দেশের মানচিত্রে নাম না থাকা সীতাকুণ্ডের আলিনগর , কোন ঘটনা ঘটলে তার বিচার করে স্বঘোষিত রাজা 

দেশের মানচিত্রে নাম না থাকা সীতাকুণ্ডের আলিনগর , কোন ঘটনা ঘটলে তার বিচার করে স্বঘোষিত রাজা 
দেশের মানচিত্রে নাম না থাকা সীতাকুণ্ডের আলিনগর , কোন ঘটনা ঘটলে তার বিচার করে স্বঘোষিত রাজা 

নিজস্ব প্রতিবেদক ।।

দেশের মানচিত্রে নাম না থাকা একটি নাম সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুর "আলিনগর" । চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের দুর্গম পাহাড়ের এ এলাকাটি সুদীর্ঘকাল ধরে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন ছিল। এ সুযােগে সেখানে আস্তানা কয়ে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া সন্ত্রাসীরা গড়ে তােলে নিজস্ব এক পৃথক রাজ্য। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ কারােরই তেমন একটা যাতায়াত ছিল না। কোন ঘটনা ঘটলে তার বিচার করত সেখানকার অঘােষিত রাজা অর্থাৎ সন্ত্রাসীদের গডফাদাররা। তাদের বিচার যেমনই হােক এর বিরুদ্ধে মুখ খােলার সাহস ছিল না কারো। শুধু তাই নয়, এসব গডফাদারদের অনুমতি ছাড়া এ এলাকায় প্রবেশ করতে পারতেন না কেউ। এসব কারণে ধীরে ধীরে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয় এই জঙ্গল সলিমপুর।

৯০ এর দশকে দেশের বিভিন্ন এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী খুনধর্ষণ-অপহরণসহ বড় ধরনের অপরাধ করে আত্মগােপনে চলে আসতে থাকে এখানে। পরে তারাও বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপ গড়ে তুলে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে থাকে ।

স্থানীয় ও প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সীতাকুণ্ড উপজেলার ১০ নং সলিমপুর ইউনিয়নের পূর্ব দিকে গহীন পাহাড়ি এলাকার নাম জঙ্গল সলিমপুর। এলাকাটি সীতাকুণ্ড উপজেলাধীন হলেও মাত্র কয়েকবছর আগেও এখানে পৌছাতে যেতে হতাে চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে। সেখানে পৌছাতে যে পথে যেতে হতাে তা ছিল খুবই দুর্গম এবং বেশ সময় সাপেক্ষ। ফলে খুউব একটা প্রয়োজন ছাড়া কেউ যেতে চাইতাে না। এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও ঐ এলাকাটি এড়িয়ে চলত ।

সীতাকুণ্ডে এটির অবস্থান হলেও জঙ্গল সলিমপুরের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলাে এটি তিনটি থানার সীমান্তবর্তী। এর পূর্ব দিকে রয়েছে হাটহাজারী উপজেলা এবং দক্ষিণে বায়েজিদ থানা। এর ফলে জঙ্গল সলিমপুরে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা প্রশাসনের কোন অভিযানের আঁচ পেলে দ্রুতই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে অন্য থানা এলাকায় গিয়ে আত্মগােপনের সুযােগ পেয়ে যেত।

স্থানীয়রা জানান, ৯০ এর দশকে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এই জঙ্গলে এসে অবস্থান নেন দুর্ধর্ষ এক সন্ত্রাসী আলী আক্কাস। সে এখানে এসে জনবল বাড়িয়ে একটি বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তােলে। মূলত এই আলী আক্কাসের বাহিনীই তাদের নিজেদের বসতি স্থাপনের জন্য প্রথম পাহাড় কাটা শুরু করে। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে শুরু করে সেখানে কারােরই নজরদারি না থাকায় কোন বাধা পায়নি আলী আক্কাস। ফলে সে বুঝতে পারে এই সরকারি পাহাড়ই হতে পারে তার ভাগ্য বদলের চাবিকাঠি। অতি কৌশলী আক্কাস ও তার বাহিনী এরপর থেকেই চট্টগ্রাম মহানগরীর ট্যাক্সি চালক, রিকশা চালক থেকে শুরু করে বিভিন্ন নিন্ম আয়ের মানুষদের টোপ দিতে থাকে অল্প টাকায় জঙ্গল সলিমপুরে প্লট কিনে বসবাসের জন্য। কথিত রয়েছে সে সময় প্রতি দুই শতক আয়তনের একটি প্লট মাত্র ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হতাে।

চট্টগ্রামের খুব কাছের এলাকা হওয়ায় অল্প সময়েই আক্কাসের এলাকায় প্লট বিক্রির মহােৎসব শুরু হয়। অগ্রিম টাকা নিয়ে নিজেই একটি দলিল দিতাে আক্কাস। এভাবে অল্প সময়ে সেখানে হাজার হাজার প্লট বিক্রি করে কোটিপতি বনে যায় সে। তারপর এসব প্লট গ্রহীতাদের ছিন্নমূল সমবায় সমিতি নামক সমিতির অন্তর্ভুক্ত করে বিদ্যুৎ, পানি, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানান সেবা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কথা বলে নিয়মিত চাঁদা আদায় শুরু করে। এসময় নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী রক্ষা ও পাহাড় কাটার বিষয়গুলাে যেন বাইরে না যায় সেজন্য সে গড়ে তােলে বিশাল বাহিনী। আর এই বাহিনীর সদস্যরা পাহাড়ে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়।   

জঙ্গল সলিমপুরের প্রবেশ মুখে নির্মাণ করা হয় একাধিক লােহার গেট। গেটে নিয়ােজিত রক্ষীদের অনুমতি ব্যতীত সেখানে প্রবেশের সাধ্য ছিল না কারাে। এভাবে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে একছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আলী আক্কাস কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যায়। কিন্তু ২০০৩-০৪ সালের পর আক্কাসের নিজের বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বিপুল অংকের টাকা আর পাহাড়ের দখল নিয়ে মতানৈক্য শুরু হয়। যা প্রায়ই গােলাগুলি, হানাহানিতে রূপ নিতাে। এতে বার বার আলােচনায় আসার পর র‍্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয় আক্কাস। এরপর কিছুদিনের জন্য সেখানে সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ থাকলেও সময়ের সাথে সেখানে আবার নিজেদের অবস্থান জানান দেয় আক্কাসের অন্যান্য সহযােগীরা। ধীরে ধীরে একইভাবে সেখানে প্রভাব বিস্তার শুরু করে কাজী মশিউর রহমান, ইয়াছিন মিয়া, গফুর মেম্বার, গাজী সাদেকসহ বিভিন্ন দুস্কৃতিরা। তারা আলাদা আলাদা গ্রুপ তৈরির চেষ্টা করলে সেখানে সংঘর্ষ, খুন, ধর্ষণের মতাে ঘটনা বেড়ে যায়। ফলে ২০০৮-৯ থেকে ২০১২-১৩ সাল পর্যন্ত সময়ে একাধিকবার সেখানে অভিযান চালিয়ে বিপুল অস্ত্র উদ্ধার করে যৌথবাহিনী। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হতে থাকে ।

এক সময় সেখানে সব অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আবারাে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে তারা। এখানে অবস্থান নেয়া সন্ত্রাসীরা একসময় প্রায় সবাই বিএনপি অনুসারী থাকলেও পরে নিজেরা বাঁচতে আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে শুরু করে অপতৎপরতা। তারা এখানে ছিন্নমূল বস্তি ও আলীনগর বহুমখী সমিতি নামে দুটি সমিতি স্থাপন করেছে। যারা প্লট কিনেছে তারাই এ সমিতির সদস্য। বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার সদস্য এ দুটি সমিতিতে আছে। যার মানে ৩০ হাজার প্লট ইতিমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। তাছাড়া আরাে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

এদিকে, একসময় আক্কাসের মৃত্যুর পর সেখানে কাজী মশিউর রহমান ও ইয়াছিন মিয়ার দৌরাত্মা বেড়ে যায় । এছাড়া আছে গফুর মেম্বার, গাজী সাদেকসহ তাদের আরাে শতাধিক অনুসারী। 

গত বছর ডিসেম্বরে আগ্নেয়াস্ত্রসহ র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয় সন্ত্রাসী মশিউর রহমান। গ্রেপ্তার হয় তার কয়েকজন সহযােগীও। তখন থেকে আলীনগরে ইয়াছিনের দৌরাত্মা বেড়ে যায় । ইয়াছিন এতই বেপরােয়া হয় যে, গত ১৫ জুলাই জেলা প্রশাসনের একটি গাড়ি বহর থেকে নামিয়ে স্থানীয় এক ইউপি সদস্যকে মারধর করে তার বাহিনীর সদস্যরা । এরপরই নড়েচড়ে বসে জেলা প্রশাসন। তাদের তৎপরতায় ১৮ জুলাই গ্রেপ্তার হয় ইয়াছিন। তাকে রিমান্ডেও আনা হয়। সর্বশেষ গত শুক্রবার র‍্যাব-পুলিশের যৌথবাহিনী নিয়ে তার সাম্রাজ্যে অভিযান পরিচালনা করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাে. আশরাফুল আলম। এই অভিযানকালে সেখানে শত শত একর পাহাড় কেটে প্লট, সড়ক ও বিভিন্ন স্থাপনের প্রমাণ পেয়ে বেশ কয়েকটি স্কেভেটর ও ড্রাম ট্রাক জব্দ করা হয় । এ ঘটনার পর নির্বিচারে পাহাড় কাটার অপরাধে সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুর আলীনগরের পাহাড়খেকো ইয়াছিন মিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে পরিবেশ অধিদপ্তর। অন্যদিকে জঙ্গল সলিমপুরের আলীনগর থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে পিডিবি ।

সীতাকুণ্ডের সলিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাে. সালাউদ্দিন আজিজ বলেন, সেখানে ৩০ বছর ধরে নিয়মিত পাহাড় কেটে অবৈধ বসতি স্থাপন করা হয়েছে। এখন লাখাে মানুষের বসতি হয়ে গেছে। আমি চেয়ারম্যান হবার পর থেকে বহু মিটিংয়ে প্রশাসনের কাছে অনুরােধ করেছি এদের লাগাম টেনে ধরতে। কিন্তু কেউই মাথা ঘামায়নি। এখন সবাই মশিউর আর ইয়াছিনের সন্ত্রাসের কথা বলছে। গফুর মেম্বার, গাজী সাদেকরাও দখলবাজিতে ওদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাদের নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারাে।

সীতাকুণ্ড থানার ওসি মাে. আবুল কালাম আজাদ বলেন, সেখানে এসব অপকর্ম করতে থাকায় মশিউর, ইয়াছিনসহ তাদের সঙ্গীদের বিরুদ্ধে সীতাকুণ্ড ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় অসংখ্য মামলা আছে। তারা অনেকবার গ্রেপ্তারও হয়েছে। তারা জামিনে বের হয়ে আবার এসব অপকর্ম করে । এখন আমরা ইয়াছিনকে রিমান্ডেও এনেছি।

সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাে. আশরাফুল আলম বলেন, তিন যুগ ধরে দখলবাজি, পাহাড় কেনা-বেচা চলছে সেখানে। প্রতি শতক ২০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকায় বিক্রি করে কোটিপতি তারা। খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, গুম এমন কোন অপরাধ নেই যা সেখানে হয়নি। তাছাড়া এলাকাটি ছিল পুরােপুরি পাহাড় ঘেরা দুর্গম। বায়েজিদ লিংক রােড হওয়ার পর এটি চট্টগ্রাম মহানগরীর খুব কাছের হয়ে গেছে। এখন সরকার চায় এখানে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে। তারপর সেখানে জনকল্যাণমূলক ও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের মহাপরিকল্পনাও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান তিনি।

সীতাকুণ্ড ভূমি অফিসের তথ্যমতে, জঙ্গল সলিমপুর মৌজার ১ নম্বর খাস খতিয়ানের বিএস ২০১ দাগে ১৮ দশমিক ৭৭ একর, ২০৩ দাগে ৪৩২ দশমিক ৯৯ একর, ২১২ দাগে ০ দশমিক ০৭ একর, ২৬২ দাগে ৩ দশমিক ৭০ একর, ২৭৮ দাগে ৩৯ দশমিক ৬৫ একর, ৩৫০ দাগে ২০০ দশমিক ১০ একর, ৩৫১ দাগে ৪৮ দশমিক ৫০ একর, ৩৫২ দাগে ৩ দশমিক ৪০ একর, ৩৫৫ দাগে ৭৪ দশমিক ৭৫ একর, ছুট খতিয়ানের ৩০৯, ৩৪৯, ৩০৭ দাগ ও ১৯ নম্বর খতিয়ানের বিএস শ্রেণি পাহাড়, ২০২ দাগে ০ দশমিক ৯৯ একর ছড়া এবং ২১২ দাগে ০ দশমিক ০৭ একর শ্রেণি নাল থাকার কথা। কিন্তু ৪০টির বেশি পাহাড় কেটে ওখানে তৈরি করা হয়েছে অন্তত ২০ হাজার প্লট।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;