'ঠিক আছে স্যার, আমি করছি' বলেই গুলি চালানো হয়

'ঠিক আছে স্যার, আমি করছি' বলেই গুলি চালানো হয়

জিয়া চৌধুরী ও সৈয়দ আলমগীর ।।

টেকনাফ থেকে কক্সবাজার যাওয়ার পথে গত শুক্রবার অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের সফরসঙ্গী ছিলেন শাহেদুল ইসলাম সিফাত। তিনি এই হত্যাকাণ্ডকে একটি 'পূর্ব পরিকল্পিত' ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিফাত বলেন, পুলিশের যে ইন্সপেক্টর সিনহাকে গুলি করেন, তিনি মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন তখন এবং তাতে মনে হয়েছে তিনি অপর প্রান্তের কারো নির্দেশ কার্যকর করতে গুলি চালিয়েছেন।

'ফোনে কথা বলার সময় তিনি অন্যপ্রান্তের ব্যক্তিকে 'স্যার' বলে সম্বোধন করছিলেন। অন্যপ্রান্তের কথার জবাবে তিনি বলেন 'ঠিক আছে স্যার, আমি করছি'। তারপরই তিনি সিনহাকে লক্ষ্য করে গুলি চালান।' গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দল সিফাতের সঙ্গে কক্সবাজার কারাগারে দেখা করতে গেলে- তিনি কর্মকর্তাদের একথা বলেন ।

কারাগার অভ্যন্তরে সিফাতকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে জড়িত এক সূত্র জানিয়েছে যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সিফাত জিজ্ঞাসাবাদে এ কথাও জানিয়েছে যে, সাবেক সেনা কর্মকর্তা কখনই তার লাইসেন্সকৃত আগ্নেয়াস্ত্র বের করার চেষ্টা করেননি, এমন কি গুলি খাওয়ার পরেও না।

ঘটনার পুলিশি সংস্করণটিকে তিনি পুরোই নাকচ করে দিয়েছেন। পুলিশ দাবি করেছে যে, তারা আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল।

তদন্ত দলটি সিনহার অপর সতীর্থ শিপ্রা দেবনাথের সঙ্গেও কারাগারে কথা বলেছেন। তিনিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী। দুজনের বিরুদ্ধেই পুলিশ পৃথক দুটি মামলায় হত্যা চেষ্টা এবং মাদকদ্রব্য বহন করার অভিযোগ এনেছে।

শিক্ষার্থীদের নিয়ে কক্সবাজারে মেজর (অব.) সিনহা একটি প্রামান্যচিত্র তৈরির কাজ করছিলেন।

তদন্তকারী দলের কাছে ওই রাতের কথা স্মরণ করতে গিয়ে সিফাত বলেন, 'শুক্রবার রাত সোয়া নয়টা দিকে আমরা কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বাহারচড়া ইউনিয়নের শুটিং স্পট থেকে ফিরছিলাম। আমরা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের দুটি  চেকপোস্ট পার হয়ে আসি, সবকিছু ঠিকই ছিল।'

সিফাত জানান, কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভের শামলাপুর চেকপয়েন্টে এলে তাদের থামার ইঙ্গিত দেয় পুলিশ - ওই রাতে এটা ছিল তাদের তৃতীয় চেকপোস্ট।

'সিনহা স্যার গাড়ি থামালে পুলিশ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী চেঁচিয়ে আমাদের সবাইকে হাত উপরে উঠাতে বলে। তার কথা মতো আমরা তাই করি। সিনহা স্যার গাড়ি থেকে নেমে যান আর আমি গাড়ির সামনে সিটে বসে থাকি।

'তিনি নিজের পরিচয় দেন। পুলিশকে জানান যে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন প্রাক্তন মেজর। তিনি এমনকি পুলিশকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার পরিচয় যাচাই করারও প্রস্তাব দেন,' জানান সিফাত।

'কিন্তু লিয়াকত কোনো রকম সতর্ক না করেই তাকে গুলি করতে শুরু করে,' দাবি সিফাতের।

'গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি লিয়াকত, সিনহা স্যার যখন যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছিলেন বুট দিয়ে তার গলা চেপে ধরে সে। কর্তব্যরত পুলিশ তখন আমাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন,' বলেন সিফাত।

'মাদক উদ্ধারও একটি সাজানো গল্প'

সিফাত তদন্ত দলকে বলেন, ওই রাতে তারা কেউই মাতাল ছিল না বা কেউই কোনো মাদক বহন করছিল না।

'এই এলাকাটা আমরা চিনি ২৮ দিন ধরে। মেরিন ড্রাইভে একাধিক চেকপোস্ট রয়েছে জেনেও কোন বুদ্ধিতে এই ঝুঁকি নেব?' তদন্ত কমিটিকে বলেন সিফাত।

স্থানীয় গ্রামবাসী তাদের ডাকাত বলে চিৎকার করেছে পুলিশের এই দাবিও একেবারে মিথ্যা বলেন সিফাত।

তিনি তদন্ত দলকে বলেন, 'টেকনাফ থেকে ফেরার পথে আমাদের দু'জন স্থানীয় লোকের সাথে দেখা হয়, তারা আমাদের পরিচয় জানতে চেয়েছে, তবে তারা আমাদেরকে দেখে কখনই ডাকাত বলে চিৎকার জুড়ে দেয়নি।'

সিনহার আরেক সতীর্থ শিপ্রা দেবনাথ, শুক্রবার রাতে স্থানীয় একটি রিসর্টে ছিলেন। তিনি তদন্ত দলকে বলেন, সেই ৩ জুলাই থেকে তিনি ডকুমেন্টারি দলটার সঙ্গে কাজ করছেন। প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তাকে তিনি কখনই রাগতে বা উত্তেজিত হতে দেখেননি।

তার কথায় সায় পাওয়া যায় রিসোর্ট মালিক মনজুরুল কবিরে কথাতেও, তিনিও জানান: এখানে যতদিন আছেন সিনহাকে তিনি পুরো একজন নম্র-ভদ্র ব্যক্তি হিসেবেই পেয়েছেন।

'আমি তাকে, এমন কি কখনও কারও সঙ্গে উঁচু গলাতে কথা বলতে দেখিনি। সে কীভাবে পুলিশকে বন্দুক ঠেকাবে!' 

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও তদন্ত কমিটির সমন্বয়ক শাহজাহান আলী জানিয়েছেন, তারা দ্রুতই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন।

সূত্র. দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড