বন্যার পাশাপাশি নদীভাঙনে বিপর্যস্ত মানুষ 

বন্যার পাশাপাশি নদীভাঙনে বিপর্যস্ত মানুষ 
বন্যার পাশাপাশি নদীভাঙনে বিপর্যস্ত মানুষ 

পোস্টকার্ড ডেস্ক ।।

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায় । বন্যার পাশাপাশি নদীভাঙনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে মানুষ। খাবার, বিশুদ্ধ পানির অভাবে কষ্ট পাচ্ছে তারা। রয়েছে গবাদি পশুর খাবারের সংকটও। রংপুরের গঙ্গাচড়ায় শংকরদহ বাঁধের ৬০০ মিটার অংশ তিস্তায় ধসে গেছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে বাঙ্গলী নদীর ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কুমুদিনী হাসপাতাল ও শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। জামালপুরের সরিষাবাড়িতে বানের পানিতে ভেসে গেছে একটি ব্রিজের একাংশ। দেশের বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে কিছু কিছু ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল।

গঙ্গাচড়া (রংপুর) সংবাদদাতা জানান, গঙ্গাচড়ায় শংকরদহ বাঁধে তিস্তার ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত দুই দিনে উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের শংকরদহ মধ্যপাড়া এলাকায় বাঁধের ৬০০ মিটার অংশ তিস্তায় ধসে গেছে। এরইমধ্যে শতাধিক পরিবার ভাঙন আতঙ্কে বাড়িঘর সরিয়ে নিয়েছে। সরিয়ে নেওয়া হয়েছে শংকরদহ (পুরাতন) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ভাঙনের হুমকির মুখে রয়েছে একটি মাদ্রাসা ও একটি মসজিদ। লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদীসহ স্থানীয় লোকজন বলছেন, শংকরদহ বাঁধটি পুরোপুরি ভেঙে গেলে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ বন্যাকবলিত হবে। সেই সঙ্গে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে হুমকির মুখে পড়বে শেখ হাসিনা তিস্তা সেতুর মহিপুর-কাকিনা সংযোগ সড়ক। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী তবিবুর রহমান জানান, আমরা জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করছি।

সারিয়াকান্দি (বগুড়া) সংবাদদাতা জানান, সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বাঙ্গালী নদীর ভয়াবহ ভাঙনে ঘরবাড়ি, শত শত বিঘা আবাদি জমি হারিয়ে মানুষ হচ্ছে নিঃস্ব। নদীপাড়ের প্রবীণ লোকদের অনেকেই জানান, বাঙ্গালীর এমন ভয়াবহ ভাঙনইতিপূর্বে দেখেননি তারা। গত কয়েক মাসের ভাঙনে মাছিরপাড়া, দেবডাঙ্গা, বাঁশআটা, পাইকপাড়া, ডোমকান্দি, ছাইহাটাসহ ১৫টি গ্রামের তিন শতাধিক বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, এখন আমরা সীমিতপরিসরে বিভিন্ন স্থানে জরুরি ভিত্তিতেবালু ভর্তিজিও ব্যাগ ডাম্পিং করছি।শুষ্ক মৌসুমে স্থায়ী কাজ করা হবে।

গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে গাইবান্ধার সবগুলো নদীর পানি পুনরায় বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান জানান, বুধবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি ৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপত্সীমার ৭১ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদীর পানি ১১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপত্সীমার ৫১ সেন্টিমিটার এবং করতোয়া নদীর পানি ২৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপত্সীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল। জেলার ছয়টি উপজেলার দেড় লক্ষাধিক মানুষ বর্তমানে পানিবন্দি।

মির্জাপুর (টাঙ্গাইল) সংবাদদাতা জানান, মির্জাপুর পৌরসভা ও আট ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। বন্যার পানি এসে পড়েছে কুমুদিনী হাসপাতাল এবং উপজেলা সদরের শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামেও। বুধবার মির্জাপুর পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আমিরুল কাদের লাবন জানান, বংশাই ও লৌহজং নদীর পানির চাপে পৌরসভার পুষ্টকামুরী, ত্রিমোহন, গাড়াইল, কুমারজানি এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। অসহায় পরিবারগুলো এখন পর্যন্ত সরকারি সাহায্য না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বংশাই ও লৌহজং নদীর ভাঙনের কারণে দুই নদীর বেশ কিছু ব্রিজ রয়েছে হুমকির মুখে ।

ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) সংবাদদাতা জানান, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্ধলক্ষাধিক পরিবার এখনো ত্রাণসহায়তা পায়নি। অন্যদিকে যমুনা নদীর পানি কমতে থাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে বেশ কিছু এলাকায়। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, শুকনো খাবার, গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। উপজেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে ৬ হাজার পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল, নগদ টাকা, শিশুখাদ্য ও শুকনো খাবার প্রদান করা হয়েছে। তবে হিসাব মতে উপজেলায় এখনও ত্রাণসহায়তা পায়নি ৭১ হাজার ৫০০ পরিবার।

জামালপুর প্রতিনিধি জানান, জামালপুরে তৃতীয় দফা বন্যায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে বানভাসি মানুষ। জেলার সাতটি উপজেলার ১০ লক্ষাধিক মানুষ প্রায় ২৫দিন যাবত্ পানিবন্দি। যমুনা নদীর পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে গতকাল বিপত্সীমার ৮৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। অপরদিকে, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে জামালপুর ফেরীঘাট পয়েন্টে বিপত্সীমার ৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো.আবু সাঈদ। জেলা মত্স্য কর্মকর্তা কায়সার মুহাম্মদ মঈনুল হাসান জানান, এবারের বন্যায় মত্স্যজীবীদের প্রায় ১০ কোটি টাকার মাছ পানিতে ভেসে গেছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক ও জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্রে জানা যায়, বন্যার্তদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৪১০ মেট্রিক টন চাল, ১৯ লাখ টাকা, ৪ হাজার ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার, ২ লাখ টাকার শিশুখাদ্য ও ২ লাখ টাকার গোখাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। ভিজিএফ কার্ডধারীদের মধ্যে আরো ৩ হাজার ৪০৮ মেট্রিক টন চাল বিতরণ কাজ চলমান রয়েছে।

সরিষাবাড়ীতে বানের স্রোতে ভেসে গেল ব্রিজ

সরিষাবাড়ী (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার শুয়াকৈর গ্রামে ঝিনাই নদীর ওপর এলজিইডি নির্মিত ২০০ মিটার ব্রিজের একাংশ গত মঙ্গলবার রাতে বন্যার স্রোতে ভেসে গেছে। এতে উপজেলা সদরের সঙ্গে ১৫টি গ্রামের সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

মানিকগঞ্জে বন্যায় ভেঙে যাচ্ছে পৌরসভার ৪৫ কোটি টাকার রাস্তা

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মানিকগঞ্জে পৌরএলাকায় ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সদ্য নির্মিত অভ্যন্তরিণ সড়কগুলো বন্যার পানিতে ভেঙে যাচ্ছে। রাস্তার বেশির ভাগ অংশই এখন পানির নিচে। ইতিমধ্যে মানিকগঞ্জ পৌরসভা ভাঙন এলাকা চিহ্নিত করতে শুরু করেছে। আগামী শনিবার প্রকল্প পরিচালকরা রাস্তা পরিদর্শন করে সিদ্ধান্ত দেবেন—এমনটাই জানালেন মানিকগঞ্জ পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. বিল্লাল হোসেন।

সিদ্ধিরগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) বাঁধের নিম্নাঞ্চলে ফের জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়িতে হাঁটু সমান পানি। পানি নিষ্কাশনের জন্য তিনটি পাম্প চালুর পরও জলাবদ্ধতা কমছে না। বর্তমানে সরকারের নেওয়া পানি নিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ ৬০ ভাগ শেষ হয়েছে।

ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) সংবাদদাতা জানান, টানা বৃষ্টিতে ফুলবাড়ী উপজেলার শিবনগর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন শতাধিক পরিবার। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় শহীদ স্মৃতি আদর্শ কলেজ ও কলেজিয়েট উচ্চ বিদ্যালয়ে। গতকাল সকালে উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঐ দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেওয়া বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ হিসেবে চাল বিতরণ করা হয়েছে।

ডিমলা (নীলফামারী) সংবাদদাতা জানান, নীলফামারীর ডিমলায় তিস্তার পানি আবারও বৃদ্ধি পেয়ে গতকাল বিপত্সীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর ফলে নতুন নতুন এলাকায় বন্যা হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজের সবকয়টি জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড, ডালিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম। ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়শ্রী রানী রায় বন্যাকবলিত এলাকায় পানিবন্দিদের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করেছেন।

সিলেট অফিস জানায়, সিলেট ও সুনামগঞ্জের ১৬টি উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তীত রয়েছে। প্রলম্বিত বন্যায় আমন ও আউশ চাষিরা বিপাকে পড়েছেন।

তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, তাহিরপুরে নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৭০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। যাদুকাটা নদীর পানি গতকাল বিপত্সীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল বলে জানিয়েছেন তাহিরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী এমরান হোসেন। সুত্র. ইত্তেফাক