মোহাম্মদ রাকিব। বিশিষ্ট ডিম ব্যাবসায়ীদের একজন। সে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে পাইকারি ডিমের ব্যবসা করেন। সম্প্রতি তিনি বলেন, প্রত্যেকদিনের দামে ডিম কিনতে গেলে কাজী ফার্মস বাড়তি টাকা দাবী করে। সরকারী পাইকারি দাম ১০.৫৮ পয়সা হলেও তা না মেনে ১১.০৯ টাকা হয়ে যায়। যদিও অনেকে সরকারী দামেই ডিম বিক্রি করছে। রাকিব কিছুটা অপ্রস্তুত । সে চিন্তা করে সে এতদিনে যে বাজারটা সৃষ্টি করেছে সেটা না ধ্বসে পড়ে । তার যেন মাথায় হাত ।
চাহিদা বাড়তেই বেড়ে গেল ডিমের দাম। ১০ দিনের ব্যবধানে ডিমের দাম ডজনে ৩৫ টাকা বেড়েছে। বিক্রেতারা বলছেন, হঠাৎ করে এই মূল্যবৃদ্ধির কয়েকটি কারণের মধ্যে রয়েছে মাছ ও সবজির চড়া দাম। সব ধরনের মাছ ও সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষ ডিমের প্রতি বেশি ঝুঁকেছেন। এতে বাজারে ডিমের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে দামও। আর উৎপাদকেরা বলছেন, কিছু খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উৎপাদনও কমে গেছে। বাজারে এখন প্রতি ডজন ডিমের দাম ১৫০ টাকা। বিক্রেতারা বলছেন, ৮–১০ দিনের ব্যবধানে বাজারে হঠাৎ করে ডিমের চাহিদা বেড়ে গেছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে সবজি ও মাছের দাম অনেক বেশি। তাই নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ বাধ্য হয়ে মাছ ও সবজির বদলে ডিমে বেশি আগ্রহী হয়েছেন।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, দেশে দৈনিক সাড়ে ৪ কোটি থেকে ৫ কোটি পিস ডিম উৎপাদিত হয়। ডিমের চাহিদাও ৫ কোটি পিসের আশপাশে। ফলে কোনো কারণে হঠাৎ করে ডিমের চাহিদা বেড়ে গেলে বা সরবরাহ কমে গেলে তাতে ডিমের দামে তার তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর গত বছরের সেপ্টেম্বরে ডিমের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। তখন উৎপাদন পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের যৌক্তিক দাম ধরা হয় ১০ টাকা ৫৮ পয়সা। অর্থাৎ এ দামে উৎপাদনকারীরা পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ডিম বিক্রি করবেন। একই সঙ্গে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি পিস ডিমের যৌক্তিক দাম ১১ টাকা ১ পয়সা ও খুচরায় তা ১১ টাকা ৮৭ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। সেই হিসাবে খুচরা পর্যায়ে এক ডজন ডিমের দাম হওয়ার কথা ১৪২ টাকা ৪৪ পয়সা। বর্তমানে বাজারে এক ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। তবে গত কয়েক মাসে ডিম বিক্রি হয় ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়।
বাংলাদেশ এগ প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তাহের আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের হিসাবে সাম্প্রতিক সময়ে ডিমের উৎপাদন প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে। ডিম উৎপাদনকারী বেশ কিছু খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এতে মুরগির সংখ্যা ও ডিমের উৎপাদন কমেছে।’ তবে ডিমের উৎপাদন ব্যয় আগের মতোই আছে বলে জানান তিনি।
প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, গত সাত মাস যে দামে ডিম বিক্রি হয়েছে, সেটি যৌক্তিক দাম ছিল না। গত সাত মাস খামারিরা ৭ থেকে ৮ টাকায় প্রতি পিস ডিম বিক্রি করেছেন। অথচ এই ডিমের উৎপাদন খরচ ন্যূনতম ১০ টাকা। দীর্ঘ সময় ধরে উৎপাদকেরা অনেকটা কম দামে কিংবা লোকসানে ডিম বিক্রি করেছেন। এতে অনেক খামার বন্ধও হয়েছে। এখন চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় খামারিরাও দাম বাড়িয়েছেন।
এদিকে ডিমের দাম বাড়ায় অসুবিধায় পড়েছেন ভোক্তারা; বিশেষ করে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষেরা এ নিয়ে ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। ডিমের দাম বৃদ্ধির ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরের বাসিন্দা মহিউদ্দীন জানান, তিনি মাছ-মুরগি কিনতে পারেন না, তাই ডিম কিনতেন। কিন্তু এখন ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় তার জন্যও সমস্যা তৈরি হয়েছে।
বর্তমানে ডিমের দাম বৃদ্ধি ভোক্তাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি উদ্যোগে ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধি ও বাজার তদারকি বাড়ানো প্রয়োজন। এছাড়া, ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও বিকল্প খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলাও গুরুত্বপূর্ণ।
গত বছরও সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বাজারে ডিমের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল। ওই সময় সরকার ডিমের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ এবং বাজার তদারকি শুরু করে। এছাড়া বিদেশ থেকে ডিম আমদানিরও অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর দাম কমতে শুরু করে।
বর্তমানে যাতে সরকার আবারও ডিমের দাম আগের মতো নির্ধারণ করে দেন সেজন্য ডিম ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন বিশিষ্ট ডিম ব্যবসায়ী আল আমিন এন্টার প্রাইজ এর প্রোপাইটর মোঃ আল আমিন । তিনি প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে আবেদনে লেখেন ,
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষি অধিদপ্তর কর্তৃক ১৫/০৯/২০২৪ ইং তারিখে জারিকৃত পরিপত্র ( স্মারক নং- ৩৩.০১.০০০০.১১২.৪৭.০০৯.২৩.৪০৭) অনুযায়ী ডিমের ক্রয়মূল্য ১০.৫৮ টাকা এবং বিক্রয়মূল্য ১১.০১ টাকা নির্ধারিত হয়। আমরা উক্ত মূল্যে দেশব্যাপী ডিম সরবরাহ করে আসছি, যা উৎপাদনকারী, সরবরাহকারী ও ভোক্তা সকল পক্ষের জন্য যথার্থ ও সমন্বিত বলে প্রমাণিত হয়েছে।
তিনি তার আবেদনে বর্তমান সমস্যা সম্পর্কে লেখেন, সম্প্রতি কিছু ডিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সরকার নির্ধারিত মূল্যে ডিম বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। এর ফলে,
১. বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে;
২. ডিমের সরবরাহ হ্রাস পেয়ে তীব্র সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে;
৩. ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
প্রস্তাবিত সমাধানে তিনি লেখেন, বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এবং ডিমের সুষ্ঠু সরবরাহ নিশ্চিত করতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি ,
০১. ২০২৫ সালের জন্য ডিমের দাম পুনর্নির্ধারণ করা , অথবা ০২. পূর্বের নির্ধারিত মূল্য (১০.৫৮/১১.০১ টাকা) কার্যকর রাখা , বা ০৩. উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারি নীতিমালা মেনে চলতে বাধ্যতামূলক করা।
তিনি যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেন,
নির্ধারিত মূল্যে ডিম বিক্রি করা উৎপাদনকারীদের পক্ষে সম্ভব ( আমাদের অভিজ্ঞতায় এটি লাভজনক ); নয়তো মূল্য অস্থিতিশীলতা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব ফেল্যত।
তিনি লেখেন, সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব।
সবশেষে তিনি সরকারের কাছে অনুরোধ জানান,
আমরা আপনার কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ করছি যে, ডিমের দাম পুননির্ধারণ বা পূর্ববর্তী মূল্য বাস্তবায়নের বিষয়ে অতিসত্ত্বর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। এতে করে দেশের ডিমের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এবং ভোক্তাগণ ন্যায্যমূল্যে ডিম পেতে সক্ষম হবেন।
এদিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের দক্ষিণ সলিমপুর এক পাইকারি ডিম ব্যবসায়ী এস এম শেখ ফরিদ উদ্দীন রক্সি জানান, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত রেট ১০ টাকা ৫৮ পয়সার স্থলে কাজী ফার্মস ১১.০৯ চট্টগ্রাম ডিপুতে, ঢাকা তে ১১.৩৫, বগুড়া ডিপুতে ১১.২০ ডিম বিক্রি করছে । সে ক্ষেত্রে আমরা ডিপু থেকে ডিমটা আনতেই ৩০/৪০ খরচ পড়ে, তার মধ্যে ডিম ভাংগে । সব মিলাই ১ টাকা খরচ পড়ে । আমরা কত ধরে বিক্রি করবো ?
তিনি বলেন , ডিমের দাম আরো বাড়ার সম্ভাবনা ব্যাপক , তিনি মনে করেন ডিমের দাম আরো বাড়ার পেছনে নেতৃত্ব দিচ্ছে কর্পোরেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গুলো ।
খালেদ / পোস্টকার্ড ;