শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতুতে পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনের সঙ্গে একাধিক যানবাহনের সংঘর্ষে ৩ জন নিহত এবং ৫ জন গুরুতর আহত হওয়ার সত্যতা জানা গেছে । দুর্ঘটনার পর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে এবং লোকোমাস্টারসহ ৪ জন রেলকর্মীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
শুক্রবার (৬ জুন) সকালে এ তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মো. সুবক্তগীন।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ট্রেন দুর্ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে লোকোমাস্টারের অবহেলাকেই প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঘটনার পরপরই ট্রেনের লোকোমাস্টারসহ মোট চারজন রেল কর্মীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।
শুক্রবার (৬ জুন) রেলপথ মন্ত্রনালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
বরখাস্তকৃতরা হলেন পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনের দায়িত্ব পালনকারী গার্ড সোহেল রানা (হেড কোয়ার্টার, চট্টগ্রাম), লোকো মাস্টার গোলাম রসুল (টি নং-৫৩০), সহকারী লোকো মাস্টার আমিন উল্লাহ (টি নং-৭২৩) এবং অস্থায়ী গেট কিপার (টিএলআর) মাহবুব।
দুর্ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের তদন্ত কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রদান করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা চট্টগ্রাম, ডিএমই (লোকো), চট্টগ্রাম, ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার- ১ এবং বিভাগীয় চিকিৎসক, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক এ বিষয়ে বলেন, ‘প্রাইমারি ইনভেস্টিগেশন হয়েছে। তবে দুর্ঘটনার প্রকৃত ঘটনা জানতে এবং কারো অবহেলা থাকলে তা নির্ধারণে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। আপাতত চারজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। দুর্ঘটনার ফলে কালুরঘাট সেতুতে সাময়িকভাবে রেল ও যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তবে দ্রুত উদ্ধার অভিযান শেষে সেতুতে পুনরায় চলাচল স্বাভাবিক হয়।’
এর আগে বৃহস্পতিবার (৫ জুন) রাত সাড়ে ১০টার দিকে কালুরঘাট সেতুতে কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী ‘পর্যটক এক্সপ্রেস’ ট্রেনের সঙ্গে একাধিক যানবাহনের সংঘর্ষ হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী ‘পর্যটক এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি কালুরঘাট সেতুতে ওঠার সময় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে ধাক্কা দেয়। এরপর ট্রেনটি আরও কয়েকটি যানবাহন—যার মধ্যে একটি মোটরসাইকেল ও একটি পিকআপ ভ্যান ছিল—সেগুলোকেও চাপা দেয়, ফলে যানবাহনগুলো দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
দুর্ঘটনাস্থলেই তিনজনের মৃত্যু ঘটে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক মো. তুষার (২৫) এবং একটি দুই বছর বয়সী শিশু আয়েশা। নিহত শিশু আয়েশা বোয়ালখালী পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মুন্সিপাড়ার মো.মিঠুর কন্যা। আয়েশা বাবা-মায়ের সাথে ঈদের বন্ধে বাড়ি আসছিল। এঘটনায় আয়েশার মা জোবায়রাও আহত হয়েছেন। তাদের নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আয়েশাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। নিহত সিএনজি অটোরিকশা চালক মো.তুষার পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর গোমদণ্ডীর বাসিন্দা। তিনি নগরী থেকে যাত্রী নিয়ে বোয়ালখালী আসছিলেন। তৃতীয় নিহত ব্যক্তির পরিচয় এখনও জানা যায়নি।
আহত সিএনজি অটোরিকশার যাত্রী আসিফ উদ্দিন বাপ্পী, আসমা আহমেদ, আঞ্জুমান আরা (৫৫) ও মো. মনিরুল (৬০)। এরমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩ জন ভর্তি হয়েছেন। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে। বোয়ালখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আইসক্রিম ভ্যানচালক মো.মনিরুল চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া বোয়ালখালী উপজেলার একটি বেসরকারি হাসপাতালের আউটডোরে ৪ জন চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জাফরিন জাহেদ জিতি।
প্রত্যক্ষদর্শী মহিউদ্দীন বলেন, রাতে তিনি বোয়ালখালী আসছিলেন। সেতুর পশ্চিম প্রান্তে ট্রেন আসার সিগন্যাল দেওয়ায় তার লোকাল সিএনজি অটোরিকশা আটকে যায়। ফলে গাড়ি থেকে নেমে সেতুর ওয়াকওয়ে দিয়ে হেঁটে পার হচ্ছিলেন তিনি। এসময় একটি মোটরসাইকেল, ৫টি সিএনজি অটোরিকশা ও একটি আইসক্রিমভ্যান সিগন্যাল না মেনে দ্রুত গতিতে সেতু পার হয়ে যাচ্ছিল। এসময় পূর্ব প্রান্তে দিয়ে ট্রেন সেতুতে উঠে পড়লে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই সংঘর্ষে গাড়িগুলো দুমড়ে মুচড়ে যায়।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে কালুরঘাট ফায়ার সার্ভিসের একটি দল দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। রেলওয়ে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
কালুরঘাট ফায়ার স্টেশনের ফায়ারফাইটার আমিনুল ইসলাম জানান, রাত ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে আমরা দুর্ঘটনার খবর পাই এবং তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। আমরা আহতদের উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেছি। রাত সাড়ে ১২টার দিকে ট্রেনের নিচ থেকে একটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) আলাউদ্দিন তালুকদার বলেন, ‘হাসপাতালে আনার পর দুইজনকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আহত পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তারা বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন।’
গোমদণ্ডী রেলওয়ে স্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার আজম উদ্দিন জানান, ট্রেনটি দ্রুতগতিতে সেতুতে প্রবেশ করলেও তখন সেতুর ওপর একটি বিকল অটোরিকশাসহ আরও যানবাহন ছিল। তার ভাষায়, ‘আমরা লাল সংকেত দিয়েছিলাম এবং গার্ডও লাল পতাকা দেখিয়ে সংকেত দিচ্ছিলেন, কিন্তু ট্রেনের চালক থামেননি।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী কোনো ট্রেনকে কালুরঘাট সেতুর পূর্ব প্রান্তে অন্তত ১০০ গজ দূরে থেমে থাকতে হয় এবং লাইনম্যানের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পরই সেতু পার হতে হয়। কিন্তু এই দুর্ঘটনায় ট্রেনচালক এই প্রটোকল অমান্য করে সংকেত না নিয়ে সেতুতে প্রবেশ করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
তিনি বলেন, সেতুতে আটকে পড়া ট্রেনটি সরিয়ে নিতে আরেকটি ইঞ্জিন রাত সাড়ে ১১টা দিকে উদ্ধার তৎপরতায় যোগ দেয়। রাত তিনটা ২০ মিনিটের সময় ট্রেনটি যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে বলে জানান তিনি ।
খালেদ/ পোস্টকার্ড ;