রুশ চলচ্চিত্র ইলেনা : পারিবারিক সম্পর্কের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত ভালোবাসার গল্প

রুশ চলচ্চিত্র ইলেনা : পারিবারিক সম্পর্কের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত ভালোবাসার গল্প
রুশ চলচ্চিত্র ইলেনা : পারিবারিক সম্পর্কের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত ভালোবাসার গল্প

বিনোদন ডেস্ক ।।

ইলেনা পারিবারিক সম্পর্কের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত ভালোবাসার গল্প। যেখানে ঠাঁই নিয়েছে ভালবাসা, উপেক্ষা, অপারগতা এবং অর্থলিপ্সা।কেন্দ্রীয় চরিত্র ইলেনার ভ্লাদিমিরের সাথে বিয়ের আগে পেশায় ছিলেন একজন সেবিকা। তার প্রথম পরিবারের পুত্র সারজেই বেকার, উদাসীন এবং মদ্যপ। অন্যদিকে ভ্লাদিমিরের সাবেক স্ত্রীর ঘরের কন্যাসন্তান কাতা। যার জীবনযাপনও বলা চলে এলোমেলো ও অনিয়ন্ত্রিত। দম্পতির সম্পর্কের বিশেষ গভীরতা দৃশ্যমান হয় না।

কিন্তু আবার প্রতিরাতে ঘুমন্ত ভ্লাদিমিরের ঘরে এসে টিভি বন্ধ করতে ভুল হয় না ইলেনার। দুজনের পছন্দ এবং রুচির ভিন্নতা স্পষ্ট হয় তাদের লাইফস্টাইলে। নির্মাতা রুচির ভিন্নতাকে দেখিয়েছেন আলাদা আলাদা টেলিভিশনে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের প্রোগ্রাম দেখিয়ে। বাসায় দুজনের মধ্যে আলাপচারিতাও তেমন একটা দেখা যায় না। আর আলাপচারিতা যখন হয় তখন কেবল ইলেনার পক্ষ থেকে তার ছেলে সারজেই এবং নাতী সাশার জন্য অর্থ সহায়তার অনুনয় বিনয়ের মধ্যেই তা সীমিত থাকে। ভ্লাদিমির ইলেনার এই আচরণে অনেকটা বিরক্তবোধ করে। ইলেনার আগের পরিবারের প্রতি যে তার কোন দায়িত্ব নেই সেটি বারবার বোঝাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় সে। পক্ষান্তরে ইলেনা নিয়মিত দেখা করে ছেলের পরিবারের সাথে। সেখানে দৃশ্যমান সম্পর্কটিও রহস্যময় স্বার্থপরতার। মা ছেলের সম্পর্ক যে শুধু অর্থনৈতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে তা উপলব্ধি করা যায় ঐসব দৃশ্যে। এক্ষেত্রে ছেলের বউ তাতইয়ানা চেষ্টা করে ইলেনা সারজেই এবং নাতী সাশার বিরূপ মানসিকতা যেন কোনভাবে টের না পায়। 

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

সারজেই বরাবরই ভ্লাদিমিরের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসার কথা বলে মা'কে। যার কারণ হিসেবে উল্লেখ করে সাশার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কথা, যা বেকার উদাসীন সারজেইর পক্ষে একা বহন করা সম্ভবপর নয়। এই অবহেলার পরেও ইলেনা ছেলের পরিবারকে ভীষণ ভালবাসে। হয়তো নিজস্ব সত্ত্বার অস্তিত্ব খুঁজে পায় সেজন্য! এদিকে ভ্লাদিমির বিত্তশালী। একমাত্র মেয়ে কাতার সাথে সম্পর্কের দূরত্ব রয়েছে তার। আপাতদৃষ্টিতে কাতা একাকী উশৃঙ্খল স্বাধীন জীবনযাপন করে। আচ্ছন্ন থাকে মদ্যপান আর উদ্দাম শারীরিক সম্পর্কের মোহে। যদিও এই ন্যারেটিভের কোন দৃশ্যায়ন দেখানো হয়নি। তা জানা গেছে বাবা মেয়ের কথোপকথনের আবেগ অনুভূতি বিনিময়ের দৃশ্যে। বাবা হার্ট স্ট্রোক করে হাসপাতালে শয্যাশায়ী হলে, বর্তমান স্ত্রী ইলেনা অনুরোধ করে ভ্লাদিমিরের মেয়েকে নিয়ে আসে। মেয়ে কাতা বিরক্তিবোধ করলেও শেষপর্যন্ত রাজি হয় বাবাকে দেখতে যেতে। সেখানে উন্মোচিত হয় মান অভিমান, দুইজনের মত পার্থক্য এবং পারসস্পরিক সম্পর্কের ক্ষোভের নানা কারণ। 

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

কাতার অবাধ স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপনের নেপথ্য কথা। বাবার দায়িত্ব অবহেলা এবং প্রায়শ্চিত্তবোধ। অসহায় ভ্লাদিমির সবসময়ই বুঝতে পারেন তার ফেলে আসা অতীতের ভুলগুলো। অথচ তিনি সেটি প্রকাশ করতে সংকোচবোধ করেন। এতদিন নিজের মেয়েকে দায়িত্ব জ্ঞানহীন ভাবলেও হাসপাতালের বদ্ধ কক্ষে তিনি আবিষ্কার করেন কাতার ম্যাচুরিটি। সময়ের ব্যবধানে মেয়েও জীবনের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টায় বদ্ধপরিকর! স্ক্রিনটাইম বাড়ার সাথে সাথে ইলেনা চরিত্রটি আরো অর্থলোভী হিসেবে প্রকাশিত হতে থাকে। ঐ অবস্থায় অসুস্থ মৃতপ্রায় ভ্লাদিমিরের থেকে ইলেনার কাছে অধিক কদর পায় সারজেইয়ের পরিবারের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন এবং স্বামীর অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করার চিন্তা। হাসপাতাল থেকে ফিরে ভ্লাদিমিরও বুঝতে পারে সে হয়তো বেশিদিন বাঁচবে না। অসুস্থ ভ্লাদিমির চায় সব সম্পত্তি উইল করে রাখতে। স্ত্রী ইলেনার সাথে সম্পত্তির ভাগাভাগির বিষয়ে শেয়ার করতেই আপত্তির মুখে পড়তে হয় তাকে। ইলেনাও ভাবে যে উইল হয়ে গেলে সকল সম্পত্তি ভোগদখল করবে কেবল কাতা! অর্থাৎ সে তার সমঅধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। কাজেই মেডিকেশনের সময়ে সুকৌশলে অন্যান্য ট্যাবলেটের সাথে ভায়াগ্রা মিশিয়ে দিয়ে খুন করে ভ্লাদিমিরকে। 

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

এককালে নার্স থাকার সুবাদে সে খুব ভাল করেই জানে যে হার্ট এটাকে আক্রান্ত রোগীর উপর ভায়াগ্রা কীভাবে কাজ করে। দেয়ালে ঝোলানো ফটোফ্রেমে একাকী ইলেনাকে খুঁজে পাওয়া যায় তখন। সিনেম্যাটিক এপ্রোচের দিক থেকে সত্যিই দারুণ সংযোজন! প্রতিবেশী ও অন্যান্যদের চোখে ভ্লাদিমিরের মৃত্যুকে খুব স্বাভাবিকভাবে দেখা হয়। কেউ ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করে না ইলেনা এমন ভয়ংকর কাজ করতে পারে। রাশিয়ার প্রচলিত আইন অনুসারে মৃত ভ্লাদিমিরের সম্পত্তিতে সমভাগ পায় কাতা ও বৃদ্ধা ইলেনা। কাতা হয়তো সামান্য আঁচ করতে পারে কিন্তু শক্ত প্রমাণ না থাকায় সেও প্রকাশ করে না তার সন্দেহের কথা। অতঃপর ভ্লাদিমিরের রাজকীয় বাড়িতে অনুপ্রবেশ করে সারজেই এবং তার পরিবার। ভোগদখলের এই দৃশ্যে সারজেই জানায় তার স্ত্রী তাতইয়ানা আবারও গর্ভবতী। সুসংবাদে দাদী ইলেনার মুখে ফুটে উঠে আনন্দের হাসি। পরিচালকের বিবৃতিতে অত্যন্ত বাস্তবিক মস্কো জীবনের বয়ান ধরা দেয় চলচ্চিত্র ইলেনার প্রতি পরতে পরতে। সেখানে মেটাফরের ব্যবহার হয়েছে বেশ কয়েকবার। চলচ্চিত্রের শুরুর সিনের সাথে মিল রেখেই শেষ সিনটি ধারণ করা হয়। হুবহু একইরকম দৃশ্য। তবে সময় পরিক্রমায় প্রেক্ষাপট গিয়েছে পাল্টে। সাশার সমবয়সীরা বাড়ির নিচে ফুটবল খেলছে। ফুটবলের একটা শট এক প্লেয়ারের হেডে বারপোস্ট ক্রস করতেই ম্যাচ কাটে দেখা যায় সারজেইর ছোট মেয়ের ঘুম ভেঙ্গে যেতে। এডিটিংয়ে দারুণ সমন্বয় দৃশ্যদ্বয়ে।

 

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

মুভির সরলরৈখিক গল্প বলার মন্থরতা প্রবল আকুতি জানাতে চায় দর্শকমনে। অথচ ভ্লাদিমিরের মৃত্যুরহস্য উন্মোচনের অপেক্ষায় থেকেই দেখতে হয় গল্পের যবনিকাপাত। বাস্তবতার সাথে যেন সামঞ্জস্য রেখেই অপরাধী ঘুরে বেড়ায় প্রকাশ্যে। কাতার পরবর্তী জীবন সম্পর্কে তারপর আর কোনরূপ ধারণা দেয়া হয় না! এমনকি সাশার ভবিষ্যৎ বিশ্ববিদ্যালয় নাকি আর্মিতে সেই উত্তরেও থাকে ধোঁয়াশা। এমতাবস্থায় নানা প্রশ্ন তুলে দিয়ে ভ্লাদিমিরের এপার্টমেন্টকে ফোকাস করে চলচ্চিত্রের সমাপ্তির ঘোষণা আসে।

চলচ্চিত্র — Елена (Elena)
পরিচালক — আন্দ্রেই জুভিয়াগিনসেভ
জনরা — ড্রামা
সাল — ২০১১
Writer: ফরিদুল আহসান সৌরভ  

খালেদ / পোস্টকার্ড ;