আল্লাহর প্রিয় পাত্র হওয়া মানুষের প্রকৃত সফলতা, যে সাত কাজে মুসলমানের সফলতা

আল্লাহর প্রিয় পাত্র হওয়া মানুষের প্রকৃত সফলতা, যে সাত কাজে মুসলমানের সফলতা
আল্লাহর প্রিয় পাত্র হওয়া মানুষের প্রকৃত সফলতা, যে সাত কাজে মুসলমানের সফলতা

মুফতি ইমামুদ্দীন সুলতান ।।

আল্লাহর প্রিয় পাত্র হওয়া মানুষের প্রকৃত সফলতা । আল্লাহর প্রিয় হওয়ার জন্য কিছু গুণ ও বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে হয়। পবিত্র কুরআনের সুরা মুমিনুনে এমন সাতটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। যে ব্যক্তি এসব গুণ অর্জন করবে সে জান্নাতুল ফেরদাউসের উত্তরাধিকারী হবে। হজরত ওমর ফারুক (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি যখন অহি নাজিল হতো, তখন নিকটবর্তী লোকদের কানে মৌমাছির গুঞ্জনের ন্যায় আওয়াজ ধ্বনিত হতো। একদিন তাঁর কাছে এমনি আওয়াজ শুনে আমরা সদ্যপ্রাপ্ত অহি শোনার জন্য থেমে গেলাম। অহির বিশেষ অবস্থা সমাপ্ত হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) কেবলামুখী হয়ে বসে গেলেন এবং দোয়া পাঠ করতে লাগলেন, হে আল্লাহ আমাদেরকে বেশি দান করুন, কম দিয়েন না। আমাদের সম্মান বৃদ্ধি করুন লাঞ্ছিত করবেন না। আমাদেরকে দান করুন, বঞ্চিত করেন না। আমাদেরকে অন্যের ওপর অধিকার দিন, অন্যদেরকে অগ্রাধিকার দিয়েন না। আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন এবং আমাদেরকে আপনার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট করুন।’ এরপর রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘একটু আগে আমার ওপর ১০টি আয়াত নাজিল হয়েছে। কেউ যদি এ আয়াতগুলো পুরোপুরি পালন করে, তবে সে সোজা জান্নাতে যাবে। এরপর তিনি সুরা মুমিনুনের প্রথম ১০টি আয়াত পাঠ করে শোনালেন’ (মুসনাদে আহমাদ : ২২৩)। আর এই আয়াতগুলোতে সাতটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে।

নামাজে খুশু তথা একাগ্রতা রাখা : নামাজ মহান আল্লাহর সঙ্গে বান্দার একান্ত সান্নিধ্যের সুযোগ। নামাজে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো কিছুর কল্পনা বাদ দেওয়া, অনর্থক নড়াচড়া না করা এবং দৃষ্টিকে সেজদার জায়গায় নিবদ্ধ রাখা। খুশু-খুজু কম হলে সওয়াবও কম পাওয়া যায়। আম্মার ইবনু ইয়াসির (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, এমন লোকও আছে, যারা নামাজ আদায় করা সত্ত্বেও নামাজে রুকন ও শর্তগুলো সঠিকভাবে আদায় না করা এবং নামাজে পরিপূর্ণ একাগ্রতা ও খুশু-খুজু না থাকায় নামাজের পরিপূর্ণ সওয়াব পায় না। বরং তারা ১০ ভাগের এক ভাগ, ৯ ভাগের এক ভাগ, আট ভাগের এক ভাগ, সাত ভাগের এক ভাগ, ছয় ভাগের এক ভাগ, পাঁচ ভাগের এক ভাগ, চার ভাগের এক ভাগ, তিন ভাগের এক ভাগ বা অর্ধাংশ সওয়াব পায়।’ (আবু দাউদ : ৭৯৬)

অনর্থক বিষয়াদি থেকে বিরত থাকা : অনর্থক কথা অথবা কাজ, যাতে কোনো ধর্মীয় উপকার নেই। হাদিস শরিফে অনর্থক বিষয়াদি পরিহার করাকে মানুষের ইসলামের সৌন্দর্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের সৌন্দর্য হচ্ছে অনর্থক বিষয়াদি পরিহার করা।’ (তিরমিজি : ২৩২০) 

জাকাত আদায় করা : জাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ পবিত্র করা। পরিভাষায় মোট অর্থ-সম্পদের একটা বিশেষ অংশ কিছু শর্তসহ দান করাকে জাকাত বলা হয়, যা ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। কুরআন-সুন্নাহয় জাকাত আদায়ের গুরুত্ব, ফজিলত এবং অনাদায়ের কারণে আজাবের ভয়াবহতার কথা উল্লেখ রয়েছে। এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে কঠোর আজাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা ললাট, পাশর্^ ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে। সেদিন বলা হবে, এগুলো ওই সম্পদ, যা তুমি নিজের জন্য জমা করে রেখেছিল। সুতরাং এখন স্বাদ গ্রহণ করো জমা করে রাখার।’ (সুরা তাওবা : ৩৪-৩৫)

লজ্জাস্থান সংযত রাখা : বিবাহিত স্ত্রী ছাড়া সব পর নারী থেকে যৌনাঙ্গকে হেফাজত রাখা এবং স্ত্রীর সঙ্গে কামবাসনা পূর্ণ করার ক্ষেত্রেও শরিয়তের বিধিমালা মেনে চলা। হায়েজ, নেফাসের সময় এবং নিষিদ্ধ স্থানে সহবাস করা থেকে বিরত থাকা। পাশাপাশি নিজের কামবাসনা পূর্ণ করার এ বৈধ পথ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে যৌনাচার করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা। যারা এই বৈধ মাধ্যমে সীমাবদ্ধ থাকবে, পবিত্র কুরআনে তাদেরকে তিরস্কৃত না হওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। আর যারা অবৈধ পথে যৌনাচার করবে তারা হবে সীমালঙ্ঘনকারী।

আমানত রক্ষা করা : আমানত একটি ব্যাপক শব্দ। ‘হুকুকুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর হক এবং ‘হুকুকুল ইবাদ’ অর্থাৎ বান্দার হক উভয়টি যথাযথভাবে পালন করা। আল্লাহর হক সম্পর্কিত আমানত হলো, আল্লাহর সব আদেশ পালন করা আর নিষেধগুলো বর্জন করা। আর বান্দার হক সম্পৃক্ত আমানত হলো, কারো কাছে কেউ কোনো অর্থ-সম্পদ জমা রাখলে তা যথাযথ হেফাজত করা এবং যথাসময়ে তা প্রত্যাবর্তন করা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মুনাফিকের আলামত তিনটি- এক. যখন কথা বলে মিথ্যা বলে। দুই. যখন ওয়াদা করে ভঙ্গ করে। তিন. আমানত রাখা হলে খেয়ানত করে।’ (বুখারি : ৩২)।

ওয়াদা পূর্ণ করা : বিভিন্ন সময় মানুষ কোনো কাজ করা বা কাউকে কোনো কিছু দেওয়ার ওয়াদা করে থাকে। শরিয়তের দৃষ্টিতে এমন ওয়াদা পূর্ণ করাও জরুরি। শরিয়তসম্মত ওজর ব্যতীত তা খেলাপ করা জায়েজ নয়। তেমনিভাবে যাপিত জীবনে মানুষ প্রয়োজনে একে অপরের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন চুক্তি করে থাকে এবং উভয় পক্ষ তা পূর্ণ করাকে আবশ্যক মনে করে। এমন চুক্তি পূর্ণ করা ফরজ এবং তা ভঙ্গ করা হারাম। হাদিস শরিফে ওয়াদা ভঙ্গকারীর দ্বীন নেই বলে হুঁশিয়ারি করা হয়েছে। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) খুব কম ভাষণ আমাদের সামনে দিয়েছেন এবং তাতে বলেছেন, ‘যার আমানত নেই তার ঈমান নেই। আর যার ওয়াদা ঠিক নেই তার দ্বীন নেই।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ : ৩৫)

নামাজে যত্নবান হওয়া : নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়ার অর্থ হলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজকে যথাসময়ে মুস্তাহাব ওয়াক্তে আদায় করা এবং নামাজের পাবন্দি করা। যথাসময়ে নামাজ আদায় করাকে হাদিস শরিফে উত্তম আমল বলা হয়েছে। হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, কোন আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়? তিনি বললেন, যথাসময়ে নামাজ আদায় করা।’ (বুখারি : ৫০২)

উল্লিখিত সাত গুণ ও বৈশিষ্ট্য প্রতিটি মুসলমানের ধারণ করা জরুরি। পবিত্র কুরআনে সফলকাম এবং জান্নাতুল ফেরদাউসের উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করা হয় এই সাত গুণ ও বৈশিষ্ট্য অর্জনকারীদের। আল্লাহ আমাদেরকে এসব বিষয় অর্জন করার তওফিক দান করুন।

মুহাদ্দিস, জামিয়া ইমদাদিয়া 
আরাবিয়া শেখেরচর, নরসিংদী