পাখিদের অভয়ারণ্য বানাতে গাছ কাটছে প্রশাসন !

পাখিদের অভয়ারণ্য বানাতে গাছ কাটছে প্রশাসন !
পাখিদের অভয়ারণ্য বানাতে গাছ কাটছে প্রশাসন

বিশেষ প্রতিবেদক।।

পাখিদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল বানাতে নির্বিচারে গাছে কাটছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কাট্টলী উপকূলে বনবিভাগের তত্ত্বাবধানে বঙ্গোপসাগরের তীরে গড়ে ওঠা ম্যানগ্রোভ বন কেটে এ অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হচ্ছে।

এই পার্কের নাম দেওয়া হয়েছে ডিসি ফ্লাওয়ার পার্ক। আর এজন্য ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার গাছ কাটা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগ।

সোমবার (৫ জুন) বিশ্ব পরিবেশ দিবসের দিন সীতাকুণ্ডের আউটার রিং রোড সংলগ্ন ডিসি ফ্লাওয়ার পার্কে গাছ কাটার এ ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন উপকূলীয় বন কর্মকর্তা আব্দুর রহমান। 

তিনি বলেন , পার্ক নির্মাণের অংশ হিসেবে জায়গাটি সমতল করার জন্য এই গাছগুলো কাটা হয়েছে। প্রকৃতির উপর ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। আমাদের রেঞ্জ কর্মকর্তা সেখানে গিয়ে দেখেন স্কেভেটর দিয়ে নির্বিচারে গাছপালা ও মাটি কাটা হচ্ছে। তখন জানতে চাইলে তারা বলেছেন ডিসির নির্দেশে কাজ হচ্ছে। এখানে রাস্তা করা হবে। পরে রেঞ্জ কর্মকর্তা বিষয়টি আমাকে জানালে আমি কাজ বন্ধ করে দিতে বলি। খবর দেয়ার পর সীতাকুণ্ডের ইউএনও সেখানে গিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, আমি ডিসি মহোদয়কে জানিয়েছি বিষয়টি। আমি বলেছি যে আপনি যদি কিছু করতে চান তাহলে মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে করুন। এভাবে গাছপালা কাটা উচিত হচ্ছে না।

উপকূলীয় বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুর রহমান আরও বলেন, ‘জায়গাটি বন আইনের ৪ ও ৬ ধারায় গেজেট নোটিফিকেশন করা আছে। সংরক্ষিত বনের জন্য ২০ ধারায় নোটিফিকেশন হওয়া বাকি রয়েছে। নতুন কোনো চর উঠলে তাতে বন সৃজন করে উপকূলীয় বন বিভাগ। তখন পর্যায়ক্রমে ৪ ও ৬ ধারায় নোটিফিকেশন করা হয়। এরপর ২০ ধারায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন। কাট্টলী উপকূলে যেখানে পার্কের কাজ চলছে সেখানে বন বিভাগের নিজস্ব বাগান রয়েছে। যা ১৯৯১ সালে করা হয়েছিল। কেননা ৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর উপকূলের মানুষ অরক্ষিত হয়ে যায়। প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে উপকূলের মানুষকে বাঁচাতে তখন বন গড়ে তোলা হয়।’

আব্দুর রহমান বলেন, 'বন করার আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের বনভূমি বৃদ্ধি করা। কিন্তু জেলা প্রশাসন আমাদের না জানিয়ে নির্বিচারে গাছপালা কেটে ফেলেছে। যদি কেউ নতুন করে গাছ লাগায়ও তাও এটা করতে পারেন না। দেশে আইন আছে। গাছ কাটা যাবে না। সরকারি কোনো কিছু করতে হলে যদি গাছ কাটতে হয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতি নিতে হবে। এভাবে বনের গাছপালা ও মাটি কেটে শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। আমরা বাগান করেছি। তাহলে আমাদের জানানো হয়নি কেন?’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ধ্বংসযজ্ঞের বিষয়টি আমাদের প্রধান কার্যালয়কে জানিয়েছি এবং পরিবশে, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়কে জানাব। তারপর যা সিদ্ধান্ত আসে সেটাই আমরা মেনে নিব।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপকূলীয় বন বিভাগের সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. রাশেদুজ্জামান বলেন, ‘১২টি বড় কেওড়া গাছ কাটা হয়েছে। এ ছাড়া ছয় থেকে আট ইঞ্চি প্রশস্ততার (বেড়) পাঁচ হাজার গেউয়া, ছেইলা ও বাইন গাছ স্কেভেটর দিয়ে ধ্বংস করা হয়। কিন্তু তা আমাদের জানানো হয়নি। আমি সরেজমিনে গিয়ে এ পরিস্থিতি দেখতে পেয়েছি। পরে সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার আমাকে জানিয়েছেন ওনারা ডিসি স্যারের নির্দেশে কাজ করছেন। আমি কেন সরকারি কাজে বাধা দিলাম ? আমি বললাম স্যার, সরকার তো বলেনি বন ধ্বংস করতে । ’

রাশেদুজ্জামান আরও বলেন, ‘ওই এলাকার ১৯৮৪, ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ১৯৯৮ সালের সৃজিত বন রয়েছে। এবং গেজেট নোটিফিকেশনে সেটি বনভূমি এবং ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এলাকা।’

এখানে উল্লেখ্য যে, কাট্টলী উপকূলে ১৯৪ একর জায়গা সম্প্রতি জেলা প্রশাসন অবৈধ দখলমুক্ত করে। ওই জায়গার কিছু অংশে একটি বিনোদন পার্ক করার কথা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়। ওই প্রকল্পের অধীনে প্রায় ১০ হাজার গাছ লাগানোর কথা রয়েছে। সেখানে পাখির আবাসস্থল গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে বলে দাবি করেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাকিব হাসান।

তিনি বলেন, সেখানে কোনো গাছপালা কাটা হচ্ছে না৷ পার্ক থেকে সৈকত পর্যন্ত লম্বা একটি রাস্তা করা হবে। আর এজন্য স্কেভেটর দিয়ে কিছু ঝোপঝাড় পরিস্কার করা হয়েছে। তাছাড়া জায়গাটি ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত এবং জেলা প্রশাসনের জায়গা। মানুষ যেন অবসরে সেখানে সময় কাটাতে পারেন সে উদ্দেশ্যে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে।

জেলা প্রশাসনের দাবি, পার্ক বানাতে গিয়ে সেখানে কোনো গাছপালা কাটা হচ্ছে না। বন বিভাগ গণমাধ্যমকে ভুল তথ্য দিচ্ছে। জেলা প্রশাসন সেখানে নতুন করে ১০ হাজার গাছ লাগিয়ে পাখির আবাস গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। এটি হবে চট্টগ্রামের অন্যতম একটি বিনোদন কেন্দ্র। যা সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান জানান, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় অবৈধ দখলে থাকা বেশ কিছু জমি উদ্ধার করে সেখানে ডিসি পার্ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, যেখানে পাখি ও বন্যপ্রাণীদের আশ্রয়স্থলসহ একটা গ্রিন এরিয়া তৈরি করা হবে বলে জানান তিনি ।

তার দাবি, জায়গাটি এক নম্বর খতিয়ানভুক্ত খাস জায়গা। আগের অবৈধ দখলদাররা সেখানে বিষ দিয়ে গাছগুলো মেরে ফেলেছিল। সেই মরা গাছ তারা সেখান থেকে সরিয়ে নিয়েছেন।

যদিও যে গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে , সবগুলো গাছই সজীব ও জীবন্ত ছিল।

তিনি বলেন, 'পত্রিকার মারফত জানতে পারলাম যে এটা বন আইনের ৪ ধারায় নোটিফায়েড। কিন্তু বনবিভাগ এখনো এই সংক্রান্ত কোনো কাগজ দেখাতে পারেনি'।

খালেদ / পোস্টকার্ড;