কালুরঘাট সেতু এবারও আলোচনায়

কালুরঘাট সেতু এবারও আলোচনায়
কালুরঘাট সেতু এবারও আলোচনায়

মনজুর আলম, বোয়ালখালী ।।

নির্বাচন আসলেই চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী প্রতিশ্রুতি দেন বিজয়ী হতে পারলেই কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণ করা হবে।

সেই ৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে আজ অবধি অনুষ্ঠেয় দেশের সবকটি নির্বাচনী বৈতরণী এভাবেই পার হয়েছেন এখানকার প্রার্থীরা। কিন্তু এখানে সেতু আর হয়না, প্রতিশ্রুতি থেকে যায় প্রতিশ্রুতিতেই।

সাংসদ বাদলের মৃত্যুর পর শূন্য হওয়া এ আসনটিতে উপ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ১৩ জানুয়ারি। বরাবরের মত এবারও প্রচার-প্রচারণায় ঘুরে-ফিরে প্রাধান্য পাচ্ছে কালুরঘাট সেতু। এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন নৌকা প্রতীকে শাসক দলের দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি আলহাজ্ব মোছলেম উদ্দিন আহমদ, বি এন পির ধানের শীষে দক্ষিণ জেলার আহবায়ক আবু সুফিয়ান, টেলিভিশন প্রতীক নিয়ে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) চেয়ারম্যান এসএম আবুল কালাম আজাদ, চেয়ার প্রতীকে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের সৈয়দ মোহাম্মদ ফরিদ আহমদ, কুড়েঘর প্রতীকে ন্যাপের (মোজাফ্‌ফর) বাপন দাশ গুপ্ত এবং আপেল প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী এমদাদুল হক।

প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় এখন খুবই সরগরম ভোটের মাঠ। আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোছলেম উদ্দিন আহমেদ বলছেন, নির্বাচিত হলে তার প্রথম ও প্রধান কাজ হবে কালুরঘাট সেতুর কাজ দৃশ্যমান করা। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দিয়েছেন কালুরঘাটে দুটি সেতু হবে। একটি রেলসেতু, আরেকটি সড়ক সেতু। আমি নির্বাচিত হলে সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করে যে কোনোভাবেই এক বছরের মধ্যে সেতুর কাজ শুরু করব। তাই কালুরঘাটে সেতু চাইলে চোখ বন্ধ করে তাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করতে আহবান জানাচ্ছেন বোয়ালখালীবাসীকে।

অপরদিকে বিএনপির প্রার্থী আবু সুফিয়ান বলেন, ‘আমি এটাকে নির্বাচনের মূল ইস্যু বানাতে চাই না। এতবছর ধরে একটি সেতুর জন্য এখানকার লাখ লাখ মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, এটাকে ইস্যু হিসেবে মানুষের কাছে তুলে ধরতেও লজ্জা লাগে। আমি বলছি, আমি বিজয়ী হতে পারি আর না পারি, অন্তত সেতুটা যেন হয়।’ প্রধান এ দু’প্রার্থীর সাথে তাল মিলিয়ে অপরাপর প্রার্থীরাও এখই কথা বলে যাচ্ছেন।

বোয়ালখালীতে প্রার্থীদের এসব প্রতিশ্রুতি শুনে ভোটাররা বলছেন এটা ভোট আদায়ের পুরনো কৌশল। এভাবেই তো কেটে গেল ৩০ টি বছর। আর কত? এলাকবাসী জানান এক সময় বোয়ালখালী তথা দক্ষিন চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা বান্দরবান-কঙবাজারবাসীর যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিল কর্ণফুলী নদীর উপর ১৯৩০ সালে নির্মিত কালুরঘাট রেল সেতু। যার মেয়াদকাল ফুরিয়ে যায় ৮০ দশকের দিকে।

২০১০ সালে থেকে হযরত শাহ আমানত সেতু (তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু) চালু হওয়ার পর থেকে স্থানীয়দের যাতায়াতে কালুরঘাট সেতুর গুরুত্ব না কমলেও সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে এর গুরুত্ব হারাতে থাকে। ফলে অযত্ন আর অবহেলায় ৯০ বছরের পুরনো এ সেতুর অবস্থা অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় এখন একেবারেই নাজুক। জোড়াতালি দিয়ে কোনমতে ঠিকিয়ে রাখা হয়েছে এটি। এ অবস্থায় দিনকে-দিন গাড়ির চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় যে কোন মুহুর্তে বড় ধরণের দুর্ঘটনার আশংকা রয়েছে এখানে। একমুখী এ সেতুটির কারণে যানজটে আটকে প্রতিদিনই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে হাজার-হাজার মানুষকে। এলাকাবাসী জানান, আশির দশকে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর থেকে পরবর্তী সব সরকারের আমলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠে এটি। ৯০ পূর্ববর্তী সময়ে এরশাদ সরকারের ও তার সহযোগীদেরও প্রতিশ্রুতি ছিল এটি। ৯১ এর নির্বাচনে কালুরঘাট রেল সেতুর পাশে আরো একটি সেতু নির্মানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া,। উপজেলা সদরের গোমদন্ডী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নির্বাচনী জনসভায় ওই প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। কিন্তু তারা তাদের সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেন নি কখনো। ৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় এলে কালুরঘাট রেল সেতুর পাশে রেল কাম সড়ক সেতু নির্মানের প্রতিশ্রুতি ছিল। তাও হয়নি।

২০১০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর নদীর ওপারে পটিয়ার শিকলবাহায় জেলা আওয়ামীলীগ আয়োজিত হযরত শাহ আমানত সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তৎকলীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সরকারের (২০০৮-২০১৩) প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষনে কর্নফুলী নদীর ওপর আরো একটি সেতু নির্মানের আশ্বাস ছিল তাঁর। তাছাড়াও ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে কালুরঘাট সেতু নির্মানের প্রকল্পের সম্মতিপত্রে প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরের পর থেকে অনেক মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতারা নতুন সেতু নির্মানের স্বপ্ন দেখিয়ে আসছিলেন এলাকাবাসীকে। বিগত সরকারের শেষ সময়ে একনেক সভায় উঠেছিল প্রকল্পটি। কিন্তু বিধিবাম। অধিকতর সমীক্ষার কথা বলে প্রকল্পটি একনেক সভা থেকে ফেরত পাঠানো হলে আবারো ঝুলে যায় কালুরঘাটে সেতু নির্মানের প্রকল্পটি।

২০১২ সালের ১৩ ডিসেম্বর কালুরঘাট সেতুর লাগোয়া দ্বিতীয় কর্ণফুলী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সম্ভাব্য স্থান পরিদর্শন করেছিলেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। ওই সময় তিনি শুনিয়েছিলেন সেতু নির্মাণে প্রকল্পের ডিজাইন, নঙা ও ডিপিপি অনুমোদনেরর কথা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সব প্রার্থীর প্রতিশ্রুতি ছিল কালুরঘাট সেতু। সে সময় মহাজোটের প্রার্থী জাসদ নেতা মঈনুদ্দিন খান বাদল নির্বাচনী অঙ্গীকারের শীর্ষে রেখেছিলেন কালুরঘাট সেতুকে। তৃতীয় দফায় নির্বাচিত হয়ে সেতু গড়তে ব্যর্থ হলে সংসদ হতে পদত্যাগের কথাও শুনিয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত জনগনকে এ সেতু দেখিয়ে যেতে পারলেন না বাদল। তার আগেই গত ৭ নভেম্বর ভারতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
আর প্রতিশ্রুতি নয়, বোয়ালখালীবাসী এবার বাস্তবে দেখতে চায় কালুরঘাটে নতুন একটি সেতু। তাদের বিশ্বাস একটি সেতু নির্মাণ করা হলে বোয়ালখালী তথা দক্ষিন চট্টগ্রামে শিল্পায়ন ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের আহবায়ক মো. আবদুল মোমিন বলেন, প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও এ পর্যন্ত কোন সরকার সেতুটি নির্মাণে কার্যকর ভূমিকা রাখেনি। আসন্ন উপ নির্বাচনে সেতুকে রাজনীতির উর্ধ্বে রেখে আমাদের দলমত নির্বিশেষে যোগ্য প্রার্থী বেছে নিতে হবে। জনগণের দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে ইতোমধ্যে সেতু নির্মাণের ঘোষণা এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সেতুমন্ত্রী কালুরঘাটে সড়ক সেতু নির্মাণের যে ঘোষণা দিয়েছেন তার বাস্তবায়নের জন্য সুচিন্তিত ভাবে সবাইকে ভোট দিতে হবে। এখন আমরা চাই অবিলম্বে এই ঘোষনার দ্রুত বাস্তবায়ন হোক, কোন আশ্বাসের ভেড়াজালে যেন আবারো আটকে না যায় এই সেতুটি। এখানকার প্রায় সব প্রার্থী কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করছেন। আমাদের প্রত্যাশা শুধু অঙ্গীকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এবার সেতুটি বাস্তবায়ন হবে।