালায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ শেখানোর দিকে বেশি নজর দিতে হবে। নীতিমালায় বুলিংয়ের ব্যাপারে কঠোর নীতি অবলম্বন করাতে বলা হয়েছে। বুলিং করলে কঠোর শাস্তি পেতে হয়, এ ধারণা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে।

বুলিং করলে স্কুল থেকে টিসি দিয়ে দেওয়া হবে, এমন বার্তা সবার মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার কথা খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে। প্রয়োজনে টিসি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। বুলিংয়ের ঘটনা ঘটলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে কোনো শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে আঘাত করা যাবে না। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করতে হবে। অভিভাবকদের ডেকে বোঝাতে হবে। বুলিং রোধে বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ, করিডোর ও ক্লাসরুমে সিসি ক্যামেরা বসানোর পাশাপাশি মনিটরিং করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে বুলিংয়ের ব্যাপারে আতঙ্ক কাজ করবে। বুলিংয়ের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হয়, এমন নাটক-সিনেমা দেখার পাশাপাশি স্কুলে এসব নাটক শিক্ষার্থীদের দিয়ে মঞ্চস্থ করানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বুলিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীকে প্রথমে মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক-কর্মচারীদের মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।

বুলিং ক্রিমিনাল ক্রাইম না হলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে পুলিশের সাহায্য নিতে পারবে। শিক্ষকদের চাপমুক্তভাবে নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখার পর্যাপ্ত ক্ষমতা দিতে হবে। বুলিংয়ের শিকার ও বুলিং করা উভয়কে যত্মসহকারে কাউন্সেলিং করে তাদের আচরণ পরিবর্তন করাতে হবে। স্কুলের যেকোনো পরিস্থিতিতে প্রয়োজনে অভিভাবকদের সঙ্গে মিটিং করতে হবে এবং সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। স্কুলে কোনো প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা না করতে পারে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। ধর্ম-গোত্র ইত্যাদি যেকোনো বিষয়ে যেন বৈষম্য তৈরি না হয় তার দিকে নজর দিতে হবে। স্পেশাল প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা যাতে শারীরিক-মানসিকভাবে আঘাত না পায়, সে বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

অভিভাবকদের করণীয় বিষয়ে বলা হয়েছে, সন্তানকে স্কুলের নিয়মকানুন মেনে চলা, অন্য শিক্ষার্থী বা বন্ধুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য নিয়মিত উদ্বুব্ধ করতে হবে। সন্তানকে সর্বোচ্চ ভালোবাসার মধ্য দিয়ে লালন-পালন করতে হবে। তাদের মধ্যে মূল্যবোধ শেখাতে হবে, যাতে তারা বুলিংকারী না হয়ে ওঠে। নিজ সন্তানকে বুলিংকারী বা বুলিংয়ের শিকার যাই হোক না কেন, পূর্বাপর কিছু না জেনে অভিভাবকদের ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সন্তানদের সামনে মা-বাবা কারও সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হবেন না। বুলিংকারী শিক্ষার্থীরা স্কুলে কোনো পদক্ষেপ নিলে অভিভাবকরা তার বিরোধিতা না করে স্কুলকে সহযোগিতা করার কথা নীতিমালায় বলা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, নীতিমালা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। নীতিমালার আলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বুলিং দমনে কাজ শুরু করবে এ সংক্রান্ত গঠিত কমিটি।