সীতাকুণ্ড বিএম ডিপোর অগ্নিকাণ্ডের দায় কেউই এড়াতে পারে না : তদন্ত কমিটি

সীতাকুণ্ড বিএম ডিপোর অগ্নিকাণ্ডের দায় কেউই এড়াতে পারে না : তদন্ত কমিটি
সীতাকুণ্ড বিএম ডিপোর অগ্নিকাণ্ডের দায় কেউই এড়াতে পারে না : তদন্ত কমিটি

পোস্টকার্ড ডেস্ক ।।

সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনা হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থেকেই ঘটেছে। ঘটনার এক মাস পর বুধবার (৬ জুলাই) সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির জমা দেওয়া প্রতিবেদন এ কথা বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষের কমপ্লাইয়েন্সে বা নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সমস্যা ছিল, ডিপো তদারকিতে অব্যবস্থাপনা, মালিকপক্ষের অবহেলা, দক্ষ জনবলের অভাব, আইএনডিজি কোড মানা হয়নি। সে সঙ্গে ডেঞ্জারাস কার্গো পরিচালনায় নিয়মনীতিও মানা হয়নি সেখানে।

প্রতিবেদনে বলা হয় , বিএম ডিপোর এমডি মোস্তাফিজুর রহমান ও পরিচালক দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মজিবুর রহমান বিএম ডিপোর ৫১ শতাংশের মালিক এবং আল রাজি ক্যামিকেলের শতভাগের মালিক। এ আল রাজি ক্যামিকেল থেকে মূলত বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল।

প্রতিবেদন সর্ম্পকে তদন্ত কমিটির প্রধান মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমদেরকে তিনটি বিষয়ে অনুসন্ধান করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি হলো ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান, দায়দায়িত্ব নির্ধারণ এবং এ ধরনের দুর্ঘটনার প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ প্রণোয়ন।

তিনি বলেন, আমরা অগ্নিকাণ্ডের কারণ খুঁজে বের করেছি, দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করেছি কারা এর জন্য দায়ী। আমরা ২০টি সুপারিশ করেছি। সেখানে আমরা বৈধ অবকাঠামোগত প্রয়োজনীয়তা সর্ম্পকে তুলে ধরেছি। কিছু নিয়ম কানুন আছে, কিছু আইন কানুনের অনুপস্থিতির বিষয় ছিল। সেগুলো আমরা চিহ্নিত করেছি। বিশেষ করে ডিজি কার্গো অ্যাক্ট ১৯৫৩ সংশোধনের জন্য আমরা সুপারিশ করেছি। এটি আমাদের এক নম্বর সুপারিশ ছিল। এটি সংশোধন করতে হবে আইএমডিজি কোডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। আইএমডিজি কোডের সর্বশেষ ভলিউমগুলো বের হয়েছে ২০১৮ সালে। আর আমাদের আইনটা হলো ১৯৫৩ সালে।’

বিস্ফোরণের পর মালিক পক্ষ ও সরকার দলীয় নেতারা নাশকতা অভিযোগ আনলেও তদন্ত কমিটি সেই ধরণের কোন লক্ষণ বা কারণ পাননি জানিয়ে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় আমরা ১৭ ধরনের নমুনা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের ঢাকা ল্যাবে পাঠিয়ে পরীক্ষা করিয়েছি। তাতে ওই ডিপোতে অন্য কোনো কেমিক্যালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। হাইড্র্রোজেন পার অক্সাইড থেকেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। হাইড্রোজেন পার অক্সাইড নিজে নিজেই জ্বলতে পারে।’

তদন্ত কমিটিকে ডিপো মালিক পক্ষ কোন সহযোগিতা করেনি জানিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে কমিটি প্রধান বলেন, ‘ডিপোতে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ পাইনি, কোনো সফটওয়ার পাইনি। মালিকপক্ষ জানিয়েছে এগুলোর কোনো ব্যাকাপ ছিল না। কিন্তু আমরা এগুলো রিকভার করার চেষ্টা করেছি। এটা মালিক পক্ষের একটা ব্যর্থতা, কারণ ২০২২ সালে ক্লাউডে বা অন্যত্র কোনো নিরাপদ জায়গায় সিসিটিভি ফুটেজ সেইভ থাকবে না এটি আধুনিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যায় না। বিশেষ করে একজন বিদেশী নাগরিক যেখানে এটি মালিক। এটি মালিক পক্ষের এক ধরনের ব্যর্থতা অবশ্যই।’

‘আমরা সবকিছু পর্যালোচনা করে এই রিপোর্ট তৈরি করেছি। এই রিপোর্টের একটি সীমাবদ্ধতা আমরা পেয়েছি, সেটি হলো যারা ওই প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে প্রায় ১৬ জন ডিপো কর্মী দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। এটি আমাদের জন্য একটা সীমাবদ্ধতা, তারা নিহত হওয়ায় আমরা তাদের বক্তব্য নিতে পারিনি। ডিপো পরিচালনার সঙ্গে জড়িত উচ্চ পর্যায়ের দুয়েকজনের সঙ্গে আমর কথা বলতে পারিনি। এর মধ্যে একজন মহাব্যবস্থাপক বিদেশ ছিলেন, আরেকজন হলেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক। উনার নামে মামলা থাকায় তিনি পলাতক রয়েছেন।’— যোগ করেন তদন্ত কমিটির প্রধান।

এ দুর্ঘটনার জন্য মালিক পক্ষ দায়ী কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কর্তৃপক্ষতো অবশ্যই দায়ী। কারণ আমার ঘরে আগুণ লাগলে আমার দায় অবশ্যই থাকবে। তবে যারা এটি তদারকি করতেন তারাও তাদের দায়িত্ব অবহেলার বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারেন না।’

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘একটি অফডক পরিচালনার জন্য ২৫টির মতো লাইসেন্স নিতে হয়। আমরা সুপারিশ করেছি ২০১৬ সালের অফডক নীতিমালা আছে। অফডকগুলো মনিটরিংয়ের জন্য নৌ মন্ত্রণালয়ে একটি মনিটরিং টিম আছে। আমরা বলেছি, ওই কমিটিতে এই ২৫টি সংস্থার প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করলে এই কমিটি মিটিং করে সুপারিশ করতে পারবে। কার লাইসেন্স হবে আর কার লাইসেন্স হবে না। এখন কোন সংস্থা লাইসেন্স দিয়েছে, কোন সংস্থা লাইসেন্স দেয়নি। এগুলো একটার টা অন্যটা জানে না। কারণ এক সংস্থার সঙ্গে অন্য সংস্থার কোনো যোগাযোগ নেই।’

২৪জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে জানিয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান বলেন, ‘যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি তাদের মধ্যে ৫জন ছিলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, যারা ঘটনার সময় সেখানে অগ্নিকাণ্ড মোকাবেলায় কাজ করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এক পরিচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। এর বাইরে আল রাজী কেমিক্যালের মালিক, ওই প্রতিষ্ঠানের জিএম (মার্কেটিং) সহ সিঅ্যান্ডএফ, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স, শিপিং লাইন এবং বিএম কন্টেইনার ডিপোর সঙ্গে জড়িতদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। ডিপো মনিটরিং এবং ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ৬টি প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা প্রতিবেদন নিয়েছি।’

তদন্ত কমিটি সুপারিশ প্রসঙ্গে বলেছে, ‘বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষের কমপ্লাইয়েন্সে বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা, ডিপো তদারকিতে অব্যবস্থাপনা রোধ, দক্ষ জনবল নিয়োগ, আইএনডিজি কোড অনুসরণ, ডেঞ্জারাস কার্গো পরিচালনায় নিয়মনীতি মেনে চলা, কেমিক্যাল ভর্তি কনটেইনার আলাদাভাবে সংরক্ষণ করা, নির্দিষ্ট জায়গায় আমদানি-রপ্তানিতব্য ডিজি কার্গো কিংবা রাসায়নিক পণ্য হ্যান্ডলিং করা, প্রতিটি ডিপোতে আলাদাভাবে বিপজ্জনক রাসায়নিক পণ্য হ্যান্ডলিং ও এর ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা, ডিপোর কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ ও মহড়ার আয়োজন করা, ডিপো কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, সব বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করাসহ ২০টি সুপারিশ করা হয়েছে।’

বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের পরদিন ৫ জুন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আক্তারকে সদস্যসচিব করে ৯ সদস্যের কমিটি করা হয়। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সভাপতি, সিআইডির প্রতিনিধি এবং নগর পুলিশের (সিএমপি) পোস্ট ব্লাস্ট ইভেস্টিগেশন টিম থেকে প্রতিনিধি যুক্ত করে কমিটির সদস্য ১২ জনে উন্নীত করা হয়। এই কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ল্যাব টেস্টের রিপোর্ট হাতে না পাওয়ায় যথাসময়ে প্রতিবেদন দিতে পারেনি কমিটি।

উল্লেখ্য, গত ৪ জুন রাত সাড়ে ৯টায় উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কাশেম জুট মিল গেট এলাকায় অবস্থিত বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগে। খবর পেয়ে কুমিরা ও সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আগুন নেভাতে যান। আগুন নেভানোর সময় রাসায়নিক ভর্তি একটি কনটেইনার বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত সীতাকুণ্ড ও কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের ১০ জন ফায়ার ফাইটারসহ ৫১ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ২০০ জনেরও অধিক মানুষ। -দৈনিক সময়ের আলো ।

খালেদ /পোস্টকার্ড ;