আজ ছাত্রলীগের ৩০তম সম্মেলন, ৩ বছরেও কমিটি দিতে পারেনি জয়-লেখক

আজ ছাত্রলীগের ৩০তম সম্মেলন, ৩ বছরেও কমিটি দিতে পারেনি জয়-লেখক
ছাত্রলীগের ৩০তম জাতীয় সম্মেলনে যোগ দিতে সকাল থেকেই ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসতে শুরু করেছেন।

সমীরণ রায়।।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৩০তম জাতীয় সম্মেলন আজ সকাল ১০টায় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে গত ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি সংগঠনটির সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব পেলেও তিন বছরেও ১১০টি সাংগঠনিক ইউনিটের মধ্যে কমিটি দিতে পারেনি ৫০টিতে। এ ছাড়া অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শাখার কমিটি দিতে পারেননি। তবে মেয়াদের শেষ মুহূর্তে তারা অনেককে সহ-সম্পাদক পদ প্রদান করেন।  

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের সারা দেশে ১১০টি সাংগঠনিক ইউনিটের মধ্যে ৬০টির দিলেও এখনও বাকি রয়েছে ৫০টি। আর ৬০টি সাংগঠনিক ইউনিটে কমিটি দিলেও সেখানে রয়েছে পদ কেনা-বেচার বিস্তর অভিযোগ। রাজধানী ঢাকার মধ্যে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজ, তিতুমীর কলেজ এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি দিতে পারেননি বর্তমান সভাপতি ও সম্পাদক। একই সঙ্গে কমিটি দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ও টাকা নিয়ে বিভিন্ন থানা কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক পদসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে বিবাহিত ও একাধিক সন্তানের জনককেও পদ-পদবি দিয়েছেন তারা।

এদিকে, আজ মঙ্গলবার ছাত্রলীগের ৩০তম জাতীয় সম্মেলন। সম্মেলনের ২-৩ দিন আগে পেছনের তারিখ দিয়ে সহ-সম্পাদক পদ দেওয়ার হিড়িক পড়েছে। ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাত্রলীগের প্যাডে সভাপতি ও সম্পাদকের স্বাক্ষর করা সহ-সম্পাদক পদ দেওয়া হয়েছে, এমন পোস্ট দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে কেউ কেউ অভিনন্দন জানালেও সমালোচনাও করেছেন অনেকে। এ ছাড়া সম্মেলনকে সামনে রেখে চলছে ছাত্রলীগের ব্যাপক চাঁদাবাজি। সংগঠনটির বর্তমান শীর্ষ নেতাদের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার শেষ মুহূর্তে নেতাকর্মীরা এখন আর তাদের কথা শুনছেন না। কেউ কাউকে মানছেন না। সবাই এখন  ব্যস্ত নেতা হওয়ার দৌড়ে। ফলে সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা চরম আকার ধারণ করেছে।

অপরদিকে, গত রোববার রাতে রাজধানীর ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার দাবিতে কলেজের পাশর্^বর্তী সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করেন কয়েকশ নেতাকর্মী। ঢাকা কলেজের ফটকের সামনেও বাঁশ ফেলে রাস্তা আটকে দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় গাড়িতে সায়েন্স ল্যাব মোড় হয়ে ধানমন্ডির দিকে যাচ্ছিলেন ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এবং বি এম মোজাম্মেল হক। ঢাকা কলেজ শাখার নেতাকর্মীরা তাদের গাড়ি থামান। পরে জাহাঙ্গীর কবির নানক আশ্বস্ত করেন নেত্রী শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কথা বলে একটা সিদ্ধান্ত দেবেন। এর পর তারা রাস্তা ছাড়েন। এর আগে রাত সাড়ে ১০টার দিকে নিউ মার্কেট এলাকায় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খানের গাড়ি আটকায় ঢাকা কলেজ শাখার বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। তারা তাকে অবিলম্বে ঢাকা কলেজ কমিটি ঘোষণা করতে বলেন। কিন্তু আল নাহিয়ান তাদের কোনো আশ্বাস দেননি।

উল্লেখ্য, গত ২০১২ ও ২০১৭ সালে ছাত্রলীগের কমিটি হয়েছিল ঢাকা কলেজে। পরে অপ্রীতিকর ঘটনায় কমিটি ভাঙতে হয়েছে। এর মধ্যে ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের ৫৫ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটিতে ফুয়াদ হোসেন ওরফে পল্লবকে সভাপতি ও সাকিব হাসান ওরফে সুইমকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। একটি ছিনতাইয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের ২৯ নভেম্বর রাতে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে আসাদুজ্জামান আল ফারুক নামে এক ছাত্র নিহত হন। এর পরদিনই ঢাকা কলেজ শাখার কমিটি স্থগিত এবং সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ সাত নেতাকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এরপর প্রায় তিন বছর ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি ছিল না। 

২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর নূরে আলম ভূঁইয়া ওরফে রাজুকে আহ্বায়ক করে তিন মাসের জন্য আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এর দুই মাসের মাথায় ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আহ্বায়ক নূরে আলম ও যুগ্ম আহ্বায়ক হিরণ ভূঁইয়ার অনুসারীরা সংঘর্ষে জড়ান। সংঘর্ষের সময় কলেজের ছাত্রাবাসের কয়েকটি কক্ষ ভাঙচুর এবং সাতটি মোটরসাইকেলে আগুন দেয় নেতাকর্মীরা। ওই ঘটনায় সেদিনই আহ্বায়ক নূরে আলম ও যুগ্ম আহ্বায়ক হিরণ ভূঁইয়াসহ ঢাকা কলেজ কমিটির ১৯ নেতাকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এ কমিটি বিলুপ্ত বা স্থগিত না করা হলেও ক্যাম্পাসে ‘বিলুপ্ত কমিটি’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ২০১৭ সালের ওই ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের আর কোনো কমিটি হয়নি।

সূূত্র জানায়, ছাত্রলীগের ৩০তম সম্মেলনকে সামনে রেখে ব্যাপক চাঁদাবাজি করেছে সংগঠনটি। সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, আওয়ামী লীগ নেতা, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে চাঁদাবাজি করছেন তারা। এই চাঁদাবাজির প্রধান হোতা  সংগঠনের দুই কান্ডারি আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্য। সম্মেলনকে সামনে রেখে শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকই নন, ১৬টি উপ-কমিটির নেতারাও চাঁদাবাজি করছেন। অথচ, ছাত্রলীগের সম্মেলনের জন্য মঞ্চ তৈরি, আপ্যায়ন, সাজসজ্জা, প্রকাশনা, গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র সংশোধন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্বাস্থ্য ক্যাম্পের জন্য টাকা দিয়েছেন সংগঠনের সাংগঠনিক নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার শেষ মুহূর্তে তাদের কথা আর কেউ শুনছেন না। তারা কিছু বললে পাল্টা প্রশ্ন করছেন নেতাকর্মীরা। এতে করে সংগঠনটির ভেতরে দেখা দিয়েছে চরম বিশৃঙ্খলা।

ছাত্রলীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা সময়ের আলোকে বলেন, ‘আজ ছাত্রলীগের ৩০তম সম্মেলন। গত তিন বছর হলো তারা দায়িত্ব পেয়েছেন। কিন্তু দায়িত্ব পাওয়ার থেকে সংগঠনটির সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য তদবির বাণিজ্য আর ট্রেন্ডারবাজিতে ব্যস্ত ছিল। ছাত্রলীগের ১১০টি সাংগঠনিক ইউনিটের মধ্যে মাত্র ৬০টির কমিটি দিয়েছেন। তারা ছাত্রলীগের পদ কেনা-বেচা করেছেন। কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শাখা কমিটি দেওয়ার নাম নেই। গত রোববার রাতে ঢাকা কলেজের নেতাকর্মীরা ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত তিন নেতার গাড়ি আটকে দিয়েছিল নেতাকর্মীরা। এর আগে ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়কে আটকে রেখেছিল। তারা সবশেষে সম্মেলনকে সামনে রেখে চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত ছিলেন। শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকই নয়, সম্মেলনকে সামনে রেখে ১৬টি উপ-কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারাও চাঁদাবাজি করেছেন। শুধু পদপ্রত্যাশী ছাত্রনেতাদের কাছ থেকেই নয়, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছ থেকেও টাকা ও আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে জয় ও লেখকের বিরুদ্ধে। এ প্রসঙ্গে জানতে ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি অসীম কুমার বৈদ্য সময়ের আলোকে বলেন, ‘এখন সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত রয়েছি। পরে কথা বলব বলে কেটে দেন।’ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি কামাল খান সময়ের আলোকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের সাংগঠনিক ইউনিটগুলোর কমিটি দেওয়ার জন্য আমরা বিভিন্ন সময় কথা বলেছি। এমন কি লিখিতভাবে বলেছি। কিন্তু আমাদের কথায় তারা কান দেননি। পারলে তো আমাদের বহিষ্কার করেন, এমন অবস্থা তৈরি হয়েছিল।’ ছাত্রলীগের উপ-দফতর সম্পাদক মেহেদী হাসান বাপ্পি বলেন, ‘এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বলতে পারবেন কেন তারা কমিটি দিতে পারেননি। আমাদের যে নির্দেশনা দেন, আমরা সেটি করি। এর বাইরে আর কিছু বলার সুযোগ নেই।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সংগঠনটির সহ-সভাপতি মাজহারুল ইসলাম শামীম বলেন, ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ পদ-পদবি কেনা-বেচায় ব্যস্ত ছিলেন। তারা যেখানে টাকা পেয়েছেন সেখানে কমিটি দিয়েছেন। এ ছাড়া সম্মেলনকে সামনে রেখেও চাঁদাবাজি করেছেন। তবে তাদের টাকা নেওয়ার বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ দেওয়া কঠিন। কারণ কেউ অর্থনৈতিক লেনদেন করলে প্রমাণ রাখে না।

এদিকে, গত ২ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ ছাত্রলীগের সম্মেলনে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এটা কি ছাত্রলীগ? কোনো শৃঙ্খলা নেই। অপকর্ম করবে, এমন ছাত্রলীগ দরকার নেই।’ মঞ্চে উপস্থিত সংগঠনটির সভাপতি জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখককে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘এরা কারা খোঁজ নিচ্ছি। এই ছাত্রলীগ চাই না। মুজিব কোট পরলেই মুজিব সৈনিক হওয়া যায় না। মুজিব সৈনিক হতে হলে মুজিবের আদর্শের সৈনিক হতে হবে।’ পরে ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ৪ নেতা আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক মঞ্চ ছেড়ে চলে যান।

উল্লেখ্য, গত ২০১৮ সালের মে মাসে ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন হয়। সে সময় সভাপতির দায়িত্ব পান রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান গোলাম রাব্বানী। আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে আল নাহিয়ান খান জয়কে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও লেখক ভট্টাচার্যকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তাদের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব দেওয়া হয়।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;