মধ্যরাতে সীতাকুণ্ড থেকে মানবাধিকার নেতা আবু বক্কর গ্রেপ্তার

মধ্যরাতে সীতাকুণ্ড থেকে মানবাধিকার নেতা আবু বক্কর গ্রেপ্তার
মধ্যরাতে সীতাকুণ্ড থেকে মানবাধিকার নেতা আবু বক্কর গ্রেপ্তার

বিশেষ প্রতিবেদক।।

মধ্যরাতে সীতাকুণ্ড থেকে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন সীতাকুণ্ড উপজেলা শাখার সভাপতি হাকীম আবু বক্কর চৌধুরীকে (৫৫) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রবিবার দিবাগত রাত ১টায় উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ বাঁশবাড়িয়া মগপুকুর এলাকাস্থ হরিধন মুন্সি বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশ বলছে, আবু বক্করের বিরুদ্ধে বাঁশবাড়িয়া এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য মো. আবুল মনছুরের দায়ের করা চাঁদাবাজির মামলার প্রেক্ষিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অপরদিকে তার স্ত্রী রহিমা আক্তারের অভিযোগ, মামলা সংক্রান্তে কোনো তথ্য না জানিয়েই মধ্যরাতে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছেলেকে পড়ানোর সময় তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পুলিশ৷ মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কারও কারও রোষানলে পড়েন তার স্বামী। তারাই আবু বক্করের বিরুদ্ধে থানায় মিথ্যা মামলা ঠুকে দিয়েছে।

গ্রেপ্তার আবু বক্কর চৌধুরী ওই এলাকার মৃত হুমায়ুন কবিরের ছেলে। তিনি বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন সীতাকুণ্ড উপজেলা শাখার সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির সদস্য।

জানা যায়, গতকাল রাত ১টায় সীতাকুণ্ড থানা পুলিশের এসআই মো. মুকিব হাসান পুলিশের একটি টীম নিয়ে আবু বক্করের বাড়িতে যান। এসময় তাকে পুলিশের সঙ্গে একটু যেতে হবে বলে জানান এসআই মুকিব। একইসাথে আবু বক্করকে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হতে তাগাদা দেন তিনি। কিন্তু আবু বক্কর ও তার স্ত্রী রহিমা আক্তার কেন ঘর থেকে বের হতে হবে জানতে চাইলে এসআই মুকিব কোন সদুত্তর দেননি। শুধু বলেন, আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। ওই সময় আবু বক্কর তার এসএসসি পরীক্ষার্থী ছেলেকে পড়াচ্ছিলেন। পরে আবু বক্কর বাধ্য হয়ে বের হলে তাকে থানায় নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীতে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আবু বক্করের বিরুদ্ধে থানায় চাঁদাবাজি মামলা হয়েছে। সেই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আবু বক্করের স্ত্রী রহিমা আক্তারের অভিযোগ, তার স্বামী দীর্ঘ ৩ যুগেরও বেশি সময় ধরে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছেন। এসব কাজ করতে গিয়ে তিনি কারও কারও চক্ষুশূলে পড়েন। বিভিন্ন শিল্প গ্রুপের অনিয়ম, বিশেষ করে তার এলাকায় (বাঁশবাড়িয়া) জিপিএইচ ইস্পাত কর্তৃক গ্রামের পানি চলাচলের পথ বন্ধ ও গ্রামের শতশত বাড়িঘর পানিতে প্লাবিত হওয়ার ঘটনায় সর্বাগ্রে সোচ্চার ছিলেন। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে জিপিএইচ, পোর্টল্যাণ্ডসহ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের অন্যায়, পরিবেশ ধ্বংসের কথা এলাকাবাসীর হয়ে ডিসি, ইউএনও, এসিল্যাণ্ডের কাছে তুলে ধরেন। আবু বক্কর চৌধুরীর সামাজিক আন্দোলনের ফলে দখলদাররা বাধ্য হয়ে সরকারি জমি ছেড়ে দেয়। এসব কারণে আবু বক্করকে ঘায়েল করতে একটি পক্ষ পিছু নেয়। সময় সময় ওই পক্ষ তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ঠুকে দিচ্ছে। নিয়মিত ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে গ্রেপ্তার তারই অংশ।

বাঁশবাড়িয়া এলাকার স্থানীয়রা জানান, সীতাকুণ্ড উপজেলায় ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য ঘটনায় আবু বক্কর চৌধুরী নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। লড়াই করেছেন সন্তর্পণে, নির্ভয়ে, নিরলসভাবে। বিশেষ করে নারী নির্যাতন, জবরদখল, শিশু নির্যাতনের ঘটনায় বেশ সরব আবু বক্কর চৌধুরী। তার এমন নির্মোহ, নিঃস্বার্থ মানবিক কাজ পুরো উপজেলাজুড়ে প্রশংসিত হয়। একসময় তিনি পরিচিতি পান মানবাধিকার নেতা হিসেবে। গণমাধ্যমেও পরিচিত মুখ আবু বক্কর চৌধুরী। প্রায়সময় তিনি বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকে এলাকার পরিবেশ, কৃষি, বনায়ন, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, মানবাধিকার তথা মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলেন, বিবৃতি দেন। যেখানেই অন্যায়, অনিয়ম, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সেখানেই আবু বক্কর চৌধুরী ছুটে গেছেন। তার মতো ব্যক্তি চাঁদাবাজি করা দূরে থাক। রীতিমতো চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে লড়ছেন।

জানা যায়, গত ৩ এপ্রিল মানবাধিকার নেতা আবু বক্কর চৌধুরী তার প্রতিবেশী সাবেক ইউপি সদস্য আবুল মনছুর, আবদুল মুরাদ, কাইসারসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সীতাকুণ্ড থানার ওসির কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে তিনি পাহাড়ে ১’শ পরিবারের বাগান নিয়ে ওই তিন ব্যক্তির সঙ্গে বিরোধের কথা খোলাসা করেন।

তিনি অভিযোগে উল্লেখ করেন, গত ১ মার্চ বিবাদীরা জঙ্গল বাঁশবাড়িয়া মৌজার পাহাড়ি বাগানে অগ্নিসংযোগ করে প্রায় ৫০টি পরিবারের বাগান পুড়িয়ে দেয়। একইসাথে তারা ২০টি পরিবারের বাগানের সীমানা পিলার নাড়াচাড়া করেন। ২০২০ সালে আবুল মনসুর ২০টি পরিবারের বাগানের বিপুল সংখ্যক গাছপালা কেটে বিক্রি করে দেন। পরবর্তীতে আবু বক্কর, সোলেমানসহ কয়েকজন বাগানমালিক ও আবুল মনছুরের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

ওই বৈঠকে আবুল মনছুর তার বাগানের মালিক আমেরিকা প্রবাসী মুরাদ দেশে আসলে কেটে ফেলা গাছপালার ক্ষতিপূরণ দিবে বলে জানায়। কিন্তু এর কিছুদিন পরই বৈঠকের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে আবু বক্কর ও আরও কয়েকজন বাগান মালিকের ১৫০ একর পাহাড়ি জায়গা দখল এবং ২০০ গাছে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠে আবুল মনছুরের বিরুদ্ধে। এরপর বাগান নিয়ে বিরোধ আরও চরম আকার ধারণ করে। কিন্তু থানা পুলিশের পক্ষ থেকে আবু বক্করের দেওয়া অভিযোগের সুরাহা করা হয়নি বলে অভিযোগ করেন আবু বক্কর নিজেই।

এদিকে ২২ এপ্রিল আবু বক্কর চৌধুরীসহ ৬ জনকে আসামি করে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন আবুল মনছুর। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- মো. সোলাইমান, মো. আবুল কাশেম, মো. জসিম উদ্দিন, মো. হারুন ও অজ্ঞাতনামা আরও ২০-২৫ জন। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বেআইনি প্রবেশ, গাছপালা ও স্থাপনার ক্ষতির উদ্দেশ্য অগ্নিসংযোগ, চাঁদা দাবি ও মারধর ও হুমকির অভিযোগ আনা হয়েছে।

মামলার বাদী আবুল মনছুর (৫২) বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের ছমতের পাড়ার মররম আলী সারেং বাড়ির মো. ইউসুফের ছেলে।

এ বিষয়ে জানতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. মুকিব হাসানের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

জানতে চাইলে সীতাকুণ্ড থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আবু সাঈদ বলেন, গতকাল রাতে আবু বক্কর চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে আজ দুপুরে তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আবুল মনছুর নামে একজন চাঁদাবাজির মামলা করেছে। সেই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আবু বক্করের দেওয়া অভিযোগের সুরাহা না করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি আমার জানা নেই। আমি এ অভিযোগ পাইনি।

মানবাধিকার নেতা আবু বক্কর চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন সীতাকুণ্ড উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ডাকাত করে বুক ফুলিয়ে হাঁটতে পারে, খুনি খুন করে ঘুরে বেড়ায়। আর মানবাধিকার নেতা আবু বক্কর চৌধুরীর নামে মিথ্যা মামলা হতেই দেরি করা যাবে না, সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। এটা কেমন কথা।

তিনি আরও বলেন, আমরা তাকে গ্রেপ্তারের ও তার নামে মিথ্যা, ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়েরের প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সেই সাথে পুলিশের কাছে আমাদের অনুরোধ তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করার। প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় আনার জন্য অনুরোধ জানান তিনি।

খালেদ / পোস্টকার্ড;