লবণাক্ততা ও দুর্গন্ধে মুখে নেওয়া যাচ্ছে না ওয়াসার পানি

লবণাক্ততা ও দুর্গন্ধে মুখে নেওয়া যাচ্ছে না ওয়াসার পানি
লবণাক্ততা ও দুর্গন্ধে মুখে নেওয়া যাচ্ছে না ওয়াসার পানি

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম ।। 

চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ওয়াসার সরবরাহ করা পানি লবণাক্ততা ও দুর্গন্ধের কারণে মুখে নেওয়া যাচ্ছে না। এমন অভিযোগ নগরবাসীর। নগরবাসীর তথ্য মতে, রোজার আগে থেকে এ সমস্যা শুরু হলেও রোজার শেষ সময় থেকে পানির লবণাক্ততা ও দুর্গন্ধ বেড়েছে কয়েকগুণ। 

নগরীর পাঁচলাইশ হিলভিউ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা আইনজীবী মো. আবুল মনছুর বলেন, ওয়াসার পানি সবসময় ফুটিয়ে পান করতে হয়। সরাসরি পান করা যায় না। বিভিন্ন ধরনের ময়লা-জীবাণু থাকে এ পানিতে। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে ওয়াসার পানি ফুটিয়েও পান করা যাচ্ছে না। কারণ এ পানি অত্যন্ত লবণাক্ত। সেই সঙ্গে দুর্গন্ধও। এ কারণে তিনি বলেন, ওয়াসার কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানিয়েছি। কিন্তু কোনো সুরাহা মিলছে না। এ অবস্থায় প্রতিদিন বোতলজাত মিনারেল ওয়াটার কিনে খেতে হচ্ছে। এতে মিনারেল ওয়াটারের দামও বেড়ে গেছে। প্রতি লিটার মিনারেল ওয়াটার এখন ৩০-৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এভাবে কতদিন পানি কিনে পান করতে হবে তাও বলা যাচ্ছে না।

নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ফওজিয়া জান্নাত বলেন, ওয়াসার পানিতে এত লবণ, রান্নাবান্নায় আর লবণ ব্যবহার করতে হচ্ছে না। চায়ে চিনি দিলেও লবণ কাটে না। এই পানি ফোটালে লবণের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। মুখে নিলে জিহ্বা পুড়ে যাওয়ার মতো লাগে। নগরীর মুরাদপুর এলাকার একাধিক বাসিন্দা জহিরুল ও আনোয়ার জানান, কতদিন পর পর ওয়াসার পানিতে হয় লবণাক্ততা, না হয় দুর্গন্ধ দেখা দেয়। আবার কখনো ময়লা পানিও আসে। এবার সরবরাহ করা পানি অত্যন্ত লবণাক্ত। যা অসহনীয়। ওয়াসা দফায় দফায় পানির বিল বাড়ালেও পানির মান বৃদ্ধি করছে না। লবণাক্ত পানি না খেয়েও একদিকে বিল দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে পানি কিনে খেতে হচ্ছে। এমনিতেই সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধিতে নগরবাসীর নাভিশ্বাস উঠছে। তার ওপর পানি কিনে খাওয়া, আবার ওয়াসার বিল পরিশোধ করা যেন রাষ্ট্র প্রদত্ত গজবে পরিণত হয়েছে।

নগরীর বহদ্দারহাট এলাকার নিউ চান্দগাঁও এলাকার বাসিন্দা প্রবাসী এমরান হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের মরুর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, ওমানসহ সবকটি দেশে যেখানে মিঠা পানির অভাবে সাগরের পানি পরিশোধনের মাধ্যমে লবণমুক্ত করে সরবরাহ করা হচ্ছে, সেখানে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী ও হালদার মতো মিঠা পানির ভান্ডারকে সাগরের লবণাক্ত পানি থেকে মুক্ত রাখতে পারছে না ওয়াসা। জোয়ারের সময় সাগর থেকে উঠে আসা লবণ পানিতে মিশে যাচ্ছে। যা তুলে কোনোরকম পরিশোধন ছাড়াই সরবরাহ করছে ওয়াসা। এ পানি মুখে নেওয়া যাচ্ছে না। এ পানি জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকরও।

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াছ হোসেন বলেন, ওয়াসার পানিতে যে হারে লবণ অনুভূত হচ্ছে তাতে নগরবাসীর উচ্চ রক্তচাপ বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ থেকে হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রকম চর্মরোগ দেখা দিতে পারে। দেখা দিতে পারে মারাত্মক জটিল রোগও। রোজার অনেক আগে থেকে ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে লবণ অনুভূত হলেও রোজার মধ্যে ওয়াসার পানিতে লবণের পরিমাণ আরও বেড়েছে। এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম ফজলুল্লাহ বলেন, শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ায় কাপ্তাই লেকে পানি কমে গেছে। এ কারণে জল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পানি ছাড়া হচ্ছে না কর্ণফুলী নদীতে। এতে নদীর উজানে মিঠা পানির প্রবাহ কমে গেছে। জোয়ারের সঙ্গে কর্ণফুলী হয়ে হালদা নদীতে ঢুকছে সাগরের লোনা পানি। ফলে মোহরা শোধনাগারে পানি শোধনের পরও অতিরিক্ত লবণ থেকে যাচ্ছে। গভীর নলকূপের পানি মিশিয়ে সমস্যা কাটানোর চেষ্টা চলছে। তিনি আরও বলেন, সরবরাহের আগে আমরা নিয়মিত পানি পরীক্ষা করছি। ওয়াসার পানির লবণাক্ততা বর্তমানে সহনীয় পর্যায়ে আছে। ব্যবহারের সময় লবণাক্ততা অনুভব হলেও তা মানব স্বাস্থ্যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে না। চট্টগ্রাম ওয়াসা থেকে নগরে যে পানি সরবরাহ করা হয় তা ডব্লিউএইচওর গাইডলাইন অনুযায়ী শতভাগ জীবাণুমুক্ত। খাবার অনুপযোগী হলে আমরা পানি বন্ধ করে দেব।

ওয়াসার তথ্য মতে, মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্প থেকে পানি সরবরাহ করা হয় চট্টগ্রাম মহানগরীতে। প্রকল্পটি চালু হয় ১৯৮৭ সালে। এরপর ১৯৯৫ সালে প্রথমবারের মতো পানিতে লবণাক্ততার সমস্যা দেখা দেয়। এরপর ২০০৭, ২০০৯ ও ২০২২ সালেও হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততা দেখা দেয়। বিষয়টি সুরাহার জন্য ২০০৯ সালে গঠন করা হয় কারিগরি কমিটি। এ কমিটি পরে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়াসহ বেশ কিছু সুপারিশ করে। সেখানে শুষ্ক মৌসুমে অমাবস্যা ও পূর্ণিমার সময় নদীর পানির লবণাক্ততা রোধে কাপ্তাই হ্রদ থেকে অতিরিক্ত পানি ছাড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এ কারণে কাপ্তাই জল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বর্ষা মৌসুম থেকে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে পিডিবিকে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।

কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ম্যানেজার এটিএম আবু জাহের এ প্রসঙ্গে বলেন, কাপ্তাই লেকে পানি কমে গেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫টি ইউনিটের মধ্যে ৪৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি মাত্র ইউনিট চালু আছে। এটিতে মাত্র ২৫-৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। পানি কমে যাওয়ায় সবকটি ইউনিট চালু করা যাচ্ছে না। বর্তমানে যা পানি আছে তা দিয়ে এভাবে চলে তা হলে এক মাসের মতো একটি ইউনিট চালু রাখা যাবে। এরপর বৃষ্টি না হলে কেন্দ্রটি বন্ধ করে দিতে হবে। অতিরিক্ত পানি ছাড়ার সুযোগ নেই বলে জানান তিনি ।

খালেদ / পোস্টকার্ড;