আপনার সন্তানকে করোনা ভাইরাস বিষয়ে সত্য জানতে দিন

আপনার সন্তানকে করোনা ভাইরাস বিষয়ে সত্য জানতে দিন

স্থপতি তাসনিভা রহমান মুমু।।

আমাদের দেশে প্রথম মার্চ মাসে ভাইরাসটি শনাক্ত নিশ্চিত হয়েছিল এবং ১০ এপ্রিল, শনাক্তের সংখ্যার ৩৩০ যেখানে মৃত্যুর সংখ্যা ২১। পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে যা আমাদের মনস্তাত্বিক এবং শারীরিক সুস্থতার জন্য খুব ভীতিকর। শিশুরা কীভাবে এ পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে চলছে এবং তাদের মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য অভিভাবকদের কেমন সমর্থন প্রয়োজন সে বিষয়ে আলোচনা বর্তমানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া, কোনো আউটডোর-এক্সপোজার বা বাইরে যাওয়ার সুযোগ না থাকা এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য বাড়িতে আটকে থাকার কারণে বাচ্চাদের জীবনধারার আমূল পরিবর্তন এসেছে। পরীক্ষার পরের আনন্দের ছুটি আর বর্তমান অনির্দিষ্ট ও অনিশ্চয়তার ছুটি শিশুদের জন্য ভিন্ন। লকডাউনের নামও প্রথম শুনছে তারা। রিমোটলি বা শারীরিক দূরত্বে বাসায় বসে কাজ করার সঙ্গে যেমন অনেকেই এবারই পরিচিত হচ্ছেন, শিশুদেরও প্রথম এতটা সময় বাসায় থাকার অভিজ্ঞতা হচ্ছে। এ সময়ে বাবা-মায়ের দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে।

প্রথম পদক্ষেপ : শিশুদের জানতে দিন
আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছি; ধ্বংসাত্মক অভিজ্ঞতা মোকাবেলা, সাহস নিয়ে নতুনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা শুনেছি। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীটির স্কেল আজকে বেঁচে থাকা মানুষ দেখেনি। প্রযুক্তিগত সুবিধাসহ বেড়ে ওঠা এই প্রজন্মের শিশুরা যারা নিজস্ব ডোমেইন থেকে বিশে^র সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে তারা এ প্রাদুর্ভাবের সময় এক বিরাট রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।  মিডিয়ায় বর্ণিত খবরে শিশুদের কৌত‚হল বাড়ছে এবং মনে অহেতুক ও বিপর্যয়কর কল্পনা তৈরি হতে পারে যদি মা-বাবা এ বিষয়ে কথোপকথন না চালান। অন্যদিকে প্রয়োজনের থেকে বেশি তথ্য সরবরাহ করলে অতিরিক্ত উদ্বেগ হতে পারে। তাদের বয়স অনুযায়ী কথা বলুন, প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগের মাত্রা অনুধাবনের চেষ্টা করুন এবং তাদের প্রতি সংবেদনশীল হন। নতুন করোনাভাইরাস সম্পর্কে আপনার সন্তানকে জানতে দিন যা এক ধরনের অদৃশ্য জীবাণু যেটা মানুষকে অসুস্থ করতে পারে, এটি খুব সহজে সংক্রমিত হয়।

দ্বিতীয় পদক্ষেপ : সংক্রমণ প্রতিরোধ সম্পর্কে জানান
করোনাভাইরাস সংক্রামণ রোধে বর্তমানে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় কেন বাসায় থাকা এটা বুঝলে শিশুরা বাইরে যাওয়ার জন্য কম জেদ করবে। অন্যর সংস্পর্শে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে এটি আপনার শিশুকে বুঝিয়ে বলুন ও প্রতিরোধের উপায় জানান।

উৎস : ইউনিসেফ

আপনার শিশুকে ঘন ঘন সাবান ও পানি দিয়ে দিয়ে হাত ধুতে বলুন এবং তা অভ্যাসে পরিণত করুন। কাশি বা হাঁচি দেওয়ার সময় মুখ এবং নাক কনুই বা টিস্যু দিয়ে ঢাকতে বলুন। ঠান্ডা লেগেছে বা জ্বরের লক্ষণযুক্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে শিখান। জ্বর, কাশি বা শ^াসকষ্ট হলে দ্রুত চিকিৎসাসেবা নিন।

তৃতীয় পদক্ষেপ : সামাজিক দূরত্ব অনুশীলন করুন তবে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নয়
শিশুদের তাদের সহপাঠী, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন থেকে শারীরিক দূরত্বে রাখা সবচেয়ে কঠিন। যদি নিজের বাড়ির উঠোন, বাগান বা ছাদে যাওয়ার সুযোগ থাকে তাহলে নিজের পরিবারের নয় এমন যেকোনো ব্যক্তি থেকে ৬ ফুট দূরত্বে থেকে খেলা অপরিহার্য। শিশুদের সামাজিক দূরত্বের সময় সামাজিক সংযোগ বজায় রাখতে তাদের বন্ধুদের সঙ্গে ফোন বা ভিডিও কল নিজ তদারকির মাধ্যমে করতে দিন যেন তারা নিজেদের বিচ্ছিন্ন না ভাবে।

চতুর্থ পদক্ষেপ : অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলাপ এবং পারিবারিক বন্ধন বাড়ান
আনন্দ এবং সৃজনশীলতা পুরো পরিবারের মধ্যে মানসিক চাপ হ্রাস এবং বন্ধনকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে। খেলাই আত্মবিশ^াস বজায় রাখে এবং বিপদের সময়ে প্রফুল্ল স্মৃতি তৈরি করতে পারে। প্রতিদিন কিছুক্ষণের জন্য মিডিয়া এবং ফোন থেকে দূরে থেকে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলার মুহূর্ত প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও প্রয়োজনীয় ‘রিবুট’ বা নতুন শুরু হতে পারে। বাইরে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞার কারণে, শিশুদের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন খেলা, সৃজনশীলতা অনুশীলন শারীরিক ও মানসিকভাবে দৃঢ় থাকার জন্য উপকারী।

পঞ্চম পদক্ষেপ : বিভ্রান্তি দূরীকরণ
সঠিক তথ্য যেমন জীবন বাঁচাতে পারে, তেমনি ভুল তথ্য আমাদের নিয়ে যেতে পারে বড় কোনো ঝুঁকির দিকে। করোনাভাইরাস নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার হচ্ছে কিছু ভুল তথ্য। এ নতুন ভাইরাস সম্পর্কে ক্রমাগত কথা বলা, পৌরাণিক কাহিনির মতো বিভিন্ন ভীতিকর গল্প শিশুদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে। যেকোনো বিভ্রান্তি দূর করতে ইউনিসেফ বা বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুসরণ করুন। কয়েকটি প্রচলিত ভুল তথ্য।

সর্বশেষ পদক্ষেপ : মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ
পরিস্থিতি পরিবর্তনের হাত থেকে যখন নিজের শিশুকে রক্ষা করতে পারবেন না তখন অসহায়বোধ করা স্বাভাবিক; মনে রাখবেন শিশুরা অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া দেখে শিখে। বাড়ি থেকে কাজ করা, শিশুদের পরিচালনার পাশাপাশি গৃহস্থালির কাজ, অভিভাবকদের জন্য যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। এ মহামারীতে বিশ^ব্যাপী শিশু-নির্যাতন বেড়েছে যা অনেকাংশেই অভিভাবকদের মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার ফল। নিজের মন শান্ত করার জন্য সৃজনশীল ক্রিয়াকলাপে জড়ান। দীর্ঘ সময়ের জন্য বাড়িতে থাকা প্রত্যেকের জন্য হতাশাব্যঞ্জক এবং বিরক্তিকর, সচেতনহীনতা বিষাক্ত পারিবারিক পরিবেশ ডেকে আনতে পারে। তাই সন্তানদের মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে আমাদের নিজেদের মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিশুদের উদ্বেগকে সম্মান করুন। যদি তারা কোনো কিছু থেকে ভয় পায় তবে তাদের ভয়টি তুচ্ছ করবেন না, বরং পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলুন। এ মহামারীতেও আমাদের জীবন থেমে নেই। আমাদের নিজেদের ও পরিবারকে এগিয়ে নিতে ইতিবাচক হতে হবে। শিশুদের মনে করিয়ে দিতে হবে এ পরিস্থিতি এবং আমাদের বর্তমান অনুভ‚তি চিরকাল স্থায়ী হবে না, আমরা শিগগিরই কাটিয়ে উঠব এবং এ বিশ^াস তাকে এবং আপনার পরিবারকে আরও দৃঢ় এবং স্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

লেখক : কমনওয়েলথ স্কলার, ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকচার এপিএইচডি অধ্যয়নরত
ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরা, যুক্তরাজ্য