সৎ সংবাদকর্মীর জন্য ইসলামে পুরস্কার

সৎ সংবাদকর্মীর জন্য ইসলামে পুরস্কার
সৎ সংবাদকর্মীর জন্য ইসলামে পুরস্কার

মুফতি জাওয়াদ তাহের ।।

মিডিয়া ও গণমাধ্যমের চরম উৎকর্ষ ও গণজোয়ার চলছে বর্তমান সময়ে। বলা চলে মিডিয়া এখন সোনালি সময় পার করছে। মিডিয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কারও অজানা নয়। যুগ যুগ ধরে সংবাদ প্রচার ও বার্তা পাঠানোর বিভিন্ন পদ্ধতি চলে আসছে। সংবাদ প্রচার করা বা সাংবাদিকের যেমন মর্যাদা রয়েছে তেমনি রয়েছে তার জন্য সতর্কবাণী। রাসুল (সা.) আমাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন। অসংখ্য হাদিসে এসেছে তিনি সাহাবিদের উপদেশ দিতে গিয়ে এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘আমি কী তোমাদেরকে এমন সংবাদ দেব না যার ওপর আমল করলে তোমরা জান্নাতে যেতে পারবে?’ যেহেতু প্রত্যেক নবী-রাসুল আল্লাহর দেওয়া সংবাদ পৃথিবীর মানুষদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন সেহেতু তারা মূলত ইসলামী সাংবাদিকতা তথা ইসলামের সংবাদ কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কোরআনে সাংবাদিকতার বর্ণনা : আল্লাহ তায়ালা সুরা নামলে হুদহুদ পাখির সংবাদের কথা আলোচনা করেছেন। সংবাদ কেমন হওয়া চাই, সাংবাদিকের গুণাবলি কী কী? এ নিয়ে চমৎকার বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, তারপর হুদহুদ এসে বলল, ‘আমি যা অবগত হয়েছি আপনি তা অবগত নন, আমি সাবা থেকে আপনার জন্য নিশ্চিত খবর নিয়ে এসেছি।’ ‘আমি এক নারীকে দেখতে পেলাম, সে তাদের ওপর রাজত্ব করছে। তাকে দেওয়া হয়েছে সব কিছু। আর তার আছে এক বিশাল সিংহাসন।’ ‘আমি তাকে ও তার কওমকে দেখতে পেলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সেজদা করছে। আর শয়তান তাদের কার্যাবলিকে তাদের জন্য সৌন্দর্যমণ্ডিত করে দিয়েছে এবং তাদের সৎপথ থেকে নিবৃত্ত করেছে, ফলে তারা হেদায়াত পায় না।’ যাতে তারা আল্লাহকে সেজদা না করে, যিনি আসমান ও জমিনের লুকায়িত বস্তুকে বের করেন। আর তোমরা যা গোপন কর এবং তোমরা যা প্রকাশ কর তিনি সবই জানেন। আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোনো ইলাহ নেই। তিনি মহা আরশের রব।’ (সুরা নামাল : ২২-২৬)

উল্লেখিত আয়াতসমূহে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয় ১. খবরটি নির্ভরযোগ্য ও সুনিশ্চিত কি না সে ব্যাপারে অবগত হতে হবে। ২. সংবাদ প্রমাণ নির্ভর হতে হবে। ৩. সমালোচনা সবার জন্য সমান। এমন নয় যে শুধু প্রজাদের জন্য সমালোচনা আলো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কোনো সমালোচনা নেই। ৪. সমস্যা ও তার সমাধানের প্রতি ইঙ্গিত থাকতে হবে। দূর থেকে নয় বরং মাঠে ময়দানে গিয়ে সংবাদ আনতে হবে।

হাদিসে সংবাদের বর্ণনা : রাসুল (সা.) হুদাইবিয়ার সন্ধির পর বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাদের কাছে পত্র প্রেরণ করেছেন ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য। ইতিহাসের পাতায় সেসব বিরল ঘটনাবলী আজও অক্ষুণ্নভাবে সংরক্ষিত রয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহ‌র রাসুল (সা.) কায়সারের নিকট চিঠি লিখেছিলেন এবং এতে বলেছিলেন, যদি তুমি মুখ ফিরিয়ে রাখ তাহলে প্রজাদের পাপের বোঝা তোমার ওপরেই চাপানো হবে। (বুখারি : ২৯৩৬)

ভুল সংবাদ প্রচার থেকে বিরত থাকা : আল্লাহ তায়ালা কোরআনে কারিমে বলেন, ‘হে মুমিনগণ! যদি কোনো পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও।’ (সুরা হুজরাত : ৬)। আজ থেকে ১৪৫০ বছর পূর্বে আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য এই আদেশ দিয়েছেন। বর্তমানে আমরা যদি এই আয়াতের প্রতি লক্ষ করি তাহলে মনে হবে আমাদের আজকের প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে আল্লাহ এই আয়াত নাজিল করেছেন। যা শুনে তাই মিডিয়াতে প্রচার করে বেড়ানো, কত ভয়াবহ অপরাধ তা এ থেকে থেকে প্রতীয়মান হয়; হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো লোকের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে (সত্যতা যাচাই না করে) তা-ই বলে বেড়ায়।’ (মুসলিম : ৫)

সংবাদ প্রচার করা একটি আমানত : আমানতকে কোনো ধরনের কাটছাট না করে হুবহু প্রকাশ করাই একজন পেশাদার সাংবাদিকের নৈতিক দায়িত্ব। আমানতের খেয়ানত ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! খেয়ানত কর না আল্লাহর সঙ্গে ও রাসুলের সঙ্গে এবং খেয়ানত কর না নিজেদের পারস্পরিক আমানতে জেনে-শুনে।’ (সুরা আনফাল : ২৭)

সৎ সাংবাদিকের পুরস্কার : যারা অনেক পরিশ্রম করে দেশের স্বার্থে আমানতের সঙ্গে দূর-দূরান্ত থেকে সংবাদ আহরণ করে তাদের জন্য রয়েছে বিশাল পুরস্কার। হযরত হুযায়ফা (রা.) এর ঘটনা থেকে এমনটিই ফুটে উঠে। ইবরাহিম তাইমি তার বাবা থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন, আমরা হুযাইফাহ্‌ (রা.)-এর কাছে ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি বলে উঠল, ‘হায়, আমি যদি রাসুলকে (সা.) পেতাম, তবে তাঁর সঙ্গে মিলে একত্রে যুদ্ধ করতাম এবং তাতে কোনোরূপ পিছপা হতাম না।’ হুযাইফাহ্‌ (রা.) বললেন, হয়তো তুমি তা করতে, কিন্তু আমি তো আহযাবের রাতে রাসুলকে (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম (সে রাতে) প্রচণ্ড বায়ু ও তীব্র শীত আমাদের কাবু করে ফেলেছিল।

এমনি সময় রাসুল (সা.) ঘোষণা করলেন, ‘ওহে! এমন কেউ আছে কি যে আমাকে শত্রুর খবর এনে দেবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে কেয়ামতের দিন আমার সঙ্গে (মর্যাদার আসনে) রাখবেন?’ আমরা তখন চুপ করে রইলাম এবং আমাদের মধ্যে কেউ তাঁর সে আহ্বানে সাড়া দেয়নি।

এভাবে তিনি তিনবার বললেন এবং সবাই চুপ রইল। তারপর তিনি বললেন, হে হুযাইফাহ‌! ওঠো এবং তুমি শত্রুদের খবরাদি আমাকে এনে দাও। রাসুল (সা.) যখন এবার আমার নাম ধরেই ডাক দিলেন, তাই ওঠা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। এবার তিনি বললেন, ‘শত্রুপক্ষের সংবাদ আমাকে এনে দাও, কিন্তু সাবধান, তাদের আমার বিরুদ্ধে উত্তেজিত কর না। আমি ফিরে আসলাম এবং ফিরে আসার সময়ও উষ্ণতা অনুভব করলাম। প্রতিপক্ষের খবর তাঁকে প্রদান করলাম। আমার দায়িত্ব পালন করে অবসর হতেই আবার আমি শীতের তীব্রতা অনুভব করলাম। তখন রাসুল (সা.) তাঁর অতিরিক্ত একটি কম্বল দিয়ে আমাকে আবৃত করে দিলেন, যা তিনি সাধারণত নামাজ আদায়ের সময় গায়ে দিতেন। তারপর আমি ভোর পর্যন্ত একটানা নিদ্রায় বিভোর রইলাম। যখন ভোর হলো তখন তিনি বললেন, ‘হে গভীর নিদ্রামগ্ন! এখন উঠে পড়।’ (মুসলিম : ১৭৮৮)। হাদিসে রাসুল (সা.) সংবাদকর্মীকে কেয়ামতের দিন তার সঙ্গে থাকার সুসংবাদ দিয়েছেন। তাই যে সাংবাদিক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ নিয়ে আসবে তার জন্যও থাকবে এই অমোঘ সুসংবাদ।

লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, জামিয়া বাবুস সালাম, বিমানবন্দর ঢাকা