খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৪ হাজার কোটি টাকা ১টি দেশের অর্থনীতির জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়, ভয়ভী‌তি কা‌টি‌য়ে ঋণ দেয়ার পরামর্শ গভর্নরের

খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৪ হাজার কোটি টাকা ১টি দেশের অর্থনীতির জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়, ভয়ভী‌তি কা‌টি‌য়ে ঋণ দেয়ার পরামর্শ গভর্নরের

পোস্টকার্ড প্রতিবেদক।।

সরকা‌রি ব্যাংকগু‌লো‌কে ভয়ভী‌তি কাটিয়ে গ্রাহকদের ঋণ দিতে পরামর্শ দি‌য়ে‌ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। তিনি ব‌লেছেন, ‘হলমার্কের ঘটনার পর সোনালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক সংকোচ ও ভীতি রয়েছে। এটি একেবারে থাকা উচিত নয়।’

এ ভয় দূর করে ঋণ দেয়ার পরামর্শ দি‌য়ে গভর্নর ব‌লেন, ‘আপনারা (কর্মকর্তারা) যদি সব ধরনের নিয়ম পরিপালন করে ঋণ প্রদান করে থাকেন, তাহলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বিতরণকৃত ঋণ কখনো সন্দেহজনক, কখনো মন্দ মানের হবেই। তাই বলে ঋণ দেয়া বন্ধ করবেন নাকি?’

বুধবার (৪ মার্চ) রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের বার্ষিক সম্মেলন-২০২০ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছি‌লেন— অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী (সিইও) এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান প্রধানের সভাপতিত্ব করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম, সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী প্রমুখ।

ফজলে কবির ব‌লেন, ‘দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে ঋণ দিতে হবে। আর ভয়ভীতি কাটিয়ে সব ধরনের নিয়ম মেনে ঋণ প্রদান করবেন, তাহলে কোনো সমস্যা হবে না। আর ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে আপনারা যেন কোনো সমস্যায় না পড়েন, এ জন্য অর্থমন্ত্রণালয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবসময় আপনাদের পাশে থাকবে।’

একইসঙ্গে নতুনভাবে বিতরণ করা ঋণ যেন ভবিষ্যতে বোঝা হয়ে না দাঁড়ায় এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন গভর্নর।

ঋণখেলাপি হলে শুরুতেই মামলায় না যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে গভর্নর বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান কোনো সমস্যায় পড়লে তাকে যতটুকু প্রয়োজন সহায়তা করে কর্মযজ্ঞে ফিরে যাওয়ার সহযোগিতা করতে হবে। কারণ মামলা করলে প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়; কর্মসংস্থানে বাধা সৃষ্টি হয়।’

বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার প্রতি অভিযোগ এনে গভর্নর বলেন, ‘দেশি ও বিদেশি কিছু গবেষণা সংস্থা দেশের মোট ক্ষতিগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেখানোর চেষ্টা করছে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করছে, অবলোপন এবং রিশিডিউলের টাকা। কিন্তু রিশিডিউল একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রকৃতপক্ষে দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক কম।’

বিশ্ব অর্থনীতির কথা চিন্তা করে সচেতনভাবে ঋণ বিতরণ এবং খেলাপি ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়া জোরদার করার আহ্বান জানান তিনি। ‘এ জন্য উৎপাদনশীল খাতে ঋণ বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি নির্দিষ্ট খাত বা ব্যক্তির কাছে ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে না যায় সে বিষয়েও লক্ষ্য রাখতে হবে’ যোগ করেন গভর্নর।

তিনি বলেন, ‘দেশ এগিয়ে যা‌চ্ছে; এ ক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যাংকিং খাতের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। সুতরাং এই ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব অনেক। বর্তমানে দেশের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৪ হাজার কোটি টাকা। যা মোট বিতরণের ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। একটি দেশের অর্থনীতির জন্য এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে সেপ্টেম্বর শেষে এটা অনেক বেশি ছিল। খেলাপি কমিয়ে আনতে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ১০ বছর মেয়াদি রিশিডিউল পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।’

ব্যাক টু ব্যাক লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে গভর্নর ব‌লেন, ‘এটা যেন পরবর্তীতে ফোর্স ‌লো‌নে পরিণত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ ব্যাংকের জন্য এটি একটি বোঝা।’

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘মুজিববর্ষে আর্থিকভাবে যেন আমরা পিছিয়ে না যাই, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এখন বিশ্বব্যাপী একটি ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে দিয়েও ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা উন্নত দেশের কাতারে যেতে চাই। তাই সচেতনতার সঙ্গে আপনাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।’

সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা এখন বড় চ্যালেঞ্জের মুখে আছি। আগামী এপ্রিল থেকে প্রত্যেক ব্যাংক ৯ শতাংশ ঋণ বিতরণ করবে। এখন আমরা যদি অন্যান্য ব্যাংকের চেয়ে বেশি সেবা দিতে না পারি তাহলে আমরা পিছিয়ে পড়ব।’ সেবাগত এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি করে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘এ মুহূর্তে করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আমরা আরও সামনে এগিয়ে যেতে চাই। আগামী ১৭ মার্চ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে প্রথম মোবাইল অ্যাপ চালু কর‌বে। এ বছরের মধ্যেই মোবাইল এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এবং রেমিট্যান্স আনার বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে সোনালী ব্যাংক।’

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের এ বছরের স্লোগান ‘দীপ্ত শপথ মুজিববর্ষে, আমরা যাবো সবার শীর্ষে’। এই স্লোগানকে সামনে রেখে ব্যাংকিংখাতে আমরা শীর্ষে যেতে চাই। মুখে নয়, কাজে বাস্তবায়ন করে আগামী বছরে সোনালী ব্যাংক খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক অংকে নামিয়ে আনতে সক্ষম হবে।’

২০১৯ সালে সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে সোনালী ব্যাংক। কিন্তু ৫২টি সেবার মধ্যে ৩৭টি সেবা বিনামূল্যে দেয়ার কারণে প্রায় ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা মুনাফা কম হয় বলেও জানান তিনি। ‘এসব সেবার মান আরও উন্নত করেই সামনের দিকে এগিয়ে যা‌ব’ ব‌লে উল্লেখ করেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২০ শতাংশে। এ হার ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের পর সর্বনিম্ন। ওই সমেয় ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ০৯ শতাংশ।