'কর্নেল থান রোহিঙ্গাদের সমূলে হত্যার নির্দেশ দেন'-রোহিঙ্গা হত্যার স্বীকারোক্তি মিয়ানমারের দুই সেনার

'কর্নেল থান রোহিঙ্গাদের সমূলে হত্যার নির্দেশ দেন'-রোহিঙ্গা হত্যার স্বীকারোক্তি মিয়ানমারের দুই সেনার

পোস্টকার্ড ডেস্ক ।। 

মিয়ানমারের দুই সেনা রাখাইনে ২০১৭ সালের সেনা অভিযানে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা হত্যার স্বীকারোক্তি দেওয়ার পর তাদেরকে নেদারল্যান্ডসের হেগে পাঠানো হয়েছে। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন এবং মানবাধিকার সংগঠন ফরটিফাই রাইটস গতকাল মঙ্গলবার এ খবর জানিয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই দুই সেনা রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উত্তরাঞ্চলে ডজনেরও বেশি গ্রামবাসীকে হত্যার পর গণকবর দেওয়ার কথা স্বীকার করেছে। একটি ভিডিওতে তারা এই স্বীকারোক্তি দিয়েছে এবং ভিডিওটি এ বছর মিয়ানমারে দেখানো হয়। খবরে ওই ভিডিওর উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছে। তবে রয়র্টাস এখনও ভিডিওটি দেখেনি।

ফরটিফাই রাইটসের উদ্ধৃতি দিয়ে উখিয়া প্রতিনিধি জানান, স্বীকারোক্তি দেওয়া দুই সৈনিক হলেন মাইও উইন তুন (৩৩) ও জাও নাইং তুন (৩০)।

সাক্ষ্য দেওয়ার সময় মাইও উইন তুন বলেন, ২০১৭ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কমান্ডিং অফিসারের কাছ থেকে পরিষ্কার নির্দেশ ছিল, আপনি যাকে সামনে দেখবেন তাকেই গুলি করবেন। তিনি শুধু নির্দেশ পালন করেছিলেন। ৩০ জন রোহিঙ্গা গণহত্যায় সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। পরে তাদেরকে সামরিক ঘাঁটির কাছে গণকবর দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, কর্নেল থান থাকি রোহিঙ্গাদের সমূলে হত্যার নির্দেশ দেন। এরপর আমরা নির্বিচারে সবাইকে গুলি করেছিলাম। মুসলিম পুরুষদের কপালে গুলি করে লাশগুলো লাথি দিয়ে গর্তে ফেলে দিয়েছিলাম।

অপর সেনা জাও নাইং তুন বলেন, আরেকটি ব্যাটালিয়নে থেকে তিনি ও তার সহকর্মীরা একই রকম নির্দেশনা অনুসরণ করেছিলেন। তাদের বলা হয়েছিল, শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক যাদের পাবেন তাদের হত্যা করবেন। তার ব্যাটালিয়ন প্রায় ৮০ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করে। এছাড়া মংডু টাউনশিপে ২০টি গ্রাম ধ্বংস করে। সার্জেন্ট পায়ে ফোয়ে অং এবং কিয়েত ইয়ু পিন তিনজন রোহিঙ্গা নারীকে ধর্ষণ করেছে, যার সাক্ষী আমি নিজেই। তারা নিরস্ত্র ১০ জনকে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে হত্যা করা হয়। গ্রামে তাদের গণকবর দেওয়া হয়।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস বলেছে, দুই সেনা যে অপরাধের কথা স্বীকার করেছেন তারা সেটি আসলেই করেছেন কিনা তা নিরপেক্ষ সূত্রে নিশ্চিত হতে পারেনি তারা। মিয়ানমার সরকার বা দেশটির সেনাবাহিনীর কাছে এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে দুই সেনা রোহিঙ্গা গণহত্যার কথা স্বীকার করেছেন তারা রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাদের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির হেফাজতে ছিলেন। সেখানেই তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। পরে তাদের নেদারল্যান্ডসের হেগে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) এই সেনাদেরকে সাক্ষী হিসাবে হাজির করা হতে পারে কিংবা বিচার করা হতে পারে।

মিয়ানমারের ওই দুই সেনা কিভাবে আরাকান আর্মির হাতে পড়ল তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কেন তারা এতদিন পর অপরাধ স্বীকার করছে কিংবা কোনো চাপে পড়ে তাদের রোহিঙ্গা গণহত্যার কথা স্বীকার করতে হয়েছে কিনা তার কিছুই নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এমনকি, কিভাবে তাদেরকে হেগে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তারা কাদের দায়িত্বে আছে, এসব কিছুই জানা যায়নি।

হেগে আইসিসির মুখপাত্র ফাদি এল আব্দাল্লাহ এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন। আইসিসি এখনও ওই দুই ব্যক্তিকে হাতে পায়নি বলে জানান তিনি।

রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের সময় মিয়ানমার যুদ্ধাপরাধ করেছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে গত বছর নভেম্বরে তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে আইসিসি। মিয়ানমার তাদের বিরুদ্ধে আইসিসির যুদ্ধাপরাধ সংগঠনের তদন্তকে বেআইনি বলেছে। কারণ, মিয়ানমার আইসিসি সনদে স্বাক্ষর করেনি। তাই তারা এই ট্রাইব্যুনালের সদস্য নয়। কিন্তু আইসিসি বলছে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশ সংস্থাটির সদস্য হওয়ায় এই তদন্তের এখতিয়ার তাদের রয়েছে।

রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আইসিসিতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন কানাডার আইনজীবী পায়াম আখাভান। তিনি বলেন, ওই দুই ব্যক্তি সরকারি সুরক্ষা দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে একটি সীমান্ত পোস্টে হাজির হয়েছিলেন। সেখানেই তারা ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা ও ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন। তবে সর্বশেষ আমি এটুকুই বলেতে পারি, ওই দুই ব্যক্তি এখন আর বাংলাদেশে নেই।

দুজনের বিষয়ে আরাকান আর্মির মুখপাত্র খিনে থু খা বলেন, তারা পালিয়ে এসেছিলেন এবং তাদের কখনওই যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটকে রাখা হয়নি। ওই দুজন এখন কোথায় আছেন সে বিষয়ে তিনি আর কিছু বলতে রাজি হননি। তবে বলেছেন, আরাকান আর্মি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নের শিকার সবাইকে ‘ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’।

আইসিসির তদন্ত ছাড়াও হেগে গত বছর নভেম্বরে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়া যে মামলা করেছে তাতে এই দুই সেনার সাক্ষ্য প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০১৭ সালে সেনা অভিযানের নামে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে মিয়ানমার সেনাবাহিনী যে বর্বরতা চালিয়েছে তা ১৯৮৪ সালের আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশনের গুরুতর লংগন বলে অভিযোগ করে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মামলা করে পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গাম্বিয়া।