কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বে পৃথিবীর অবস্থা

কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বে পৃথিবীর অবস্থা

আরিফ খান সাদ ।।

আল্লাহর রহমত ও বরকত সম্পূর্ণ উঠে যাবে কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বে পৃথিবী থেকে । ঈমান ও ঈমানদার থাকবে না। মানুষ আর পশুর মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। হঠাৎ একদিন হজরত ঈসরাফিল (আ.) শিঙ্গায় ফুৎকার দেবেন। তার ফুৎকারের পূর্ব মুহূর্তে পৃথিবীর অবস্থা কেমন হবে- সে সম্পর্কে সামান্য আলোচনা তুলে ধরা হলো।
পৃথিবীর শেষ সময়
পশ্চিম দিকে থেকে সূর্যোদয় ও দাব্বাতুল আরদের আবির্ভাবের পর খুব দ্রুত পৃথিবীর ধ্বংস ও মহাপ্রলয় ঘনিয়ে আসবে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনÑ ‘পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয় ও দাব্বাতুল আরদের আবির্ভাবের পর পৃথিবী আর ১২০ বছর অবশিষ্ট থাকবে।’ (ফাতহুল বারি : ১১/৩৫৪)। এই ১২০ বছর খুব দ্রুত অতিবাহিত হবে। হাদিসে এসেছে, নবীজি (সা.) বলেনÑ ‘তখন বছর হবে মাসের মতো। মাস হবে সপ্তাহের মতো। সপ্তাহ হবে এক দিনের মতো। এক দিন হবে এক ঘণ্টার মতো। এক ঘণ্টা হবে খেজুর একটি ডাল আগুনে যেমন দ্রুত ভস্মীভূত হয়ে যায়। সময়গুলো এমন দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাবে।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১০৯৫৬; সহিহুল জামেউস সগির, আলবানি : ৭৪২২)। এই সময়ে অনেক দ্রুত পৃথিবীতে অনেক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটবে। হাদিসে এসেছে, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তাসবিহ দানা ছিঁড়ে গেলে যেমন খুব দ্রুত পুতি খসে খসে পড়ে তেমনিভাবে একের পর এক বড় বড় ঘটনা ঘটতে থাকবে।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৭০৪০; সহিহুল আলবানি : ১৭৬২)
বাতাসের প্রবাহে ঈমানদারদের বিলুপ্তি
দাব্বাতুল আরদের অন্তর্ধানের পর আল্লাহ তায়ালা ইয়েমেনের দিক থেকে রেশমের মতো মোলায়েম একটি বাতাস প্রবাহিত করবেন। যার অন্তরে সামান্য পরিমাণও ঈমান থাকবে তার শরীরে এই বাতাস স্পর্শ করবে। ফলে সব ঈমানদার ব্যক্তির ইন্তেকাল হয়ে যাবে। তারপর পৃথিবীতে কেবল নিকৃষ্ট লোকেরা থাকবে। তাদের ওপর কেয়ামত কায়েম হবে। (মুসলিম : ১১৭, ১৯২৪)। এই বাতাস থেকে কোনো ঈমানদার ব্যক্তিই রক্ষা পাবে না। সব ঈমানদারকেই তা স্পর্শ করবে। হাদিসে এসেছে, ‘ঈসা (আ.) দাজ্জালকে খুঁজে হত্যা করবেন। তারপর মানুষ সাত বছর এমন সুখ-শান্তিতে বসবাস করবে যে, দুজন মানুষের ভেতর সামান্যতম মনোমালিন্য বা ঝগড়াও হবে না। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা একটি শীতল ধরনের বাতাস প্রবাহিত করবেন। ভূপৃষ্ঠের ওপর যেসব মানুষের অন্তরে সামান্যতম ঈমান, কল্যাণ ও ভালো গুণ থাকবে, এমন সব মানুষকে সে বাতাস স্পর্শ করবে। এমনকি যদি পাহাড়ের গুহার ভেতরেও কেউ আশ্রয় নেয় সেখানেও সেই বাতাস ছুটে যাবে এবং তাকে স্পর্শ করবে। ফলে সেও মৃত্যুবরণ করবে।’ (মুসলিম : ২৯৪০)
জৌলুস ও প্রাচুর্য বৃদ্ধি
পৃথিবীতে তখন কোনো ঈমানদার ও ভালো মানুষ থাকবে না। বাহ্যিকভাবে মানুষের মাঝে খুব প্রাচুর্য ও জৌলুস বিরাজ করবে। হাদিসে এসেছেÑ ‘পৃথিবীতে তখন শুধু নিকৃষ্ট আর পাপাচারী লোকেরা থাকবে। তাদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত সুখময় হবে। পাখির মতো ক্ষিপ্রতা থাকবে তাদের। পশু-পাখির মতো স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে। কোনো কল্যাণকর কাজ তারা করবে না। কেউ কোনো মন্দ কাজ করলে বারণ করবে না। তখন শয়তান তাদের সামনে মানুষের আকৃতিতে এসে বলবে আমি তোমাদের যা করতে বলব তোমরা কি তা করবে না? লোকেরা বলবে, তুমি আমাদের কী করতে বল? তখন শয়তান তাদের মূর্তি পূজার আদেশ করবে। সে যুগে মানুষের প্রাচুর্য ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্য অনেক বৃদ্ধি পাবে। অতঃপর শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে।’ (মুসলিম : ২৯৪০)
নগ্নতা ও খোলামেলা যৌনাচার
আল্লাহর ভয়, লজ্জা-শরম সব তখন উঠে যাবে। প্রকাশ্যে খোলামেলা রাজপথে যৌনমিলন খুব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘দাব্বাতুল আরদের পরে পৃথিবীতে ঈমানদাররা চল্লিশ বছর সুখ-শান্তিতে থাকবে। তারপর খুব দ্রুতই সব ঈমানদার মৃত্যুবরণ করবে। তখন পৃথিবীতে শুধু কাফের মুশরিকরা থাকবে। মানুষ চতুষ্পদ জন্তু-জানোয়ারের মতো রাস্তাঘাটে যৌনকর্মে লিপ্ত হবে। যৌনমিলন বৃদ্ধি পেলেও সন্তানাদি হবে না। নারীরা বন্ধ্যা হয়ে যাবে। ত্রিশ বছরের ভেতর পৃথিবীর সব অবৈধ সন্তান হবে। পৃথিবীতে কেবল নিকৃষ্ট লোকেরা থাকবে। তাদের ওপর কেয়ামত সংঘটিত হবে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম : ৭৫৯০; আল-ফিতান, নুয়াইম বিন হাম্মাদ : ১৮৫৭)
কাবা ঘর ধ্বংস ও গুপ্তধন লুণ্ঠন
পৃথিবীতে তখন হাবশি ও কৃষ্ণ লোকদের আধিপত্য বেড়ে যাবে। দেশে দেশে তারা অন্যায় ও অরাজকতা চালিয়ে যাবে। কাবা ঘরের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা হবে এবং ভেঙে ফেলা হবে। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আরবরাই কাবাঘরের সম্মান নষ্ট করে কাবাকে নিরাপত্তাহীন করে তুলবে। এমনটি হয়ে গেলে আরবদের ধ্বংস নিকটবর্তী হয়ে যাবে। অতঃপর হাবশিরা এসে কাবাঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেবে। পরবর্তীতে আর কেউ তা নির্মাণ করতে পারবে না। হাবশিরাই কাবাঘরের রত্ন ভান্ডার লুট করবে।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৭৮৯৭)। অন্য একটি হাদিসে এসেছে, ‘হাবশা থেকে জুল-সুওয়াইকাতাইন নামক এক নির্দয় শাসক কাবা ঘর ভেঙে ফেলবে। একটি একটি করে পাথর খুলে ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবে। কাবার ভেতরের গুপ্তধন বের করে নেবে। এরপর হজ-ওমরা বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ তখন পৃথিবীতে কোনো মুসলিম অবশিষ্ট থাকবে না। কাবা ঘর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার অল্প সময় পর কেয়ামত সংঘটিত হবে। (মুসতাদরাকে হাকেম : ৮৩৯৫)
অদ্ভুত আগুনের উত্থান
সেই চরম থমথমে অবস্থায় পৃথিবীর কয়েকটি স্থান থেকে অদ্ভুত এক আগুনের উত্থান হবে। পৃথিবীর মানুষদের ধাওয়া করতে করতে শামে একত্র করবে। হাদিসে এসেছেÑ ‘ইয়েমেনের আদন বন্দরের একটি পাহাড়ের গুহা থেকে এক ধরনের আগুন বের হবে এবং মানুষদের ধাওয়া করতে থাকবে।’ (মুসলিম : ২৯০১; আবু দাউদ : ৪৩১৩)। অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) তার বাবা থেকে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেনÑ ‘কেয়ামতের পূর্বে ইয়েমেনের হাজরামাউত সমুদ্র বন্দর থেকে আগুনের উত্থান হবে। সে আগুন পৃথিবীর সব মানুষকে এক জায়গায় একত্র করবে।’ (তিরমিজি : ২২১৭)
শামে মানুষের হিজরত
তখন মানুষ পৃথিবীতে কোথাও শান্তি পাবে না। শাম দেশে কিছুটা শান্তি বিরাজ করবে। তাই মানুষ দলে দলে শামে হিজরত করবে। হাদিসে এসেছে, ‘মানুষ দলে দলে মাতৃভূমি ছেড়ে ইবরাহিম (আ.)-এর হিজরতের স্থানে (শামে) হিজরত করবে। আগুন তাদের একত্র করবে। পৃথিবীতে তখন কোনো ভালো মানুষ থাকবে না। সবাই আল্লাহকে ভুলে যাবে এবং বানর ও শূকরের মতো চলাফেরা করবে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম : ৮৪৯৭; সহিহুত তারগিব, আলবানি : ৩০৯১)। এসব লোকদের ওপরই কেয়ামত কায়েম হবে।