কোভিড-১৯ রোগ নির্ণয়ে সোয়াব টেস্ট নাকি আরডিটি

কোভিড-১৯ রোগ নির্ণয়ে সোয়াব টেস্ট নাকি আরডিটি

অধ্যাপক প্রদীপ কুমার দত্ত ।।

প্রাণঘাতী করোনার রোগ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের পরীক্ষার কথা বলা হচ্ছে। জরুরিভিত্তিতে এসব পরীক্ষা অনুমোদনের জন্য তাগাদাও দেয়া হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এসব পরীক্ষা কতটুকু কার্যকর এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এসব পরীক্ষা আদৌ কতুটুকু অনুমোদন দিচ্ছে তা জানা দরকার। করোনাভাইরাস রোগ নির্ণয়ে মূলতঃ চার ধরনের টেস্ট ব্যবহার করা হয় –

* রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমেরেইজ চেইন রিয়েকশন (আরটি- পিসিআর)

* লুপ-মেডিয়েটেড আইসোথার্মাল এমপ্লিফিকেশন (এলএএমপি)

* লেটারেল ফ্লো ইমিউনোয়েজি (রেপিড এন্টিবডি/এন্টিজেন টেস্ট )

* ইলিসা টেস্ট (ইএলআইএসএ টেস্ট)

আরটি- পিসিআর :

এটা ফ্রন্টলাইন টেস্ট যা বিশ^ব্যাপী প্রচলিত। এটার ফলাফল পেতে ৬-৮ ঘণ্টা সময় লাগে এবং সরাসরি ভাইরাসের উপস্থিতি বুঝা যায়। এর সেনসিটিভিটি (ফলস নেগেটিভ) স্পেসিমেন (কফ, লালা, রক্ত, নাক বাগলা) উপর নির্ভর করে কিন্তু ১০০% স্পেসিফিক। স্পেসিমেন ঠিক জায়গা বা পর্যাপ্ত পরিমাণ না নিলে অথবা খুব তাড়াতাড়ি বা দেরিতে (উপসর্গ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে বা ৭ দিন পরে) নিলে ওই সময় ভাইরাস না থাকতেও পারে। সেক্ষেত্রে ৫ দিন পর আবার টেস্ট করতে হবে।

এই টেস্টের সুবিধা :
১. বিশ্বের খ্যাতিমান বিজ্ঞানী ও মেডিকেল রিসার্চাররা এটাকে সবচাইতে নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি হিসাবে মেনে নিয়েছেন।
২. এটা বিশ^ব্যাপী প্রচলিত।
৩. এই পরীক্ষায় নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব ভাইরাস সংক্রমণ সক্রিয় আছে নাকি নাই।

এই টেস্টের অসুবিধা :
১. যেসব রোগী রোগমুক্ত ও ভাইরাসমুক্ত হয়েছেন ওইসব রোগী এই পরীক্ষায় শনাক্ত করা যায় না।
২. একই সময়ে কফ ও গলা থেকে স্পেসিমেন নিলে দ্ইু জায়গাতে পাওয়া নাও যেতে পারে।
৩. এটি শুধু চলতি কোভিড ভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত করে, অন্য কোন রোগ বা উপসর্গ সম্পর্কে কিছু বলতে পারে না।
৪. স্পেশাল ল্যাবরেটরি ছাড়া এ পরীক্ষা করা যায় না।

লুপ-মেডিয়েটেড আইসোথার্মাল এমপ্লিফিকেশন (এলএএমপি) :

এটি একটি নুতন প্রযুক্তি, কিন্তু সহজ, সরল এবং আরটি-পিসিআর’র সমকক্ষ এবং খালি চোখে রিএজেন্টের ঘোলাটের অবস্থা থেকে ২-৩ ঘণ্টার মধ্যে এমনকি উপজেলা হাসপাতালে ল্যাবরেটরিতে ভাইরাস শনাক্ত করা যায়। এই টেস্টের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এখনও বেশি হয়নি এবং রিসার্চ পটভূমিও অত পর্যাপ্ত নয়। তা না হলে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে এই টেস্টটাই সবচাইতে কার্যকরী টেস্ট হত।

লেটারেল ফ্লো ইমিউনোয়েজি (রেপিড এন্টিবডি/এন্টিজেন টেস্ট) :

এই টেস্ট দিয়ে এন্টিবডি বা এন্টিজেন দুটোই বের করা যায়। এটা একটা সহজ টেস্ট। অনেকটা প্রেগন্যান্সি টেস্টের মত। দৃশ্যতঃ এন্টিজেন টেস্ট এখনও বাজারে আসেনি। গবেষকগণ বলছেন, এই মহামারীতে এটা আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ, কেননা এটার জন্য অনেক জটিল বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি দরকার যা এখনও চ্যালেঞ্জ (আমাদের দেশে একটা কিট প্রস্তুতকারক সংস্থা কেন এরকম দারি করছে বোধগম্য নয়)। বিভিন্ন দেশে টেস্ট কিটগুলি আসলে এন্টিবডি শনাক্ত করে। এটা দিয়ে ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে শুধু এক ফোঁটা রক্ত (শিরা/আঙ্গুলে ফুটা করে, অনেকটা রক্তে গ্লুকোজ যেভাবে দেখে) থেকে ভাইরাসের এন্টিবডি রেসপন্স দেখে, ভাইরাস শনাক্ত করে না। অর্থাৎ ভাইরাসের যে আগে সংক্রমণ হয়েছিল বুঝায়। আমাদের দেশেও একটি প্রস্তুতকারক সংস্থা অনেক স্বল্পমুল্যে (মাত্র ৩ ডলার) দেওয়ার কথা বলেছে। সেনেগাল আরও কম মূল্যে (১ ডলারে) বিক্রি করছে। এঁরা সবাই বাইরে থেকে এন্টিজেন ও এন্টিবডি এনে কিট প্রস্তুত করছেন, তারা নিজেরা এগুলোর আবিষ্কারক নন। তারা হলেন প্রস্তুতকারক। চীনে প্রথম এটা তৈরি হয়। এই টেস্ট কিটগুলোর প্রধান সমস্যা ভেলিডিটি ও রিলায়েবিলিটি। আদর্শগতভাবে এগুলো ১০০% সেনসিটিভ ও ১০০% স্পেসিফিক হওয়া উচিৎ। ৮০% সেনসিটিভ মানে ২০% ফলস নেগেটিভ। এটা মারাত্মক, কেননা রোগী মনে করবে সে সংক্রমিত নয় আর তাতে অন্যরা সংক্রমিত হবে। স্পেসিফিসিটি কম হলে (ফলস পজিটিভ) অত মারাত্মক নয়। ডেনমার্কের কিছু কিছু কিটের সেনসিটিভিটি পাওয়া গেছে মাত্র ৬৭%। তাই কঠোর এবং বড় স্যাম্পলের (যেমন ২০০ জনের উপর করতে হবে) উপর পরীক্ষা না করে এই টেস্টের সুপারিশ করা ঠিক না। আবার যাদের শরীরে এন্টিবডি পাওয়া গেছে তা যে সারাজীবন থাকবে অথবা তাদের আর কোভিড-১৯ হবে না এমন কোন নিশ্চয়তা নাই। এমনও দেখা গেছে, এন্টিবডি হওয়ার পরেও ভাইরাল আরএনএ নির্গত হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের জন্য তিন ধরনের এন্টিবডি তৈরি হয়ঃ আইজিজি, আইজিএম, আইজিএ। আইজিএম সংক্রমণের ৫ দিন পরে এবং আইজিজি ৮-১০ দিন পরে আসে। আইজিএম সর্বোচ্চ লেভেলে উঠতে ৯ দিন এবং আইজিজি ১১ দিন লাগে।
এই টেস্টের সুবিধা :
১. খুব তাড়াতাড়ি ১৫ মিনিটের মধ্যে ফল পাওয়া যায়।
২. খুব সহজ পদ্ধতি, বাইরে (শরীরের ভিতরে যেতে হয় না) থেকে এক ফোঁটা রক্ত নিতে হয়।
৩. কোন ট্রেনিং, ল্যাবরেটরি লাগে না, এনালাইসিসের জন্য বিজ্ঞানী লাগে না ।
৪. সংক্রমিত হয়েছে কিন্তু উপসর্গবিহীন রোগী শনাক্ত করা যায়।
৫. অধিকাংশ লোকের যদি এই টেস্ট করা যায়, তবে হার্ড ইমিউনিটি হয়েছে কিনা বুঝা যাবে। এতে দেশে কতদিন কোয়ারেন্টিন রাখা দরকার, কেস সংখ্যা, সামাজিক দূরত্ব বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থল কতদিন বন্ধ রাখতে হবে, তা ঠিক করা যায়। একটি দেশের ‘হট স্পট’ বের করে ব্যবহারযোগ্য সম্পদ কোথায় কি পরিমাণ বরাদ্দ করতে হবে বুঝা যায়।
৬. বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভুল সময়ে করার জন্য বা স্পেসিমেন ঠিক জায়গা থেকে না নেওয়ার জন্য আরটি-পিসিআর টেস্ট নেগেটিভ আসে। তখন এই এন্টিবডি টেস্ট করলে যদি পজেটিভ আসে তাহলে আগের সংক্রমণ বুঝা যাবে। কিন্তু এ ব্যাপারে জোড়া রক্ত পরীক্ষা (প্রথম ও ১৪ দিন পরে যদি ক্রমবর্ধমান এন্টিবডি পাওয়া যায়) করা উচিৎ।
৭. সংক্রমণের কয়েক মাস পরেও শনাক্ত করা যায়।
এই টেস্টের অসুবিধা :
১. এই টেস্ট কোভিড-১৯ এরজন্য মোটামুটি নতুন। তাই এর খুঁত শূন্যতা এখনও প্রমাণিত নয়।
২. এই টেস্ট দিয়ে আগে সংক্রমণ হয়েছে বুঝায়, চলতি সংক্রমণ বুঝায় না। সক্রিয় সংক্রমণের সময় এই টেস্ট করা ঝুঁকিপূর্ণ।
৩. এক সাথে অনেক টেস্ট করা যায় না।
৪. সবচেয়ে বিপজ্জনক যদি এই টেস্টের এন্টিজেন ঠিক কোভিড-১৯ ভাইরাসের না হয়, তাহলে প্রয়োজনীয় এন্টিবডি নির্দেশ করবে না। তাই নিজের দেশের কোরোনা আক্রান্ত রোগীর সিরাম দিয়ে যাচাই করে নিতে হবে।
৫. খুব ভাল সেনসিটিভ ও স্পেসিফিক হতে হবে। এটা নির্দিষ্ট দেশ তাদেরটা ঠিক করবে।
৬. ফলস পজেটিভ টেস্টের সিরাম কনভালেসেন্ট সিরাম হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না। তাই যেসব কিটের স্পেসিফিসিটি কম সে সব কিট বিপজ্জনক।
৭. যাদের ইমিউনিটি (যেমন, এইচআইভি) কম, টেস্ট ফলস নেগেটিভ আসবে।
৮. সংক্রমণ ছাড়াও বয়স, খাদ্যাভ্যাস, রোগের গভীরতার উপরেও এন্টিবডি উৎপাদন নির্ভর করে।
৯. এ টেস্ট অন্যান্য করোনাভাইরাসের (যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা) সাথে ক্রস-রিয়েক্ট করতে পারে এবং ফলস পজেটিভ ফল দেবে।

যে রেপিড ডায়াগনস্টিক টেস্ট এন্টিজেন শনাক্ত করবে, সেটা দিয়ে আরটি-পিসিআর’র মত সরাসরি ভাইরাসের সক্রিয় সংক্রমণ বুঝাবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত যেসব কিট পাওয়া যাচ্ছে তাদের সেনসিটিভিটি মাত্র ৩৪%-৮০%। আবার অনেক সময় এরা এন্টিবডি সঠিক না হওয়ার জন্য অন্য করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯ নয়) শনাক্ত করে ফলস পজেটিভ হত দেখায়। তাই “হু’’ এই টেস্টকে সুপারিশ করে না। এখনও পর্যন্ত একই স্ট্রিপে এন্টিজেন ও এন্টিবডি শনাক্ত করা যায় মত কোন কিছু বৈজ্ঞানিক রচনায় পাওয়া যায়নি (আমাদের দেশের এক প্রস্তুতকারক যা বলছেন)। যদি পাওয়া যায় আমাদের মত দেশের জন্য এটা একটা বিরাট আশীর্বাদ হবে। অনেকে মত পোষণ করেন যে উপসর্গের সাথে সাথে এন্টিজেন কফে পাওয়া যায়। তাই এমন একটা ফরমেট যদি পাওয়া যেত যেখানে এন্টিজেন ও এন্টিবডি একই সাথে পাওয়া যাচ্ছে, ওটাই ‘পয়েন্ট অব কেয়ার’ এর জন্য সর্বোত্তম হত। বর্তমানে এন্টিজেন টেস্ট শুধু এইচআইভি, ম্যালেরিয়া ও ফ্লু’র জন্য ব্যবহার করা হয়।

ইএলআইএসএ টেস্ট :

এই টেস্ট দিয়ে ও এন্টিবডি ও এন্টিজেন দুইটাই শনাক্ত করা যাবে। এটা একটা সহজ টেস্ট যেটা যে কোন পরীক্ষাগারে করা যাবে এবং ১-৩ ঘণ্টার মধ্যে ৯৬টা টেস্ট করা যাবে। কিন্তু এটা এখনও সার্স-কোভি-২ ভাইরাসের জন্য প্রতিষ্ঠিত নয়। এটা বাজারে আসলে এটাই সবচাইতে সস্তা টেস্ট হবে।
এত বর্ণনার পর উপসংহারে বলতে চাই, কোভিড-১৯ ভাইরাসের জন্য চারটি টেস্ট আছে। এ টেস্টগুলি প্রস্তুতের এবং বৈধতার বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। এ টেস্টগুলোর প্রত্যেকের নিজস্ব কিছু সুবিধা ও অসুবিধা আছে। রোগীর চিকিৎসা ও মহামারী নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন টেস্ট সমন্বিতভাবে (যেমনঃ আরটি-পিসিআর/এন্টিবডি টেস্টিং) ব্যবহার করতে হবে যার ফলে ফলস নেগেটিভ কমে যাবে। এই মহামারীর সময়ে টেস্ট বৈধতার জন্য অবশ্যই দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করতে হবে। তা না হলে অনেক মূল্য দিতে হবে।

লেখক: প্রাক্তন অধ্যাপক (নেফ্রোলজি ) ও উপাধ্যক্ষ
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
মেডিসিন ও নেফ্রোলজি বিশেষজ্ঞ