কৌশলগত অংশীদারিত্বে পৌঁছাবে বাংলাদেশ-ফ্রান্স সম্পর্ক : প্রধানমন্ত্রী

কৌশলগত অংশীদারিত্বে পৌঁছাবে বাংলাদেশ-ফ্রান্স সম্পর্ক : প্রধানমন্ত্রী
কৌশলগত অংশীদারিত্বে পৌঁছাবে বাংলাদেশ-ফ্রান্স সম্পর্ক : প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিবেদক।।

অভিন্ন সমৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক একটি কৌশলগত অংশীদারিত্বে পৌঁছাবে বলে আশা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় এমনটা আশাবাদ জানিয়েছেন।

শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ইন্দো-প্যাসিফিক ও এর বাইরেও সবার অভিন্ন সমৃদ্ধির জন্য কৌশলগত সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যেতে পারে বলে আমি আত্মবিশ্বাসী। তারা কৌশলগত সম্পদ ও উন্নত প্রযুক্তিতে সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র খুলে দিচ্ছে।

বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের একাধিক সংকট মোকাবিলায় আমাদের অংশীদারত্ব একটি অর্থবহ শক্তি হতে পারে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে ফ্রান্স বাংলাদেশের বিশ্বস্ত উন্নয়ন-সহযোগী। আমরা দায়িত্বশীল ব্যবসা পরিচালনার দিকে আলোকপাত করে একটি শক্তিশালী বাণিজ্য অংশীদারত্ব গড়ে তুলেছি।

ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে যোগদান শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে দ্বিপক্ষীয় সফরে রবিবার (১০ সেপ্টেম্বর) রাতে ঢাকায় এসেছেন ম্যাক্রোঁ।

ভোজসভায় ফরাসি প্রেসিডেন্টকে আতিথ্য দিতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত ও সম্মানিত বোধ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমি ২০২১ সালের নভেম্বরে এলিসি প্যালেসে আপনার উষ্ণ আতিথেয়তার কথা স্মরণ করছি। আমি আনন্দিত যে আপনি আমার ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের জনগণ আপনাকে (ফরাসি প্রেসিডেন্ট) এবং আপনার প্রতিনিধিদলকে এখানে স্বাগত জানাতে তার সঙ্গে ভোজসভায় যোগ দিয়েছে।

ফ্রান্স আমাদের হৃদয় ও কল্পনায় একটি বিশেষ স্থানে রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা ফরাসি প্রেসিডেন্টের জন্য বাংলাদেশের অদ্বিতীয় জনপ্রিয় খাবার কাচ্চি বিরিয়ানির স্বাদ নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।

তিনি বলেন, আমাদের উভয় জাতিই আমাদের রন্ধনপ্রণালি, সংস্কৃৃতি ও ভাষাগত ঐতিহ্যের জন্য অত্যন্ত গর্বিত। আমাদের দুই জনগোষ্ঠীকে একে অপরের কাছাকাছি আনতে আমাদের দুটি সংস্কৃতির মধ্যে আরও পদ্ধতিগত পন্থা ও সংমিশ্রণকে উন্নীত করার সময় এসেছে। তিনি আরও বলেন, আমি কি আমাদের আরেকটি সুস্বাদু খাবার স্থানীয় জনপ্রিয় ফল আমড়ার জুস দিয়ে টোস্ট করার কথা বলতে পারি!

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফরাসি বিপ্লবের চেতনায় গভীর ভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন বলে জানান শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু তার আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের মূল্যবোধের প্রসারে তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম (১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে) এর প্রতিফলন ঘটেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতার আহ্বান আন্দ্রে মারলোর মতো বিশ্ব বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল, যারা আমাদের উদ্দেশ্য সাধনে লড়াই করার জন্য অনেক তরুণকে সংগঠিত করেছিলেন বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, এটা প্রায়ই আমার মনে হয় যে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ তার ফরওয়ার্ড মার্চ আন্দোলনের মাধ্যমে মারলো ও তার অনুসারীদের গর্বিত উত্তরাধিকার বহন করছেন।

ম্যাক্রোঁর উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, মি. প্রেসিডেন্ট, ফ্রান্সে আপনি যে সাহসী সংস্কার করেছেন, তার জন্য আমরা আপনাকে সাধুবাদ জানাই। আমরা আপনাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশুদ্ধ বাতাসের নিঃশ্বাস হিসেবে দেখি। কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের জন্য আপনার (ফরাসি প্রেসিডেন্ট) গুরুত্ব আরোপ মূলত আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এর আগে ভোজ সভাস্থলে পৌঁছালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফুলের তোড়া দিয়ে ম্যাক্রোঁকে স্বাগত জানান। এ সময় জাতির পিতার ছোট কন্য ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা উপস্থিত ছিলেন।

পিঁয়াজুসহ ধুমায়িত ইলিশ এবং সমুচা, স্যুপ, রুটি এবং মাখন দিয়ে ম্যাক্রোঁকে নৈশভোজে আপ্যায়িত করা হয়। ম্যাক্রোঁর খাদ্য তালিকায় প্রধান উপাদান ছিল খাসির মাংসের কাচ্চি বিরিয়ানি, গরুর কাবাব, চিকেন কোর্মা, ঐতিহ্যবাহী লুচি ও রোস্টেড লবস্টার।

ডেজার্ট আইটেমের মধ্যে ছিল পাটি সাপটা পিঠা, মিষ্টি দই, রসগোল্লা, তাজা ফল, পানীয় ও আনারের জুস, তাজা জুস, জল ও কোমল পানীয়, চা ও কফি।

এসময় ম্যাক্রোঁ বলেন, বন্ধুত্বের চেতনায় আজ রাতে  আমরা জড়ো হয়েছি। আমি যদি আমাদের ইতিহাসের পিছনে ফিরে তাকাই আমরা দুঃসময়ে একে অপরের পাশে ছিলাম। ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন ফ্রান্সে সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চাইছিল। তখন এর পক্ষে-বিপক্ষে ফরাসিরা ছিল।

তিনি বলেন, এখন আমাদের দুই দেশের মানুষের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। ৫২ বছর আগে অনুভব করেছি আমরা একই পরিবারের।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গে ম্যাক্রো বলেন, আমি আগামীকাল আপনার ( শেখ হাসিনা) পিতার ব্যক্তিগত বাসভবনে যাব। যেখান থেকে তিনি বাংলাদেশের দেশের স্বাধীনতার জন্য বিভিন্ন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আমি মনে করি শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর সর্বোত্তম উপায় হল গণতান্ত্রিক নীতির ভিত্তিতে বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের অসাধারণ সাফল্যকে স্বীকার করা। 

ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘সারাবিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করে নিজেদের অবস্থান তেরি করে নিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, সংস্কৃতিতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন বড় চ্যালেঞ্জ, সেটি মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন লেক, নদী-নালার সৌন্দর্য বিশেষ করে সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক পরিবেশ এতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।’

জলবায়ু ইস্যুতে তিনি শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এই ইস্যুতে আপনার নেতৃত্বের প্রশংসা করতে চাই। আপনি ফ্রান্সের উপর নির্ভর করতে পারেন এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য যে দেশটি দায়ী তা বোঝাতে আমাদের পূর্ণ সমর্থনের উপর নির্ভর করতে পারেন। 

তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের নজর ছিল বন্ধুরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে। সেটি অক্ষুণ্ণ রেখে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দেশটির ভূমিকা প্রশংসনীয়। আমরা দুই দেশের সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চাই।’ 

এই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে মন্তব্য করেন ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ । 

রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) রাত ৮টার কিছু পরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান ম্যাক্রোঁ। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান শেখ হাসিনা। এরপর লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয় ফরাসি প্রেসিডেন্টকে। এসময় দুই দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। পরে তাকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়।

খালেদ /পোস্টকার্ড;