আওয়ামী লীগে হাইব্রিড অনুপ্রবেশ ইস্যুতে তোলপাড়

আওয়ামী লীগে হাইব্রিড অনুপ্রবেশ ইস্যুতে তোলপাড়
আওয়ামী লীগে হাইব্রিড অনুপ্রবেশ ইস্যুতে তোলপাড়

হাবীব রহমান ।।

আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে হাইব্রিড আর অনুপ্রবেশ ইস্যুতে তোলপাড় চলছে। যাদের হাত দিয়ে আওয়ামী লীগে ক্ষতিকর অনুপ্রবেশ ঘটেছে, সেসব নেতা আতঙ্কে আছেন। দায় এড়াতে গা বাঁচিয়ে চলছেন অনেকে। কাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এসব অনুপ্রবেশ হয়েছে তার খোঁজ নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
দলের নেতারা বলছেন, অনুপ্রবেশকারীরা সবসময় ঢোকার চেষ্টা করবে। কিছু নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দলে জায়গা করে নেয়। পেছনে বহর বাড়ানোর জন্য বাছ-বিচার না করেই ভিন্নমতের লোকদের দলে ভেড়াচ্ছেন তারা। মন্ত্রী-এমপিদের হাত ধরে তৃণমূলেও অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
রিজেন্টের সাহেদ, পাপিয়া কিংবা জিকে শামীমদের মতো চরিত্রের উন্মোচন হলেই আওয়ামী লীগে হাইব্রিড আর অনুপ্রবেশের বিষয়গুলো বেশি আলোচিত হয়। এবার জোরালো দাবি উঠেছে, সাহেদরা যে দরজা দিয়ে আওয়ামী লীগে প্রবেশ করে, সে দরজা বন্ধ করতে হবে। 
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সময়ের আলোকে বলেন, অনুপ্রবেশকারীদের দল থেকে বের করে দেওয়ার জন্য আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এদেরকে কিন্তু সরকারই আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে। এর বিশেষ কৃতিত্ব আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এসব দুর্নীতিবাজ ও অনুপ্রবেশকারীদের মূলোৎপাটনের কাজ শুরু করেছে। আমরা বাংলাদেশকে রক্ষা করতে এসব দুর্নীতিবাজকে নির্মূল করতে চাই।
অনুপ্রবেশকারীদের দলীয় নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের বিষয়ে নাছিম বলেন, আওয়ামী লীগ একটি সুশৃঙ্খল দল। আমাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা এবং আত্মোপলব্ধির মধ্য দিয়ে অটোমেটিক্যালি বিষয়টি বেরিয়ে আসবে। আওয়ামী লীগের মধ্যে যতটা গণতন্ত্র আছে অন্য কোনো দলে সেটা নেই। দলের কোনো নেতা এসব অনুপ্রবেশকারীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকলে তাও বের হয়ে আসবে। দলের দুয়েকজন নেতা যদি অনুপ্রবেশের প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন সে বিষয়টিও নেত্রী দেখবেন।
আওয়ামী লীগের নেতারা হাইব্রিডের চেয়ে অনুপ্রবেশকে বেশি ভয়ঙ্কর মনে করছেন। কারণ অনুপ্রবেশকারীরা নিজেদের আদর্শের কৌশলী জাল বিস্তারের জন্য দলে প্রবেশ করে। নিজেদের মৌলিক উদ্দেশ্য গোপন রেখে অন্য একটি দলে প্রবেশ করে দলের তথ্য সংগ্রহ করে অথবা দলের রাজনীতি নিজেদের আদর্শিক পন্থায় প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে তারাই অনুপ্রবেশকারী।
আর হাইব্রিড নেতৃত্ব অধিকাংশ সময় সমগোত্রীয় আদর্শের রাজনীতি থেকে উঠে আসে। হাইব্রিড নেতাকর্মীরা দলের অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব তৈরির কাঠামোর সীমাবদ্ধতা পুঁজি করে ওপরের স্তরের নেতাদের আশীর্বাদে তাড়াতাড়ি নেতৃত্বে চলে আসেন। অনেক ক্ষেত্রে দলের প্রয়োজনে হাইব্রিড নেতৃত্ব তৈরি করা হয়। হাইব্রিড নেতা তৈরির প্রক্রিয়াটি সাধারণত নির্বাচনের সময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হাইব্রিড সম্প্রদায় রাজনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে আগ্রহী নয়। যেসব হাইব্রিড নেতা দলে স্থান করে নিয়ে দলটির মূলধারার নেতাকর্মীদের এড়িয়ে চলেন, দলের নাম ভাঙিয়ে অঢেল সম্পদ বাগিয়ে নেন, দলের সঙ্কটে পাশে থাকেন না, তারা দলের জন্য ক্ষতিকর।
নিকট অতীতে ঢাকা উত্তরের প্রয়াত সাবেক মেয়র আনিসুল হক, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দলের নীতি- আদর্শ মেনে কাজ করেছেন। বর্তমান মেয়র আতিকুল ইসলাম, ধানমন্ডির এমপি শফিউল মহিউদ্দিন, সাবের হোসেন চৌধুরী এমপিকেও দল গ্রহণ করেছে। তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে আলোকিত ছিলেন। এমন অনেকেই আছেন।
তবে দলীয় পদে যখন কোনো হাইব্রিড নেতাকে বসানো হয়, তা নিয়ে তখন সমালোচনা ওঠে। এসব সমালোচনায় বেশি মুখর হন যারা ধারাবাহিকভাবে ছাত্রলীগসহ অন্যান্য সংগঠন করে আসেন। নিকট অতীতে সে ছাত্রলীগেও অনুপ্রবেশের অনেক অভিযোগ এসেছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলছেন, আওয়ামী লীগে যাদের মধ্যে জাতির পিতার নীতি-আদর্শ নেই, যারা বঙ্গবন্ধুর নীতি- আদর্শে বিশ^াস করে না তারাই অনুপ্রবেশকারী। যারা দলের সুনাম নষ্ট করে। স্বার্থসিদ্ধির জন্য দলে প্রবেশ করে, দলের নীতি আদর্শে যাদের কোনো আস্থা, বিশ^াস ও সমর্থন নেই। যারা দলের ক্ষতি করার জন্য দলে প্রবেশ করে, দলকে মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে তারাই অনুপ্রবেশকারী।
তিনি বলেন, হাইব্রিডের মধ্যেও অনুপ্রবেশকারী আছে। স্বার্থসিদ্ধির জন্য নানা পথে এসব অনুপ্রবেশকারী দলে ঢুকে পড়ছে। ভবিষ্যতে যেন এরা দলে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এদেরকে আওয়ামী লীগ প্রশ্রয় দেয় না। তারা নিজেরাই নিজেদের মতো করে সুযোগ করে নেয়। এরা প্রতারণা করতে আসে। কীভাবে করতে হয় এরা ভালো জানে। এদেরকে ধরা অনেক কঠিন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আনোয়ার হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, কত মানুষ, কত রূপে দল ও সরকারে ঢুকে পড়ছে। সরকার ও দলে ঢুকে পড়া এসব দুর্বৃত্ত কেউ ছাড় পাবে না। এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি দেশরত্ন শেখ হাসিনা সজাগ আছেন। আওয়ামী লীগই এসব চোরকে ধরছে। প্রধানমন্ত্রী তো বলেছেন, এসব চোরকে ধরতে গিয়ে মনে হয় আমরাই চোর হয়ে গেছি।
করোনা মহামারির নকল সনদ দেওয়া আলোচিত রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদও আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য ছিলেন। দল ও সরকারের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে বিশেষ সখ্য থাকায় কখনও মেজর, কখনও প্রধানমন্ত্রীর এপিএস, কখনও সাংবাদিক নেতা পরিচয় দিয়ে দাপিয়ে বেড়াতেন। আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতারা বলছেন, সাহেদ, খালেদ ও পাপিয়ারাই শুধু নয়, এমন সংখ্যা কত? গোনায় শেষ হবে না। দল টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় বিভিন্ন দল থেকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কাঠামোয় অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কিছু কেন্দ্রীয় নেতা নিজেদের প্রটোকল বাহিনী বড় করতে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের নেতাকে দলে ভেড়ান। কখনই তাদের রাজনৈতিক খতিয়ান দেখেননি। কেউ কেউ বিশেষ সুবিধা নিয়েও পদ-পদবি দিয়েছেন। কিংবা সহযোগী সংগঠনের পদ দিতে বাধ্য করেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের।
বরগুনার বাবুল ঢাকায় এসে হয়ে যান মশিউর রহমান শিহাব। তিনি আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য। এই পরিচয়ে তিনি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বিদ্যুতের সব সেক্টরে। এলাকায়ও এখন ‘বড় নেতা’ শিহাব, অর্থবিত্তেরও কমতি নেই তার। ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কোনো সংগঠনের সঙ্গে কখনই জড়িত ছিলেন না এই শিহাব। ২০১৬ সালের সম্মেলনের পর উপকমিটির সদস্য হন কেন্দ্রীয় শীর্ষ পদের এক নেতাকে ‘বাগে এনে’।
এর আগে গত বছর ঢাকা মহানগর যুবলীগের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ‘টেন্ডার কিং’ খ্যাত জিকে শামীম, মোহামেডানের অন্যতম পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়াসহ আরও কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর এ আলোচনা উঠে এসেছিল। 

সুত্র. সময়ের আলো