মা - মোহাম্মদ আবদুল মালেক

মা - মোহাম্মদ আবদুল মালেক
মা - মোহাম্মদ আবদুল মালেক

কলকাতার যাদবপুর। দাদা সুশান্ত দাশগুপ্ত। বৌদি ডালিয়া দাশগুপ্ত। সন্ধ্যার সময় চা পান করছিলাম। তিন জন হল ঘরে ঢুকলেন। তাদের দু’জন মধ্যবয়সী, একজন বৃদ্ধ। তাঁরা বসলেন। জানতে পারলাম– মধ্যবয়সী দুজন রোটারীর মহিলা বিভাগ ইনার হুইল ক্লাবের সদস্যা।

তাঁরা জানালেন, বৃদ্ধাকে সকালে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে এসেছেন। যদি ক্লাবের মাধ্যমে এই অসহায় বৃদ্ধার সহায়তায় কিছু করা যায়। তাঁরা যা জানালেন তা হলো– বৃদ্ধা মধ্যবিত্ত ঘরের গৃহিণী। তিন বছর আগে তাঁর স্বামী মারা গেছেন। স্বামীর জমানো টাকায় চলেন কষ্টে সৃষ্টে। তাঁকে ঘর ভাড়া দিতে হতো না। কারণ স্বামী তাঁকে একটি বাড়ি দিয়ে গেছেন। চলছিলেন কোনোমতে। তাঁর একমাত্র ছেলে আমেরিকায় থাকে পরিবার নিয়ে। তাঁদের দুই ছেলে মেয়ে। স্বামী মারা যাওয়ার বছর খানেক পর থেকে ছেলে মাকে বলতে লাগল– মা তুমি কেন এমন দেশে পড়ে আছ? তুমি আমাদের কাছে চলে এলে তোমার বৌমা ফ্রি হয়ে যাবে। কারণ তুমি এখানে এসে তোমার নাতি–নাতনি দেখভাল করলে সে একটা চাকরি যোগাড় করে নিতে পারবে। তখন আমাদের সংসারের আয় বৃদ্ধি পাবে। আমরাও সুখে থাকতে পারবো– আর তোমারও একাকীত্ব দূর হবে। কিন্তু ভদ্রমহিলা কিছুতেই তাঁর স্বামীর স্মৃতিঘেরা ঘর ছেড়ে যেতে রাজি হন না। শেষমেষ ছেলের কথায় রাজি হলেন। ছেলে কিছুদিন আগে কলকাতায় আসল। মাকে রাজি করিয়ে বাড়িটা বিক্রি করে দিল। মাকে বলল, তুমি সব গুছিয়ে নাও। তোমার যেগুলি বিশেষ প্রয়োজন শুধু তাই নিও। কারণ শুধু শুধু বোঝা বইয়ে লাভ নেই। আমেরিকায় সব কিছু পাওয়া যায়। মাও সেই হিসাবে তৈরি হলো।

তারপর একদিন আমেরিকা যাওয়ার জন্য ভদ্রমহিলা ছেলের সঙ্গে বের হলেন ঘর থেকে। গেলেন এয়ারপোর্টে। তখন সন্ধ্যা। মাকে রিসেপশন লাউঞ্জে বসিয়ে ছেলে বলল, ‘তুমি একটু বসো। আমি আসছি।’ মা বসে আছেন, বসে আছেন। ছেলের আর দেখা নেই।

এয়ারপোর্ট পুরোটা ভিভিও সারভিলেন্সে। রাতের ডিউটির এক লোক লক্ষ্য করলেন– এক বৃদ্ধা বসে আছেন এক আসনে তার ডিউটির শুরু থেকে। তার ডিউটি প্রায় শেষ, কিন্তু সেই বৃদ্ধা এখনো বসা। তার কৌতূহল জাগল। তিনি বৃদ্ধার কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার, আপনি দেখছি অনেক আগে থেকে এখানে বসে আছেন? উত্তরে বৃদ্ধা বললেন, আমার ছেলে আমাকে আমেরিকায় নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে বসতে বলে সে যে গেলো, এখনো আসছে না। আমি দুশ্চিন্তায় ভুগছি। ছেলে আমার কোথায় গেল? কোন অঘটন ঘটল না তো?

তখন সেই লোক জানতে জানতে চাইলেন, আপনি কোন এয়ারলাইন্সের যাত্রী? রাতে অনেক এয়ারলাইন্স আমিরকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে। বৃদ্ধা জানালেন, উনি কিছুই জানেন না। সেই লোক তখন বুঝতে পারলেন, ছেলে বৃদ্ধার সর্বস্ব নিয়ে তাকে পথে বসিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে। একবার চিন্তা করল না তার জন্মধাত্রী মায়ের কী হবে?

নিরীহ এই মহিলার ভাগ্য ভাল, তিনি একজন ভাল মানুষের হাতে পড়েছেন। সেই ভদ্রলোক তাকে খাইয়ে তার পরিচিত ইনার হুইল ক্লাবের সদস্যদের কাছে নিয়ে এসেছেন– যদি তারা সেই বৃদ্ধার সহায়তায় কিছু করতে পারেন।

ক্লাবের সদস্যরা তাকে গ্রহণ করলেন। তাঁরা তাঁকে একটা বৃদ্ধাশ্রমে স্থান করে দিলেন। এই হলো আমাদের সভ্যতা। মাকে পর্যন্ত পথে বসিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছি।

মনে পড়ে যায় নচিকেতার সেই গান– ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার। মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার। নানা রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি। সবচে কমদামি ছিলাম একমাত্র আমি। ছেলের আমার আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম। আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’

এখানে ছোট একটি গল্প বলেই এ লেখা শেষ করব।

গল্পটি হলো–প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বলল, তুমি যা চাইবে তাই আমি তোমাকে দেব। প্রেমিকা বলল, তুমি সত্যি বলছ তো, নাকি আমাকে ভোলাবার জন্য বলছ? প্রেমিক বলল, তুমি পরীক্ষা করে দেখতে পার। প্রেমিকা বলল, ‘আমি তোমার মায়ের কলিজা চাই।’

ছেলেটি মায়ের কাছে গেল। বলল, আমার প্রেমিকা তোমার কলিজা চায়। কী করব বল। মা বললেন, ‘বাবা, তোর সুখের জন্য আমি সব কিছু করতে পারি। তুই আমার কলিজা নিয়ে তোর প্রেমিকাকে উপহার দে।’ ছেলে মাকে হত্যা করে কলিজা নিয়ে দৌঁড়ে যাবার সময় পড়ে গেল। তখন মায়ের সেই কলিজা বলে উঠল– ‘বাচা, ব্যথা পেয়েছিস?’

এই হলো মা।

মনে পড়ে গেল কিছুদিন আগে টেলিভিশনে দেখা এক দৃশ্যের কথা। এক লোক তার বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসার জন্য যাচ্ছে। তখন বৃদ্ধের নাতি তার বাবাকে বলছে– ‘বাবা, তুমি যখন বৃদ্ধ হবে, তখন তোমাকেও কি আমি বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসব?’

যাদের বাবা–মা দুনিয়াতে বেঁচে আছেন তারা পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষ। বেঁচে থাকতে অনেক সন্তানই তাঁদের যথাযথ মর্যাদা দেন না। কিন্তু মৃত্যুর পর বুঝতে পারেন মাথার উপর থেকে কত বড় ছায়া সরে গেছে। তাই আসুন, বাবা–মা বেঁচে থাকতে তাঁদের প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসা দিই। কখনও তাঁদের যেন অবহেলা না করি। আজ বিশ্ব মা দিবসে এটাই হোক আমাদের শপথ। আজাদী ।

লেখক : বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক আজাদী পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক। সাংবাদিকতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০২২ সালে সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রদান করে।  

খালেদ / পোস্টকার্ড ;