সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা , তদারকিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত

সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে  প্রশাসনকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা , তদারকিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত

নিজস্ব প্রতিবেদক ।। 

প্রাণঘাতী মহামারী করোনাভাইরাস এর মধ্যে ঘরের বাইরে সবার মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে জোর দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে সচেতনতামূলক পদক্ষেপের সঙ্গে প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আইন প্রয়োগ করতে মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার ভার্চুয়াল বৈঠকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছেন। গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী ও সচিবালয় থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সচিবরা যুক্ত ছিলেন।

সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আমরা দেখছি ইউরোপ-আমেরিকায় আবার করোনাভাইরাসের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। সে জন্য প্রধানমন্ত্রী বিশেষভাবে নজর দিয়েছেন, সবাই যাতে সতর্ক থাকি, সবাই যেন মাস্ক ব্যবহার করি। বাকি কী হবে না হবে সেটা অনিশ্চিত বিষয়। মাস্ক যদি আমরা সবাই ব্যবহার করি, তাহলে আমাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে। এ জন্য মানুষকে আরও বেশি করে সচেতন করতে হবে, অনেকের মধ্যে একটু শিথিল ভাব দেখা যাচ্ছে।

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ঘরের বাইরে সব জায়গায় সবার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে ২১ জুলাই পরিপত্র জারি করে সরকার। সব ধরনের কর্মস্থলে, বাজার-বিপণিবিতান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়, গণপরিবহন, সামাজিক অনুষ্ঠান এবং রাস্তায় পথচারীদেরও এ নিয়ম মেনে চলতে হবে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্রে বলা হয়। কারা কীভাবে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবেন, সে বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল পরিপত্রে।

পরিপত্রে বলা হয়েছিল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিসে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সেবাগ্রহীতাদের বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। সংশ্লিষ্ট অফিস কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিশ্চিত করবে। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালসহ সব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে আসা সেবাগ্রহীতাদের আবশ্যিকভাবে মাস্ক ব্যবহার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির ও গির্জাসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করবে স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট পরিচালনা কমিটি। শপিংমল, বিপণিবিতান ও দোকানের ক্রেতা-বিক্রেতাদের মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও মার্কেট ব্যবস্থাপনা কমিটি। হাট-বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতারা মাস্ক ছাড়া কেউ পণ্য কেনাবেচা করতে পারবে না, এটা স্থানীয় প্রশাসন ও হাট-বাজার কমিটি নিশ্চিত করবে বলে পরিপত্রে বলা হয়েছিল।

এ ছাড়া সড়ক, নৌ, রেল ও আকাশপথে সব ধরনের গণপরিবহনে চালক, চালকের সহকারী এবং যাত্রীদের মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। গণপরিবহনে চড়ার আগেই যাত্রীদের মাস্ক পরতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং মালিক সমিতি বিষয়টি নিশ্চিত করবে। পোশাক কারখানাসহ সব শিল্প কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করবে সংশ্লিষ্ট মালিকরা। হকার, রিকশা ও ভ্যানচালকসহ পথচারীদের মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। হোটেল ও রেস্তোরাঁয় কর্মরত ব্যক্তি এবং জনসমাবেশ চলাকালে আবশ্যিকভাবে মাস্ক পরতে হবে, বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট মালিক সমিতি নিশ্চিত করবে। সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে আসা ব্যক্তিদের মাস্ক পরা নিশ্চিত করবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রধান। বাড়িতে কারও করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকলে পরিবারের সুস্থ সবার মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। বাংলাদেশে বসবাসরত সবার জন্যই এ নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে জানানো হয়েছে।

তবে অতি সংক্রামক এই ভাইরাস প্রতিদিনই মানুষের মৃত্যু ডেকে আনলেও নানা অজুহাতে এখনও অনেকে মাস্ক ব্যবহার করছেন না। পাবলিক প্লেসে কোনোভাবেই মাস্ক ছাড়া যাওয়া যাবে না জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেনÑ মসজিদ, জনসমাগম স্থল, বা সামনে দুর্গাপূজা আসছে, সেসব জায়গায় কোনোভাবেই কেউ যেন মাস্ক ছাড়া না যায়, তা নিশ্চিত করা হবে। প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার সদস্যরা আশা প্রকাশ করেছেন, সবাই সচেতন হয়ে মাস্ক ব্যবহারে আরেকটু বেশি মনযোগী হবেন, তাহলে অটোমেটিক্যালি আমরা এটা থেকে একটু রিলিফ পাব। মন্ত্রিসভার নির্দেশনা হচ্ছে, সবাই যেন মাস্ক ব্যবহার করি। রোববার কমিশনার সম্মেলন ছিল জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বলে, সেখানে আমরা স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে আমরা বলে দিয়েছি তারা যেন ইমামদের মাধ্যমে প্রতিদিন জোহর ও মাগরিবের নামাজের পরে মাইক বা জামায়াতের সময় বলে দেয়। বাজার, মার্কেট বা গণজমায়েত যেখানে হয়, সেসব জায়গায় যেন একটা সেøাগানের মতো থাকেÑ অনুগ্রহ করে মাস্ক ছাড়া কেউ প্রবেশ করবেন না। মোবাইল কোর্ট ব্যবহারের নির্দেশনা কমিশনারদের দেওয়া হয়েছে। যেভাবে যতটুকু সম্ভব মানুষকে সব জায়গায় রিকোয়েস্ট করে, মোটিভেট করে বা ফোর্স করে যদি করতে হয়, আইন প্রয়োগ করতে হলে আইনও প্রয়োগ করবে, অসুবিধা নেই। এর আগে ১০ অক্টোবর মন্ত্রিসভার বৈঠকেও করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ঘরের বাইরে মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে মাঠ প্রশাসনকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার কমেছে : করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে এ বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে মন্ত্রিসভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে। মন্ত্রিপরিষদ জানায়, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে মন্ত্রিসভার ৪৬ শতাংশ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়েছে। আর গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে বাস্তবায়ন হয়েছিল মন্ত্রিসভার ৫৮ শতাংশ সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের বিরূপ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিদ্যমান অগ্রগতি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কিছুটা ধীর হলেও আশাব্যঞ্জক। এক প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, কেবিনেট ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে, যদিও গত বছরের তুলনায় বাস্তবায়ন একটু কম আছে। সেক্ষেত্রে বাস্তব অবস্থা তো সবাই বুঝতে পেরেছে। নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, করোনার জন্য যে কাজ জমে আছে, সেটা যেন খুব দ্রুত আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারি। আনোয়ারুল জানান, ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্ত্রিসভার ২৫টি বৈঠক হয়। আর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৩টি বৈঠক হয়েছে। ২০১৯ সালে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২৫৮টি সিদ্ধান্ত হয়; এর মধ্যে ২৩৮টির বাস্তবায়ন হয়, বাস্তবায়নের হার ৯২ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ১৬৯টি সিদ্ধান্ত হয়েছে; এর মধ্যে ১১৬টির বাস্তবায়ন হয়েছে, বাস্তবায়নের হার ৬৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৩৭টি আইন জারি করা হয়েছে, প্রক্রিয়াধীন আছে ৩৩টি। আর ১৭টি নীতি, কর্মকৌশল ও কর্মপরিকল্পনা অনুমোদন হয়েছে। এই সময়ে ১৯টি দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক চুক্তি বা প্রটোকল অনুমোদন বা অনুসমর্থন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রিসভার জন্য ২৯৭টি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হয়েছে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উদ্যোগে ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১১৫টি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে বলে মন্ত্রিসভাকে অবহিত করা হয়। জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে মন্ত্রিসভার বৈঠক ও গৃহীত সিদ্ধান্তের সংখ্যা ২০১৯ সালের ওই সময়ের চেয়ে বেড়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

বাংলাদেশ-অস্ট্রিয়া প্লেন চলাচলে চুক্তির অনুমোদন : মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশ ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরের লক্ষ্যে ‘এয়ার সার্ভিস অ্যাগ্রিমেন্ট বিটুইন দ্য অস্ট্রিয়ান ফেডারেল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড দ্য গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক চুক্তির খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। ২০১৮ সালের ১৬ মে ভিয়েনায় বাংলাদেশ ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় প্লেন চলাচল চুক্তি অনুস্বাক্ষরিত হয়। সচিব বলেন, প্রস্তাবিত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে একটি সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনার মূল ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হবে। দুদেশের মধ্যে প্লেন যোগাযোগ স্থাপিত হলে ব্যবসা-বাণিজ্য, শ্রমবাজার, শিল্প, স্বাস্থ্য খাত ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়বে। একই সঙ্গে ইউরোপ ও অন্য দেশের সঙ্গে প্লেন যোগাযোগ সহজতর হবে।

ভিয়েনায় অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান কার্যালয় রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, এটা আমাদের জন্য সেদিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এটা সম্পূর্ণ আকাও (ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন) যে চুক্তি সে অনুসারে করা হয়েছে। চুক্তির মূল বিষয়টি হলোÑ উভয় দেশ পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে যাত্রী ও কার্গো ফ্লাইটের সংখ্যা নির্ধারণ করতে পারবে। চুক্তি অনুস্বাক্ষরের তারিখে একটি সমঝোতা স্মারক দিয়ে উভয় দেশের মনোনীত প্লেন সংস্থা সপ্তাহে সাতটি যাত্রী ও কার্গো ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারবে। তিনি বলেন, কোনো ধরনের ডিসপুট হলে নিজেরা আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করবে। আর যদি না পারে তাহলে আরবিটেশনের সাহায্য নিতে পারবে।