পাইকারিতে কমলেও খুচরায় কমেনি পেঁয়াজের দাম

নিজস্ব প্রতিবেদক ।।

পাইকারিতে কমলেও  খুচরায় কমেনি পেঁয়াজের দাম
জেলায় জেলায় মোকাম ও আড়তে অভিযানের পর পাইকারিতে দাম কমলেও খুচরায় তার প্রভাব এখনও পড়েনি। ভারত রফতানি বন্ধের পর অনেকেই হুজুগে বাড়তি পেঁয়াজ কিনেছিলেন। এতে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। ফলে দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। এখন বাজারে চাহিদা কম। এ ছাড়া মিসর ও তুরস্ক থেকে কম দামে পেঁয়াজ আমদানির খবর আসছে। এতে পাইকারি বাজারে দাম কমলেও খুচরা বাজারে কমেনি।
 
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারত থেকে আসা যেসব পেঁয়াজ ভোমরা, হিলি ও বেনাপোল স্থলবন্দরে প্রবেশ করেছে তা দ্রুত খালাস করতে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া টেকনাফ স্থলবন্দর হয়ে প্রতিদিন মিয়ানমার থেকে প্রায় ২০০ টন পেঁয়াজ আসছে। এলসির মাধ্যমে মিসর ও তুরস্ক থেকে আসা পেঁয়াজও চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস শুরু হয়েছে।
 
স্বল্প দূরত্বের দেশ মিয়ানমার থেকে আসা পেঁয়াজের আমদানি মূল্য ৪২-৫৫ টাকার মধ্যে থাকছে। তবে হঠাৎ রফতানি চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এই বাজারেও পেঁয়াজের দাম ঊর্ধ্বমুখী বলে আমদানিকারকরা জানান। অন্যদিকে বাজার স্থিতিশীল রাখতে এবং নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সুলভ মূল্যে পেঁয়াজ সরবরাহ করতে ট্রাক সেলের পরিমাণ বাড়িয়েছে সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ঢাকায় টিসিবির ট্রাক সেল ১৬টি থেকে বাড়িয়ে ৩৫টিতে উন্নীত করা হয়েছে। সেখানে প্রতিকেজি ৪৫ টাকা দরে পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে।
 
সরকারি হিসাব মতে, দেশে বছরে মোট পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন। গত ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন। তবে অসময়ে বৃষ্টির কারণে অন্তত ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বেড়ে গেছে আমদানি নির্ভরতা। পেঁয়াজের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বছরে আমদানি হয়ে থাকে ৮-১০ লাখ টন। মন্ত্রণালয়ের তদারকি সংস্থার হিসাব মতে, দেশে পেঁয়াজের কোনো সংকট নেই।
 
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, ১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া দেশি পেঁয়াজ বৃহস্পতিবার পাইকারি বাজারে ৮০-৮৫ টাকা দরে বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০-১১৫ টাকায়। কারওয়ান বাজারের এক আড়তের বিক্রেতা আজিজুল হক প্রতিকেজি ভারতীয় পেঁয়াজ ৮০ টাকা দরে বিক্রি করছিলেন। পাশেই আরেক দোকানে দেশি পেঁয়াজ ৮৫ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। এসব দোকান থেকে ক্রেতারা পাঁচ কেজি করে পেঁয়াজ কিনতে পারেন।
 
খুচরা বাজার ব্যবসায়ীরা বলছেন, বুধবারের কেনা দেশি পেঁয়াজ ১১০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। তবে বৃহস্পতিবার কেনা প্রতিকেজি পেঁয়াজ ১০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। তারা বলছেন, কয়েকদিনের মধ্যে দাম আরও কমবে।
 
শান্তিনগরের এক পেঁয়াজ ব্যবসায়ী বলেন, ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেওয়ার ফলে হঠাৎ করে দাম বেড়েছে। তবে মিয়ানমারসহ অন্য দেশগুলো থেকে সরকার জরুরি ভিত্তিতে পেঁয়াজ আমদানি করায় বিদ্যমান সংকট কমে আসছে। এ কারণে পেঁয়াজের দাম কমছে।
 
ভারত রফতানি বন্ধের আগে শ্যামবাজারে প্রতিকেজি ভারতীয় পেঁয়াজ ৫৫-৫৬ এবং দেশি পেঁয়াজ ৬০-৬৫ টাকায় বিক্রি হতো। খুচরা বাজারে বাছাই করা দেশি পেঁয়াজ ৭৫-৮০ টাকা, সাধারণ দেশি পেঁয়াজ ৭০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৬০-৬৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করতেন বিক্রেতারা। দেখা যাচ্ছে, পাইকারিতে দাম আগের দরের কাছাকাছিতে চলে এসেছে।

প্রসঙ্গত, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, পেঁয়াজের দাম দ্রুতই কমে যাবে। এ সময় তিনি দাম বেঁধে দেওয়ার চিন্তার কথাও জানান। পেঁয়াজ আমদানিতে গতকাল ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনে জানায়, এই সুদহার আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।

এদিকে খাতুনগঞ্জে জেলা প্রশাসনের অভিযানের পর পাইকারিতে পেঁয়াজের দাম কমলেও নগরীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে দর লাগামহীন। গতকাল বৃহস্পতিবার খাতুনগঞ্জে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা কমে বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
ভোক্তাদের অভিযোগ, বাজারে যথাযথভাবে মনিটরিং হচ্ছে না। এজন্য একশ্রেণির সিন্ডিকেট পেঁয়াজের বাজারকে অস্থিতিশীল করেছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে পেঁয়াজের দাম ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে আনান জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দাবি তাদের।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের বাজার মনিটরিং করেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম। এসময় তিনি সাংবাদিকদের জানান, অভিযানের পর পেঁয়াজের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। মানভেদে আজ (বৃহস্পতিবার) বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় এবং প্রায় সব আড়তে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুত রয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পরিচালিত অভিযানের প্রভাব সারাদেশে পড়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, কৃত্রিম সংকট তৈরি এবং কিংবা অন্য কোনো উপায়ে যারা পেঁয়াজের বাজারে কারসাজি করেছে তাদের তালিকা হচ্ছে এবং রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পেঁয়াজের বাজারে অভিযানের আগে-পরে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে গোয়েন্দা নজরদারী রয়েছে জানিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, পেঁয়াজের ব্যাপারে কারসাজিতে জড়িত কিছু আড়তদার-ব্যবসায়ীদের তথ্য জেলা প্রশাসনের কাছে রয়েছে। বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে বিক্রেতারা জানান, পাইকার ও আড়তদারদের কাছ থেকে বেশি দামে পেঁয়াজে ক্রয় করতে হচ্ছে বলে চড়া মূল্যে বিক্রি করতে তারা বাধ্য হচ্ছে। আর আড়তদারদের দাবি, দামের এমন উর্ধ্বগতিতে হাত নেই তাদের। আমদানিকারকদের সাথে সরকারের বসার আহবানও জানান তারা।
ব্যবসায়ীরা আরো জানান, ক্রেতাদের কাছে যেমন পেঁয়াজের দামটা বেশি মনে হচ্ছে, তেমনি পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে আমাদেরও লোকসানে পড়তে হচ্ছে। আগে যে পরিমাণ পেঁয়াজ বিক্রি হতো তা এখন নেমে এসেছে অর্ধেকে।
খাতুনগঞ্জ পাইকারি ব্যবসায়ী এমদাদুল হক রায়হান বলেন, গত মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান চালালে পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমাতে বাধ্য হই। আবার পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে বেচা-বিক্রি কমে গেছে। পেঁয়াজের দাম কমলেই ব্যবসার ক্ষেত্রে ভালো এবং মান অনুসারে বিক্রিও মন্দ হয় না।
পাইকারি বাজারে নিয়মিত অভিযানের ফলে পেঁয়াজের দাম কমলেও খুচরা বাজারে প্রভাব পড়েনি বলে অভিযোগ ভোক্তা সাধারণের।
কদমতলী এলাকার গৃহিণী মরিয়ম আক্তার জানান, টেলিভিশনে দেখছি পেঁয়াজের দাম কমছে, কিন্তু এখনো তো দোকানদাররা (খুচরা) কমালো না। তারা প্রতিকেজি ৮০ টাকা বিক্রি করছে। যেসব পেঁয়াজের চামড়া ওঠে গেছে সেগুলো ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি করছে। অথচ পাইকারি বাজারে চামড়া ওঠে যাওয়া পেঁয়াজগুলো ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা পেঁয়াজ কিনতে আসা সোহেল রানা বলেন, প্রশাসনের উচিত খুচরা এবং পাইকারি বাজারে দাম নির্দিষ্ট করে দেয়া দরকার। তা না হলে তারা (ব্যবসায়ীরা) ভোক্তাদেরকে ঠকাবে।
দোকানদার জাবের হোসেন বলেন, আমরা প্রতি চালান যে দামে কিনেছি এর চেয়ে বেশি দামে তো বিক্রি করতে হবে। ধরুন, ২৮ সেপ্টেম্বর ৫০ কেজি পেঁয়াজ কিনেছি ৭০ টাকা কেজি দরে। তাহলে আমাদের তো ৭৫ টাকা বিক্রি করতেই হবে। লস দিয়ে তো বিক্রি করতে পারবো না। পরবর্তী চালানে যদি কম টাকা দিয়ে কিনতে পারি তবে আমরাও কম টাকায় বিক্রি করতে পারবো।
নির্দিষ্ট দামের প্রসঙ্গ নিয়ে চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভিন তিবরীজি বলেন, পেঁয়াজে নির্দিষ্ট দাম নির্ধারণ করে দিতে পারছি না। কারণ তিন ধরনের পেঁয়াজের দাম তিন রকম। আবার দুই-একদিনের মধ্যে নতুন আমদানি করা পেঁয়াজ দেশের বাজারে ঢুকবে। তবে অতিরিক্ত মূল্যে যাতে কেউ পেঁয়াজ বিক্রি করতে না পারে সে লক্ষ্যে চট্টগ্রামের সব পাইকারি বাজারে আমাদের মনিটরিং অব্যাহত রয়েছে। অতিরিক্ত দামে বিক্রি করার অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে ভোগ্যপণ্যের অন্যতম বাজার খাতুনগঞ্জ এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ রানা এবং আলী হাসানের নেতৃত্বে রিয়াজউদ্দিন বাজারে অভিযান চালানো হয়। এরপর থেকে কমতে শুরু করে পেঁয়াজের দাম।