আল্লাহর দেওয়া মহা নিয়ামত দাম্পত্য সম্পর্ক সুরক্ষায় করণীয়

আল্লাহর দেওয়া মহা নিয়ামত দাম্পত্য সম্পর্ক সুরক্ষায় করণীয়

মুফতী মোস্তাফিজুর রহমান কাসেমী ।।

পরিবার বা সমাজ ছাড়া একাকী বেঁচে থাকা খুবই কষ্টের ব্যাপার। তাই মানুষ সাধারণত সংঘবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে পছন্দ করে। পরিবার ও সমাজ মানুষের পার্থিব জীবনের আশ্রয় ও শান্তির নীড়। মানবসভ্যতার ঐতিহ্য ও গৌরব। একই সঙ্গে সমাজবদ্ধতা আল্লাহর দেওয়া মহা নিয়ামত। তিনি বলেন, ‘হে মানব জাতি! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সেই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেজগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সব কিছুর খবর রাখেন।’ (সুরা হুজুরাত : ১৩)

কিন্তু অনাকাক্সিক্ষতভাবে বর্তমানে পরিবার ও সমাজের বন্ধনগুলো শিথিল হয়ে পড়ছে। বাড়ছে পারিবারিক কলহ, অশান্তি। বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ। ভাঙছে ঘর। মানসিক স্বস্তি ও ভারসাম্য হারাচ্ছে মানুষ। হতাশাগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, এদের অদ্ভুত আচরণে সমাজের শান্তিময় পরিবেশও বিনষ্ট হচ্ছে। এ সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসের আলো কিছু কথা নিবেদন করছি।

বিবাহবিচ্ছেদের পরিণতি
বিবাহবিচ্ছেদ কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। ইসলাম বরাবরই তাতে নিরুৎসাহিত করে আসছে। হজরত ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিতÑ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বৈধ জিনিসসমূহের মধ্য হতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জিনিস হলো তালাক ও বিবাহ বিচ্ছেদ।’ (মেশকাত : ২/২৮৩)। তবুও তা বিভিন্ন কারণে বা প্রয়োজনে ঘটছে, এটাই বাস্তবতা। এর দ্বারা কেবল দুটি মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভেঙে যায় তা নয়; অনেকগুলো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সুন্দর  সুন্দর সাজানো স্বপ্ন, তিলতিল করে গড়ে তোলা একটি সংসার, হাসিমুখো ফুলশিশুদের ভবিষ্যৎ ইত্যাদি সব ভেঙে খানখান হয়ে যায়। জীবনটাই হয়ে ওঠে বিষাদময়। ঘর ভাঙা নারীটা কখনওবা বাবার সংসারেও হয়ে ওঠে উপেক্ষিত। অন্য স্বজনদের কাছে তো বটেই। তাই সে পুনরায় ঘর বাধার স্বপ্ন বুনে। অধিকাংশের স্বপ্নই পূরণ হয়ে যায়, কারোটা আবার ভেঙে যায়। কেউ আবার বারবার প্রবঞ্চনায় শিকার হয়ে জীবন থেকে চরম নিরাশ হয়ে পড়ে। তখন সে হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর মূর্তিমান এক আতঙ্ক!
মা-বাবার দায়িত্ব
আজকাল যাদের ঘর-সংসার ভাঙছে, এদের অধিকাংশই ইসলামী বিধিবিধান ও অনুশাসন যথাযথ মানছে না বিধায় এমনটা ঘটছে। আর ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা, শিষ্টাচার, দাম্পত্য ও পারিবারিক বিষয়ে ইসলামী ধ্যান-ধারণা সন্তানদেরকে প্রদান করার দায়িত্ব তো মা-বাবার ওপরই বর্তায়। সব মা-বাবার উচিত সন্তানদেরকে ইসলামী অনুশাসনে গড়ে তোলা। বিয়ের ক্ষেত্রে ইসলামী দিকটাকেই প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার দেওয়া। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মা-বাবার অনেক বড় দায়িত্ব ও ভ‚মিকা রয়েছে। এসব রক্ষা করা। তাহলে দাম্পত্য সম্পর্কটা অটুট থাকবে আশা করা যায়।

শ্বশুর -শাশুড়ির দায়িত্ব
বিয়ের পর যদি দেখা যায়, পুত্রবধূ কিংবা মেয়ে জামাতা কাক্সিক্ষত ও দ্বীনদার নয়, তখন মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে রাগ করে এই বিয়ে ভেঙে দিয়ে অন্যত্র বিয়ের ব্যবস্থা করা কোনো সঠিক সমাধান নয়। হতে পারে পরবর্তী বিয়ে আরও খারাপ হলো, তখন আরও কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। তাই শুরু থেকেই পরম মমতায় আপন করে নিতে পারলে, নিজ সন্তান মনে করে উত্তম আদর্শ, শিষ্টাচার, ইসলামী শিক্ষা প্রদান করে গড়ে তুলতে পারলে হবে অন্যতম একটি মহৎ কাজ। যত্ন করে লালন করলে বন্যেরাও পোষ মানে। দরদি ভাষায় ইসলামের সৌন্দর্যকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারলে অচেনা কাফেরও ইসলাম গ্রহণ করে থাকে। প্রত্যেকেই যার যার অবস্থান থেকে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা সাধনা-চালিয়ে যেতে পারলে আমাদের ঘরগুলোতে শান্তি ফিরে আসবে। ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে ইনশাল্লাহ।

ঘরের কাজ করাও সুন্নত
দাম্পত্য জীবনকে সুখময় করতে উভয়ের আন্তরিকতা ও সহযোগিতা প্রয়োজন। সময়মতো পুরুষরাও ঘরের কাজে সহযোগিতা করলে সংসারে স্বর্গীয় সুখের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর মতো শ্রেষ্ঠ ও মহান মানুষ আর কে হতে পারে! তার চেয়ে ব্যস্ত মানুষই বা আর কে আছে! তথাপি তিনি ঘরে স্ত্রীদের সব হক আদায় করতেন। পাশাপাশি গৃহস্থালির ছোটখাটো সব কাজেও হাত লাগাতেন। অন্যদের খেদমত ও সেবা নেওয়ার প্রত্যাশায় বসে থাকতেন না। তিনি নিজের জুতা নিজ হাতে সেলাই করেছেন, পশুর দুধ নিজেই দোহন করতেন, রান্নার কাজে সহযোগিতা করতেন। (বুখারি ও শামায়েলে তিরমিজি)

মা ফাতেমার ঘরের কাজ
নবী নন্দিনী হজরত ফাতেমা (রা.)। জান্নাতের সব রমণীদের নেত্রী। তার মতো শ্রেষ্ঠ রমণী আর কে হতে পারে! অথচ স্বামীর সংসারের সব কাজ এক হাতে করতেন। কোনো সেবিকাও (কাজের বুয়া) ছিল না। নিজ হাতে আটা পেষার যাঁতাকলে গম পিষে আটা করতেন। সেই আটা দিয়ে রুটি পাকাতেন। গভীর ক‚প থেকে বালতি ভরে রশি টেনে পানি তুলতেন। সেই পানি ভর্তি মশক বহন করে বাড়িতে আনতেন। এত কষ্টের কাজ করে করে হাতে তার ফোস্কাও পরে গিয়েছিল। (বুখারি : ২/৮০৮)। এ যুগে কি এর কিঞ্চিত কষ্টও করতে হয়!

স্বামী-স্ত্রীর অভিমানে করণীয়
হজরত ওমর (রা.) তার কন্যা ও প্রিয় নবীজি (সা.)-এর স্ত্রী হজরত হাফসাকে (রা.) নসিহত করতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘হাফসা! তোমাদের (নবীর স্ত্রীদের) মধ্য হতে কেউ কি তোমাদের স্বামীর (নবীজি সা.) মনে কষ্ট দিয়েছিলে? যার ফলে তিনি ঘরের বাইরে (মসজিদে নববীতে) রাত্রি যাপন করলেন? হাফসা (রা.) বললেন, হ্যাঁ বাবা, ঘটনা সত্য। ওমর (রা.) বললেন, হায় হায়! তাহলে তো তোমরা খুবই মন্দ কাজ করলে! স্বামীকে কষ্ট দিয়ে আল্লাহর ক্রোধ থেকে নিরাপদে থাকার ভরসা কি করে করতে পারলে? শুনে রাখ, স্বামীর কাছে একান্ত প্রয়োজনের বেশি কিছু চাইবে না। তাঁকে অযথা বিরক্ত করবে না। স্বামীর সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করবে না। অতিরিক্ত কিছু প্রয়োজন হলে আমার নিকট চাইবে। তার কাছ থেকে তোমার অপছন্দনীয় কিছু পেলে তা দ্রæত ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবে।’ (বুখারি : ২/৮০৮)। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে রাগ-অনুরাগ বা এ জাতীয় কিছু হতেই পারে। যদি কখনও অপ্রত্যাশিতভাবে এমন কিছু হয়েই যায়, তখন অভিভাবকদের দায়িত্ব হলো পক্ষপাতিত্ব না করে যথাসম্ভব তা মিটমাট করে দেওয়া। তাতেই মঙ্গল। মহান আল্লাহর কাছে কায়মনো বাক্যে মিনতি, আমাদের পরিবার ও সমাজে যেন বিবাহবিচ্ছেদের ভাঙাগড়া খেলার অবসান হয় এবং সম্পর্কের সুরক্ষা দান করেন। আমিন।
লেখক : খতিব, বাবলী জামে মসজিদ, তেজগাঁও, ঢাকা