যথাযথ মর্যাদা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ১২ রবিউল আউয়াল পালিত হয়েছে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.)। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে মানব জাতির রহমত স্বরূপ প্রেরিত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (দ.) আরবের মক্কা নগরীর সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে মা আমিনার কোলে জন্ম নেন।
এ উপলক্ষে শনিবার চট্টগ্রামে আনজুমান–এ–রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট ও গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত হলো বিশ্বের সর্ববৃহৎ জশনে জুলুস। লাখো হৃদয়ের আবেগের ঢেউয়ে রূপ নিল এ আয়োজন। ভোর হতে না হতেই চট্টগ্রামের প্রতিটি অলিগলি, সড়ক, ফ্লাইওভার সব জায়গাই ঢল নামে নবী প্রেমিকদের। ভোর থেকেই জামেয়া এলাকায় উপচে পড়া ভিড় ছিল। কেউ হাতে সবুজ পতাকা, কেউ ফুলের ঝুড়ি, কেউবা মুখে হামদ ও না’ত গাইতে গাইতে এগিয়ে এসেছে। উৎসবের আবহে সাজানো হয়েছিল নগরীর প্রধান সড়ক, ফ্লাইওভার ও চত্বর। জুলুসের প্রতিটি ধাপে ফুটে ওঠে নবীপ্রেমের এক অনন্য দৃশ্য। সকাল ৯টায় ষোলশহর আলমগীর খানকাহ্ শরীফ থেকে বিশাল জুলুস বের হয়। অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মিছিল অগ্রসর হয় নগরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে স্রোতের মতো মানুষ যোগ দিতে থাকে। নির্দিষ্ট রুট ধরে এগুতে থাকে জুলুস। দুপুরে এই জনস্রোত গিয়ে মিশে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসার বিশাল মাঠে। সেখানে অনুষ্ঠিত হয় সমাপনী মাহফিল, মিলাদ–কিয়াম ও মুনাজাত।
এবারের জুলুসে অংশ নেয় লাখ লাখ মানুষ। নগরের প্রতিটি প্রান্ত থেকে কাফেলা এসে জুলুসে যোগ দেয়। শুধু চট্টগ্রাম নয়, দেশের বিভিন্ন জেলা–উপজেলা থেকেও যোগ দেয় শত শত গাড়িবহর। পথে পথে মানুষ শরবত, পানি, শুকনা খাবার, ফল, বিরিয়ানির প্যাকেট, চকলেট, টিস্যু যা পেরেছেন তাই বিলিয়ে দিয়েছেন। কোনো কোনো জায়গায় হাসপাতাল ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান বিনামূল্যে চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছে। এবার জুলুসে নেতৃত্ব দেন আওলাদে রাসুল, রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরিকত, পীরে বাঙাল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবির শাহ (মা.জি.আ.) এবং শাহজাদা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ কাসেম শাহ (মা.জি.আ.)।
জামেয়ার মাঠে আওলাদে রাসুল, পীরে বাঙাল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবির শাহ্ বলেন, আজকের দিন, বিশেষ দিন। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের উপরে ইহসান করেছেন হুযুরকে প্রেরণ করেছেন, হুযুর (দ.)-এর উম্মত হওয়ার জন্য অন্যান্য নবীগণ দো’আ করেছেন, হযরত ঈসা (আ.) আসবেন নবীর উম্মত হয়ে। আল্লাহর দয়া দেখুন, তিনি আমাদেরকে হুযুরের উম্মত বানিয়েছেন। তাহলে এ নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা আমাদের উচিত নয় কি? চট্টগ্রামে যে জঝবা নিয়ে জশনে জুলুস বের হয়েছে, সেটার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোথাও নেই বলে মন্তব্য করে আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবির শাহ (মা.জি.আ.) বলেন, আপনারা সৌভাগ্যবান যে, এত বড় জুলুসে আপনারা অংশ নিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা সূফীগণের ত্বরিকাতে আছি। গাউসে আযমের ত্বরিকা, খাজা চৌহ্রভীর ত্বরিকায়, শাহানশাহ–এ সিরিকোটির ত্বরিকা, আজ জুলুসের ৫৪ বছর পূর্ণ হলো। আমি দাবির সাথে বলছি, এখানে কোন দেশদ্রোহিতা নেই, সন্ত্রাসবাদ নেই, কোন রাজনীতি নেই, আছে মুহাব্বতের বন্ধন। এটা পেয়েছি, সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ হুযুর, তৈয়্যব শাহ্ হুযুর থেকে। আজ জামেয়াতে ১০ হাজার ছাত্র কোরআন–হাদীস, রূহানিয়্যাতের তালিম নিচ্ছেন, গাউসিয়া কমিটি, দাওয়াতে খাইর এগুলো আর কারও ভাগ্যে মিলেনি। এগুলো আমানত। এ আমানতগুলোর জিম্মাদারি হুজুর কিবলাগণ বাঙালিদের উপর দিয়েছেন। এগুলো হিফাযত করবেন।
সাহেবজাদা সৈয়্যদ মুহাম্মদ কাসেম শাহ্ (মা.জি.আ) বলেন, আজ আমি চট্টগ্রামের ভাইদের মোবারকবাদ দিচ্ছি। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় র্যালি আজ চট্টগ্রামে দেখলাম। নবীজি (দ.) যখন ছিলেন না, কিছুই ছিল না। তিনি জান, প্রাণ। এই জাহানের জান আছে বলে জাহান আছে। (আ’লা হযরত) এই রেযা তুমি কোন চিন্তা করো না, তুমিতো গোলামে মোস্তফা। তোমার জন্য নিরাপত্তা রয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও জুলুস পরিচালনা সাব–কমিটির উপদেষ্টা ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, পবিত্র জশনে জুলুসে ঈদ–এ মিলাদুন্নবী (দ.) উপলক্ষে সারা চট্টগ্রামে সাজ সাজ রব পড়ে গিয়েছে। চট্টগ্রামবাসী ধন্য একজন আওলাদে রাসূলের নেতৃত্বে প্রিয়নবীর শুভ জন্মদিনে বিশাল জুলুস অনুষ্ঠিত হয়েছে। আনজুমান ট্রাস্টের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মনজুর আলম জুলুসে অংশগ্রহণকারী ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের পক্ষ থেকে হুজুর কেবলাগণকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানান। পাশাপাশি জুলুসে অংশগ্রহণকারী সকলকে ধন্যবাদ জানান। তিনি জুলুসের সফলতার ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টামণ্ডলী, চট্টগ্রামের মেয়র, জেলা প্রশাসক, পুলিশ কমিশনারসহ সকলকে ধন্যবাদ জানান। সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জশনে জুলুছে ঈদ–এ মিলাদুন্নবী (দ.)-এ অংশগ্রহণকারী সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলেন, এবারের জুলুস ছিল সর্বকালের সর্ববৃহৎ। ১৯৭৪ সালে প্রবর্তিত জুলুস আজ কোটি মানুষের র্যালি ও মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
এতে তাকরির করেন জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসা অধ্যক্ষ হাফেজ কাজী আবদুল আলীম রেজভী, প্রধান ফকিহ আল্লামা কাজী আবদুল ওয়াজেদ, আবু তালেব মুহাম্মদ আলাউদ্দীন, আরবি প্রভাষক হাফেজ মুহাম্মদ ওসমান গণি, ঢাকা কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আল্লামা মুহাম্মদ জসিম উদ্দীন আল–আযহারী, উপাধ্যক্ষ আবুল কাশেম ফজলুল হক, হালিশহরস্থ মাদ্রাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল’র অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রেজভী। সঞ্চালনায় ছিলেন আনজুমান রিসার্চ সেন্টারের গবেষক মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হাশেম ও জামেয়ার আরবি প্রভাষক মাওলানা মুহাম্মদ জয়নুল আবেদীন। বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মোহাম্মদ এরশাদুল্লাহ, আবুল হাশেম বক্কর, যুগ্ম আহ্বায়ক আর.ইউ চৌধুরী শাহীন, মোহাম্মদ মোবারক। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আনজুমান ট্রাস্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আমির হোসেন সোহেল, এডিশনাল সেক্রেটারি মোহাম্মদ সামশুদ্দীন, মোহাম্মদ সিরাজুল হক, এস.এম গিয়াস উদ্দীন (সাকের), মোহাম্মদ কমর উদ্দীন (সবুর), মোহাম্মদ গোলাম মহিউদ্দীন, আবুল মহসিন মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, আল্লামা হাফেজ মোহাম্মদ সোলায়মান আনসারি, পেয়ার মোহাম্মদ, সাহজাদ ইবনে দিদার, আনোয়ারুল হক, তৈয়বুর রহমান, নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আলী, আবদুল হামিদ, আবদুল হাই মাসুম, প্রফেসর জসিম উদ্দীন, নুর মোহাম্মদ কন্ট্রাক্টর, সাদেক হোসেন পাপ্পু, মাহবুব ছাফা, মোহাম্মদ হোসেন খোকন, মাহমুদ নেওয়াজ, মোহাম্মদ ইলিয়াছ প্রমুখ।
সবশেষে লাখো মানুষের কান্নাভেজা দোয়া ও মুনাজাতে আকাশ–বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। হুজুর কেবলা সাবির শাহ (মা.জি.আ.) বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর শান্তি, ঐক্য, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনা করেন।
খালেদ / পোস্টকার্ড ;