জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিনম্র শ্রদ্ধায় মহান বিজয় দিবস উদযাপিত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার অঙ্গীকার

জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিনম্র শ্রদ্ধায় মহান বিজয় দিবস উদযাপিত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার অঙ্গীকার
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিনম্র শ্রদ্ধায় মহান বিজয় দিবস উদযাপিত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার অঙ্গীকার

পোস্টকার্ড প্রতিবেদক ও সাভার প্রতিনিধি।।

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের পর বাঙালি জাতি তার স্বাধীন অস্তিত্ব নতুন ভূখন্ডের হিসাব বুঝে পায়, গতকাল সেই বিজয়ের ৪৮ বছর উদযাপন করছে পুরো দেশ। মহান বিজয় দিবসের সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এবারের বিজয় দিবস এসেছে এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। আগামী বছর স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করবে বাংলাদেশ। এর ঠিক পরের বছর ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হবে। যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগে এসেছে স্বাধীনতা, সোমবার জাতির সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে জাতি। দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে করুণ সুরে বেজে ওঠে বিউগল।
একাত্তরের রণাঙ্গনে শহীদদের শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় সালাম জানান তিন বাহিনীর একটি চৌকস দল। শহীদদের স্মরণে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পরে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে নেতাকর্মীদের নিয়ে আবারও স্মৃতিসৌধে ফুল দেন শেখ হাসিনা। স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে গাছের চারা রোপণ করে পরিদর্শন বইতে সই করেন প্রধানমন্ত্রী।
স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানান জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধান, বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবার, যুদ্ধাহত এরপর সবার জন্য উন্মুক্ত হয় স্মৃতিসৌধ। নামে পতাকা ও ফুল হাতে জনতার ঢল। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে শহীদ বেদী।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। শ্রদ্ধা জানান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।
ভোরের সূর্য ওঠার আগেই ফুল, মাথায় বিজয় দিবস লেখা ব্যান্ড, জাতীয় পতাকা নিয়ে স্মৃতিসৌধে নেমেছিল জনতার এই ঢল। বিনম্র চিত্তে সমগ্র জাতি ত্রিশ লাখ শহীদকে আরও একবার জানিয়ে দিল ‘আমরা তোমাদের ভুলবো না।’
দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে বিজয় দিবসের কর্মসূচি শুরু হয়।
ভোর ৬টা ৩৪ মিনিটে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে স্মৃতিস্তম্ভের বেদীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। এ সময় শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। পরে শেখ হাসিনা দলীয় প্রধান হিসেবে দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীগণ ও আওয়ামী লীগ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিজয় উল্লাসে জাতীয় স্মৃতিসৌধ চত্বর মুখর ছিল বিভিন্ন বয়সি মানুষের পদচারণায়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ধ্বংসাত্মক, নৈরাজ্যকর কর্মকান্ড প্রতিহত করতে নানা সেøাগান, দেশাত্মবোধক গান, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বেজে চলছিল বিরামহীনভাবে। জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসা জনতার এই ঢল অব্যাহত থাকে বিকাল পর্যন্ত।
একে একে বেদীতে শ্রদ্ধা জানায় কেন্দ্রীয় ১৪ দল, শহীদ পরিবারের সন্তান ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা। জাতীয় পার্টি, বিএনপি, গণফোরাম, যুক্তফ্রন্ট, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানায়।
এ ছাড়া আওয়ামী যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, তাঁতিলীগ, জাতীয় পার্টি (জেপি), ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ-’৭১, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, জাকের পার্টি, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদসহ বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন হলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
পরে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে রক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর দলীয় নেতাদের নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তিনি জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এ সময় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এ ছাড়াও গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খানের নেতৃত্বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে দলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এদিকে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সকালে রাজারবাগ স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর পুলিশ সদস্যদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। এতে অন্যদের মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. জাভেদ পাটোয়ারি উপস্থিত ছিলেন। এ সময় ডিএমপির একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করে শহীদদের সম্মান জানান।
দিবসটি উপলক্ষে সকল সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় আলোকসজ্জার ব্যবস্থা হয়েছে। রাজধানী ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়ক দ্বীপগুলো জাতীয় পতাকা ও রঙ-বেরঙের পতাকায় সাজানো হয়।

শহীদদের আত্মার শান্তি, জাতির শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ সব ধর্মের উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। হাসপাতাল, জেলখানা, বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা, শিশু পরিবার ও ভবঘুরে প্রতিষ্ঠানগুলোতে উন্নতমানের খাবার সরবরাহ করা হয়।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে পবিত্র কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় মহান মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী সকল শহিদ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করা হয়। এদিকে সাংস্কৃতিক শক্তিতে সারা দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রত্যয় নিয়ে বিজয় শোভাযাত্রা করেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। ‘বিজয়ের অঙ্গীকার, সাংস্কৃতিক অধিকার’ স্লোগান নিয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের এই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় অংশ নেন দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যরা।
সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বর্ণিল এই শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। শোভাযাত্রাটি শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে ফুলার রোড হয়ে টিএসসিতে গিয়ে শেষ হয়।
স্মারক ডাকটিকেট: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪৯তম বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে একটি স্মারক ডাকটিকেট, উদ্বোধনী খাম এবং ডাটাকার্ড অবমুক্ত করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী সোমবার বিকালে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে ১০ টাকা মূল্যমানের একটি স্মারক ডাকটিকেট ও উদ্বোধনী খাম এবং পাঁচ টাকা মূল্যমানের ডাটাকার্ড অবমুক্ত করেন। এ উপলক্ষে একটি বিশেষ সিলমোহর ব্যবহার করা হয়।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব নুর-উর-রহমান এবং বাংলাদেশ ডাক বিভাগের মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র উপস্থিত ছিলেন।

বায়তুল মোকাররমে দোয়া:

মহান বিজয় দিবস-২০১৯ উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সোমবার সকাল ৯টায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে পবিত্র কোরআনখানি, মিলাদ, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এ সময় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহান মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী সকল শহীদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়।
মিলাদ ও মোনাজাত পরিচালনা করেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি মাওলানা মহিউদ্দিন কাশেম।
এ ছাড়া দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। মোনাজাতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দ্বীনি দাওয়াত ও সংস্কৃতি বিভাগের পরিচালক মো. আনিছুর রহমান সরকারসহ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ মুসল্লিগণ অংশগ্রহণ করেন।
এ ছাড়াও সকাল ১০টায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে মহান বিজয় দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরসের গভর্নর আলহাজ মিজবাহুর রহমান চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সচিব কাজী নূরুল ইসলাম। সভায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন বিভাগের পরিচালক ও কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।